যুক্তরাষ্ট্রে শিখ নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ভারতীয় কর্মকর্তা: মার্কিন কৌসুলি

শিখ আন্দোলনের নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনফাইল ছবি: এপি

আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় ভারতের বিড়ম্বনা বেড়ে চলেছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক খালিস্তান আন্দোলনের এক নেতাকে হত্যায় ভারতের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। এবার আরেক নেতাকে হত্যাচেষ্টায় ভারতের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ হাজির করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

শিখ নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে নিখিল গুপ্ত নামের এক ভারতীয়সহ এক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল বুধবার তারা জানিয়েছে, এই বছরের জুনে নিখিলকে চেক প্রজাতন্ত্রে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পান্নুন ভারত সরকারের নিষিদ্ধঘোষিত খালিস্তানপন্থী সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’(এসএফজে)-এর নেতা।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘তথ্য’ প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারতের উদ্দেশে নতুন বার্তা দেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা খবর বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমরাও সেদিকে শুরু থেকে আলোকপাতের চেষ্টা করেছি। বোঝাতে চেয়েছি, ভারতের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া। তাদের উচিত, এই সমস্যা নিয়ে আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা করা, যাতে বিষয়টির গভীরে যাওয়া যায়।’

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের শীর্ষ ফেডারেল প্রসিকিউটর ড্যামিয়ান উইলিয়ামস এক বিবৃতিতে বলেছেন, নিউইয়র্কে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত এক মার্কিন নাগরিককে হত্যার চক্রান্ত করা হয়েছিল। সেটা করা হয়েছিল ভারতে বসে। যাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, তিনি এক শিখ সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতা।

কিছুদিন আগে এই চক্রান্ত ফাঁসের খবরটি নিয়ে প্রতিবেদন করেছিল যুক্তরাজ্যের ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’ পত্রিকা। তারা জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ওই চক্রান্ত বানচাল করে দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনে এ কথাও বলা হয়েছিল, ওই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একজন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেছেন।

প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর ভারত সরকার সেটিকে অবশ্য ‘আজগুবি’ বলে উড়িয়ে দেয়নি। কয়েক দিন পর যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বিষয়টি প্রকাশ্যে আনে। এ কথাও বলা হয়, তারা ভারতের সঙ্গে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনাও করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বলা হয়েছিল, দুই দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে টু প্লাস টু আলোচনায় সংগঠিত অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুই দেশের মতবিনিময় হয়েছে। কিছু তথ্যের আদান-প্রদানও হয়েছে। বিষয়টি দুই দেশের পক্ষেই উদ্বেগের। সেই বিবৃতিতে খালিস্তানি আন্দোলন অথবা পান্নুন হত্যা চক্রান্ত বানচাল নিয়ে কোনো মন্তব্য অবশ্য ছিল না।

সেই বিবৃতির পর এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু ভারত এ নিয়ে দ্বিতীয় কোনো মন্তব্য করেনি। গতকাল বুধবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন তথ্য প্রকাশ হওয়ার ঠিক আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ভারত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করেছে।

ভারতের এই বিবৃতি প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ্যে আসে, যাতে চেক প্রজাতন্ত্রে নিখিল গুপ্তকে গ্রেপ্তারের খবর জানানো হয়।

ম্যানহাটনের ফেডারেল প্রসিকিউটর দপ্তরের দাবি, পান্নুন হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার নিখিল গুপ্তার বয়স ৫২। তাঁর বিরুদ্ধে খুনের বার্তা দেওয়ার ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। নিখিল সেই কাজ ভারত সরকারের কোনো এক সংস্থার এক পদস্থ কর্মীর নির্দেশে করছিলেন। ভারত সরকারের সেই কর্তার নাম ও পরিচয় কিন্তু জানানো হয়নি।

নিখিল ভারতেই বসবাস করতেন জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, পান্নুনকে হত্যার জন্য গত মে মাসে ভারত সরকারের ওই কর্মকর্তা নিখিলকে নিয়োগ দেন। সেই কর্তা নিজেকে জ্যেষ্ঠ মাঠ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা-সংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনা করতেন। একটা সময় তিনি ভারতের আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফ-এও কর্মরত ছিলেন। তিনি নিজেকে ‘সিসি১’ বলে ডাকতে বলেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, পান্নুনকে হত্যার জন্য আততায়ীর সন্ধান পেতে নিখিল এক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মাদক বিভাগের একজন ‘আন্ডার কভার এজেন্ট’। সেই ব্যক্তি একজন সম্ভাব্য আততায়ীর সঙ্গেও নিখিলের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেন। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য রফা হয়েছিল মোট ১ লাখ ডলার। অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল ১৫ হাজার ডলার।

যুক্তরাষ্ট্রের আনা অভিযোগে কানাডায় নিহত হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গও রয়েছে। বলা হয়েছে, নিখিল নাকি সম্ভাব্য আততায়ীকে বলেছিলেন, নিজ্জরও তাঁদের টার্গেট। এমন আরও অনেক টার্গেট আছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই অভিযোগ, নিখিল গুপ্তার গ্রেপ্তার, ‘সিসি১’-এর সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি বিষয়েই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে বিদেশি নাগরিককে হত্যা ও হত্যার ষড়যন্ত্রের মতো এমন গুরুতর অভিযোগ এর আগে কোনো দেশ করেনি।