ভারত–পাকিস্তান কি সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে, সর্বশেষ যা জানা গেল
ভারত গতকাল মঙ্গলবার মধ্যরাতের পর পাকিস্তানে সামরিক হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, তারা ভারতের পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করেছে—এই উত্তেজনা দুই দেশকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।
দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাতের ইতিহাস আছে। এই ঘটনা একটি বিপজ্জনক অবস্থানে ঠেলে দিয়েছে। ইসলামাবাদ ভারতের হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে এবং আন্তর্জাতিক মহল উভয় পক্ষকে সংযম দেখাতে আহ্বান জানিয়েছে।
নয়াদিল্লি বলেছে, এই হামলা এপ্রিল মাসে ভারতশাসিত কাশ্মীরের পাহাড়ি পর্যটনকেন্দ্রে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় চালানো হয়েছে। ওই হামলায় নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিলেন ভারতীয় পর্যটক। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। তবে ইসলামাবাদ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে
ভারতের হামলায় কী হয়েছিল?
গতকাল মধ্যরাতের পর ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে এক অভিযান চালায় পাকিস্তান ও পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে।
ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৯টি স্থানে হামলা চালানো হয়েছে, তবে কোনো পাকিস্তানি বেসামরিক, অর্থনৈতিক বা সামরিক স্থাপনায় আঘাত করা হয়নি। তাঁরা বলেন, ২৫ মিনিটের এই অভিযান দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর লস্কর-ই-তাইয়েবা এবং জইশ-ই-মুহাম্মদ ‘সন্ত্রাসবাদী অবকাঠামো’ লক্ষ্য করে চালানো হয়।
‘সিঁদুর’ নামটি সম্ভবত সেই লাল গুঁড়ার প্রতি ইঙ্গিত করে, যা অনেক হিন্দু বিবাহিত নারী কপালে পরেন। এপ্রিল মাসের পর্যটক হত্যাকাণ্ডে পুরুষদের নিশানা করা হয়েছিল, যাতে অনেক ভারতীয় নারী বিধবা হন।
তবে পাকিস্তান এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। তারা বলছে, বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং মসজিদে আঘাত লেগেছে। সিএনএন এখনো এসব দাবি যাচাই করতে পারেনি।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, ছয়টি স্থানে ২৪টি হামলা চালানো হয়েছে। এর মধ্যে কিছু হামলা পাকিস্তানের ঘনবসতিপূর্ণ পাঞ্জাব প্রদেশে হয়েছে। আর পাকিস্তান বলছে, ১৯৭১ সালের পর এটি পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের সবচেয়ে বড় হামলা।
পাকিস্তানের জবাব কী
পাকিস্তানি নিরাপত্তা সূত্র দাবি করেছে, তারা ভারতের পাঁচটি বিমান এবং একটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে।
ঠিক কোথায় বা কীভাবে বিমানগুলো ভূপাতিত হয়েছে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ অবশ্য তা বলেননি। তবে তাঁরা জানান যে এর মধ্যে তিনটি রাফাল জেট রয়েছে। রাফাল যুদ্ধবিমান ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সম্পদ। সেগুলো কয়েক বছর আগে ফ্রান্স থেকে কেনা হয়।
ভারত এখনো কোনো বিমান হারানোর কথা স্বীকার করেনি। সিএনএন এই দাবি যাচাই করতে পারেনি এবং ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর কাছে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করেছে।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী ও ভারতশাসিত কাশ্মীরের একজন স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, একটি অজ্ঞাত বিমান উইয়ান গ্রামে ভূপাতিত হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপি প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, একটি লাল ইটের বাড়ির পাশে একটি মাঠে বিমান ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। ছবি থেকে বিমানটি কার, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আজ বুধবার বলেছেন, দেশটির ‘প্রতিশোধ নেওয়ার পূর্ণ অধিকার’ রয়েছে এবং ভারতের পদক্ষেপকে ‘যুদ্ধের শামিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
হতাহতের সংখ্যা কত
ভারতের হামলায় অন্তত ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং ৪৬ জন আহত হয়েছেন বলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রয়টার্সকে জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী জানান, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে কিশোর ও শিশুও রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সীটি ছিল তিন বছর।
রয়টার্স ভারতশাসিত কাশ্মীরের পুলিশের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে সাতজন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হয়েছেন।
স্থলপথে সংঘাত কতটা হলো
ভারত ও পাকিস্তান—দুই পক্ষই কাশ্মীরকে বিভক্তকারী নিয়ন্ত্রণরেখা গোলাবর্ষণ ও গুলিবিনিময় করেছে।
ভারতশাসিত কাশ্মীরের কর্তৃপক্ষ জনগণকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে বলেছে। তারা জানিয়েছে, খাদ্য, ওষুধ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
এই হামলার কারণে বিমান চলাচল বিঘ্নিত হয়েছে, পাকিস্তান তার আকাশসীমার কিছু অংশ বন্ধ করে দিয়েছে। একাধিক আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনস পাকিস্তানের ওপর দিয়ে না উড়ে বিকল্প পথ নিচ্ছে, আর ভারতের কয়েকটি এয়ারলাইনস তাদের উত্তরাঞ্চলের বিমানবন্দর বন্ধ করে দিয়েছে।
কেন এই সংঘাত? কাশ্মীর কী?
মুসলিম-অধ্যুষিত কাশ্মীর অঞ্চল ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের একটি উত্তেজনাকর এলাকা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে স্বাধীনতা পাওয়ার পরপরই দুই দেশ কাশ্মীর দাবি করে এবং এর জন্য প্রথম যুদ্ধ করে।
এই বিভক্ত অঞ্চলটি এখন বিশ্বের অন্যতম সামরিকীকৃত এলাকা।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, পাকিস্তান সীমান্ত পার হয়ে হামলার জন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেয়, যা ইসলামাবাদ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে।
এপ্রিলের পেহেলগাম হত্যাকাণ্ডে ভারতে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দেয়। এই ক্ষোভ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
পেহেলগামের হামলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভারত ইসলামাবাদকে দায়ী করে। উভয় দেশ পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা নেয়। যেমন দুটি দেশ একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক কমিয়ে আনে, নাগরিকদের জন্য ভিসা বাতিল করে এবং ভারত একটি গুরুত্বপূর্ণ পানিবণ্টন চুক্তি থেকে সরে আসে।
এরপর কী হতে পারে
কাশ্মীর নিয়ে আগের তিনটি যুদ্ধই রক্তক্ষয়ী ছিল। ১৯৯৯ সালের সর্বশেষ যুদ্ধে পাকিস্তানের এক হাজারের বেশি সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। স্বল্প সময়ে সেটি একটি তীব্র সংঘাত ছিল।
এর পর থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ২০১৯ সালে ভারত একটি আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলার পর পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়।
তবে এসব সংঘর্ষ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেয়নি। উভয় দেশই এর ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন, ১৯৯৯ সালের পর থেকে দুই দেশই সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র।
বিশ্ব কী বলছে
এই হামলা আন্তর্জাতিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে এবং দুই দেশকে আরও সংঘর্ষ এড়াতে আহ্বান জানানো হচ্ছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ভারতের হামলা নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘বিশ্ব এমন সামরিক সংঘাত সহ্য করতে পারবে না।’
যুক্তরাষ্ট্র গত সপ্তাহেই উভয় পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছিল। সর্বশেষ হামলার পর জানিয়েছে যে তারা পরিস্থিতি ‘নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।’
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র গতকাল বলেছেন, ‘আমরা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। তবে এই মুহূর্তে আমাদের কোনো মূল্যায়ন নেই। এটি একটি ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতি এবং আমরা তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’
সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন ও জাপানও উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে।
ভারতের এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা সিএনএনকে জানিয়েছেন, নয়াদিল্লি যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে তাদের নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করেছে।