বহু নারীকে জীবনের কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের ভিড়ের মধ্যেই তাঁদের বেশির ভাগ সময় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। নারীদের মধ্যে কেউ হয়তো তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেছেন, কেউবা পরোক্ষভাবে উত্ত্যক্তকারীকে শাস্তি দিয়েছেন। অনেকে এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে বাঁচাতে নখ বড় রেখে চোখা করে কাটেন। কেউ বা আবার উত্ত্যক্তকারীর পা মাড়িয়ে দিতে হিল জুতা ব্যবহার করেন। আবার অনেকে ব্যবহার করেন সেফটি পিন।

১৮৪৯ সালে সেফটি পিন আবিষ্কৃত হয়। তখন থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী নারীরা কাপড়ের কয়েক পরতকে একসঙ্গে আটকে রাখতে, আবার কোনো পোশাক হঠাৎ ছিঁড়ে গেলে তাৎক্ষণিক সেফটি পিন আটকে সামলে নেন। সেই সেফটি পিনকে অনেক নারী নিজেদের সুরক্ষার ‘অস্ত্র’ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

কয়েক মাস আগে ভারতে কয়েকজন নারী টুইটারে নানা পোস্টে স্বীকার করতে শুরু করেন, তাঁরা সব সময় তাঁদের ব্যাগে বা গায়ের কাপড়ে সেফটি পিন রাখেন। ভিড়ের মধ্যে যৌন হয়রানির শিকার হলে পাল্টা জবাব দিতে এটাই তাঁদের ‘অস্ত্র’।

এমনই একজন নারী দীপিকা শেরগিল। তিনি এক পুরুষ উত্ত্যক্তকারীকে সেফটি পিন দিয়ে রক্তাক্ত করার অভিজ্ঞতা লিখে শেয়ার করেছিলেন। প্রতিদিন তিনি যে বাসে করে অফিসে যেতেন, সেই বাসে তিনি হয়রানির শিকার হতেন।

শেরগিল বলেন, কয়েক দশক আগের ঘটনা। কিন্তু তাঁর সব মনে আছে। তিনি বলেন, ‘তখন আমার বয়স ২০ বছর। আর উত্ত্যক্তকারী চল্লিশোর্ধ্ব। তিনি প্রতিদিন বাদামি রঙের সাফারি পরতেন। পায়ে থাকত আঙুলখোলা থাকে এমন জুতা। আর চামড়ার ব্যাগ। তিনি প্রতিদিন আমার পাশে এসে দাঁড়াতেন, ঝুঁকে থাকতেন। আমার পিঠে তার কুঁচকি ঘষতেন এবং প্রতিবার বাসচালক ব্রেক কসলে তিনি আমার গায়ে হেলে পড়তেন।’

ওই সময় শেরগিল ভিতু প্রকৃতির ছিলেন। তিনি চাননি ভিড়ের মধ্যে সবাই তাঁকে দেখুক। তাই মাসের পর মাস ওই নিপীড়ন তিনি সহ্য করেছেন। ‘কিন্তু একদিন ওই লোক সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ...সেদিন মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে।’

শেরগিল বলেন, ‘সেদিন আমার নিজেকে খুব নোংরা মনে হচ্ছিল। বাড়িতে ফিরে অনেকক্ষণ ধরে গোসল নিই। সেদিন আমার সঙ্গে কী হয়েছে, সেটা আমি আমার মাকেও বলতে পারিনি। সে রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। এমনকি, আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছিলাম। তারপরই আমি ভাবলাম, আগে ওই ব্যক্তিকে উপযুক্ত জবাব দিতে হবে। চাচ্ছিলাম তাকে মেরে শেষ করি, যাতে জীবনে আর কোনো মেয়ের সঙ্গে এমনটা করার সাহস না পায়।

পরদিন শেরগিল চটি না পরে হিল জুতা পরলেন এবং সেফটি পিন নিয়ে বাসে উঠলেন। যথারীতি ওই ব্যক্তি তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতেই তিনি (শেরগিল) উঠে দাঁড়িয়ে হিল দিয়ে তাঁর পা আচ্ছা করে মাড়িয়ে দেন। তাঁর চিৎকার দেখে বেশ আনন্দ লাগছিল। এরপর তাঁর বাহুতে সেফটি পিন ফুটিয়ে বাস থেকে নেমে যান। এরপরও তিনি ওই বাসে এক বছর আসা-যাওয়া করেছেন। কিন্তু ওই ব্যক্তিকে আর দেখেননি।

শেরগিলের ঘটনাটি খুবই কষ্টদায়ক, কিন্তু এমন ঘটনা বিরল নয়।

বিবিসির সাংবাদিক গীতা পাণ্ডের এক সহকর্মী তাঁকে বলেছিলেন, ৩০ বছর বয়সে একদিন রাতে বাসে কোচিন থেকে বেঙ্গালুরু যাচ্ছিলেন। তখন এক ব্যক্তি তাঁর হাত ধরতে চাচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমি তার হাত সরিয়ে দিই, ভেবেছিলাম দুর্ঘটনাবশত এটি হয়েছে। কিন্তু যখন আবারও একই কাজ করল, তখন বুঝতে পারলাম, ওই ব্যক্তি ইচ্ছা করে কাজটি করছে। সেদিন আমার স্কার্ফে থাকা সেফটি পিন আমাকে বাঁচিয়ে দেয়।’

ওই নারী বলেন, ‘সে বারবার হাত দেওয়ার চেষ্টা করছিল, আর আমি হাতে সেফটি পিন দিয়ে খোঁচা দিচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত লোকটি সরে যায়। কিন্তু কেন আমি তাকে কষে একটা চর মেরে প্রতিবাদ জানাতে পারলাম না, তা নিয়ে মনে মনে একটা আক্ষেপ কাজ করে।’

গীতার ওই সহকর্মী বলছিলেন, ‘তখন আমার বয়স কম ছিল। ভেবেছিলাম, আমি ঘুরে দাঁড়ালে আশপাশের লোকজন হয়তো আমাকে সমর্থন দেবে না।’

ভারতের নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, বেশির ভাগ নারী মনে করেন, ঠিক এই ভয় ও লজ্জায় নারীরা প্রতিবাদ করতে ভয় পান, আর শ্লীলতাহানিকারীরা উৎসাহিত হয়। এভাবে সমস্যাটি এত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।

২০২১ সালে ভারতের ১৪০টি নগরের নারীদের ওপর অনলাইনে একটি জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ নারী গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। অথচ তাঁদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে গেছেন। জরিপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগই বলেছেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিয়েছেন বা পরিস্থিতি আর বাড়তে না দিতে মুখ বুজে সহ্য করেছেন।

৫২ শতাংশের বেশি নারী বলেছেন, ‘নিরাপত্তাহীনতার কারণে’ তাঁরা লেখাপড়া বা কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।

নারীদের জন্য জনসমাগমের স্থান নিরাপদ ও নারীবান্ধব করতে প্রচার চালানো সামাজিক সংগঠন ‘সেফটি পিন’–এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা কল্পনা বিশ্বনাথ বলেন, যৌন সহিংসতার ভয় নারীদের মনে প্রকৃত সহিংসতার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে।

নারীরা নিজেদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে শুরু করেন। এবং নাগরিক হিসেবে পুরুষের সমান যে তার অধিকার আছে, তাঁদের সেই অধিকার কেউ মেনে নিতে চায় না।

বিশ্বনাথ বলেন, নারীদের যৌন হয়রানি শুধু ভারতে নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। টমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন যুক্তরাজ্যের শহর লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, মেক্সিকো সিটি, জাপানের টোকিও ও মিসরের কায়রোতে এক হাজার নারীর ওপর জরিপ চালায়। এতে উঠে আসে, ‘গণপরিবহন নেটওয়ার্ক যৌন নির্যাতনকারীদের জন্য দারুণ আকর্ষণীয়। যেখানে তারা নিজেদের এই বদ অভ্যাসকে আড়াল করতে এবং ধরা পড়লে অজুহাত দেখাতে ভিড়ের সময়টিকে বেছে নেয়।’

লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় নারীরা নিজেদের নিরাপত্তায় সেফটি পিন ব্যবহার করে বলে জানান বিশ্বনাথ। স্মিথসোনিয়ান সাময়িকীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে নারীরা হ্যাটপিন ব্যবহার করে থাকেন।

কিন্তু রাস্তাঘাটে হয়রানির মাপকাঠিতে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক জরিপে যৌন হয়রানির এই সমস্যা শীর্ষে থাকলেও ভারত এটিকে বড় সমস্যা মনে করছে বলে মনে হয় না।
গত কয়েক বছরে ভারতের কয়েকটি শহরে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। দিল্লিতে বাসে প্যানিক বাটন (ভয় পেলে বোতাম টেপা) ও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।

নারী বাসচালক রাখা হচ্ছে। নারীদের প্রতি সংবেদনশীল হতে চালক ও সুপারভাইজারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে অ্যাপ ও হেল্পলাইন চালু হয়েছে।

বিশ্বনাথ বলেন, ‘আমার মনে হয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমাধান হচ্ছে, এ নিয়ে আমাদের আরও বেশি কথা বলতে হবে। গণমাধ্যমে সমন্বিত প্রচার চালাতে হবে; যা মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দেবে কোনটা সঠিক আচরণ, কোনটি নয়।’