সেদিন কী হয়েছিল, বিবিসিকে বললেন মণিপুরের সেই দুই নারী

মণিপুরে জাতিগত সহিংসতার সময় ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়
ফাইল ছবি-এএনআই

মুখটা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন গ্লোরি ও মার্সি (ছদ্মনাম)। বড় কালো মাস্কে মুখ আর ওড়না দিয়ে কপাল ঢাকা। ভাইরাল ভিডিওতে থাকা কুকি-জোমি সম্প্রদায়ের এই দুই নারী যেন আজ আর এই মুখ দেখাতে চান না। কিন্তু তাঁরা চান, তাঁদের কথা মানুষ শুনুক। সেদিন কী হয়েছিল তাঁদের সঙ্গে, মানুষ জানুক।

এক মিনিটের কম সময়ের সেই ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল, সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়ের একদল পুরুষ গ্রামের রাস্তা দিয়ে দুই নারীকে বিবস্ত্র করে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের ধাক্কা দিচ্ছেন, যৌন নিগ্রহ করছেন এবং টেনে ধানখেতে নিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে তাঁদের দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয় বলে তাঁরা দাবি করেন।

ওই ঘটনার পর এই প্রথম ওই দুই নারী সরাসরি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দেন তাঁরা। গ্লোরি কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করা হয়েছে। এই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা কঠিন। এর দুই মাস পর যখন ওই ভিডিও ভাইরাল হলো, আমি তখন বেঁচে থাকার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।’

মার্সি বলেন, ‘আপনি তো জানেন ভারতীয় সমাজ কেমন, এ রকম একটা ঘটনার পর নারীদের কোন নজরে দেখা হয়। এখন আমি আমার সম্প্রদায়ের লোকদের চোখের দিকে তাকাতে পারি না। আমি সম্ভ্রম হারিয়েছি।’

ভাইরাল ভিডিওটি এই নারীদের কষ্ট অনেক বাড়িয়ে দিলেও এটি একটি অবিচারের প্রমাণ ও এর মধ্য দিয়ে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যকার সংঘর্ষের বিষয়টি সবার সামনে তুলে এনেছে। কিন্তু যখন ওই ভিডিওর কারণে ক্ষোভ সংঘর্ষ আরও বেড়ে যায়, তখন ওই নারীরা যেন আরও কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

গত মে মাসে মণিপুরে সহিংসতার সময় গ্লোরি শিক্ষার্থী ছিলেন। আর মার্সির দুই সন্তানের দেখভাল আর পড়াশোনা করাতেই সময় কেটে যেত। মাঝেমধ্যে গির্জায় যেতেন। কিন্তু এ ঘটনার (ভিডিও) পর এই দুই নারী নিজ শহর ছেড়ে অন্য শহরে ঠাঁই নিয়েছেন। পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন তাঁরা।

ঘর থেকে তেমন বের হন না। বাড়ির ভেতরেই হাঁটাচলা করেন। মার্সি এখন আর তেমন গির্জায় যান না, সন্তানদেরও স্কুলে নিয়ে যান না।

মার্সি বলেন, ‘আমার মনে হয় না, আগের মতো বাঁচতে পারব। বাড়ি বাইরে পা দেওয়া কঠিন হয়ে গেছে। লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে ভয় ও লজ্জা পাই।’ গ্লোরিরও একই অবস্থা। তাঁদের কাউন্সেলিং চলছে। তারপরও মনের ভেতরে ঘৃণা এবং ক্রোধের পাহাড় জমে আছে তাঁদের।

ছয় মাস আগেও কলেজে গ্লোরির মেইতেই সম্প্রদায়ের অনেক বন্ধু ছিল। কিন্তু এখন তিনি মেইতেই সম্প্রদায়ের একটি মানুষকেও দেখতে চান না। তিনি বলেন, ‘আর কোনো দিন নিজের গ্রামে ফিরব না। সেখানে আমি বড় হয়েছি, আমার বাড়ি। এখন সেখানে থাকা মানে প্রতিবেশী মেইতেই লোকজনের চেহারা দেখা। আমি আর তাঁদের মুখ দেখতে চাই না।’ গ্লোরি যখন কথাগুলো বলছিলেন, মার্সি তখন রাগে ক্ষোভে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলে জোরে জোরে চাপড়াচ্ছিলেন।

মে মাসে মণিপুরে শুরু হওয়া জাতিগত সহিংসতার সময় তাঁদের গ্রামে হামলা করা হয়। গ্লোরির বাবা ও ছোট ভাইকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি বলেন,‘চোখের সামনে তাঁদের মরতে দেখেছি।’ প্রাণে বাঁচতে বাবা-ভাইয়ের মরদেহ ফেলেই তাঁকে পালাতে হয়েছিল।

সহিংসতা শুরুর পর মেইতেই এবং কুকি সম্প্রদায় একে অন্যের এলাকায় পা রাখতে পারেন না। মণিপুর দুটি অংশে বিভক্ত। মাঝখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং উভয় সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের তৈরি চেক পয়েন্ট।

বাবা আর ভাইকে হারানোর প্রসঙ্গে গ্লোরি বলেন, ‘আমি জানি না, তাঁদের মরদেহ কোথায় রাখা হয়েছে। নিজে গিয়ে যে খোঁজ নেব, সেটাও সম্ভব নয়। সরকারের উচিত, ওদের মরদেহ আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া।’

মার্সির স্বামী সে সময় কীভাবে বাড়িঘরে, গির্জায় হামলা ও আগুন দেওয়া হয়েছে, সেই বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘আমি স্থানীয় পুলিশকে ফোন করেছিলাম। কিন্তু তারা বলল, থানায়ও হামলা হয়েছে, তাই তারা সাহায্য করতে পারবে না। আমি রাস্তায় একটি পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, কিন্তু তারাও কিছু করেনি।’

মার্সির স্বামী বলেন, ‘আমি কিছুই করতে পারিনি এটা ভেবে আমার খুব রাগ হয়, খারাপ লাগে। আমি আমার স্ত্রী বা গ্রামবাসীর কাউকেই বাঁচাতে পারিনি। এসব ভেবে খুব খারাপ লাগে। মনে হয়, কাউকে শেষ করে ফেলি।’

মার্সির স্বামী বলছেন, হামলার দুই সপ্তাহ পরেই তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, তবে ভিডিওটি প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। পুলিশের সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, ওই ঘটনায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ মোট পাঁচ পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।

গ্লোরি, মার্সি ও তাঁর স্বামী বিবিসিকে বলেন, ভিডিওটি সামনে আসার পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাঠানো মানুষের ইতিবাচক বার্তা তাঁদের সাহস জুগিয়েছে। মার্সির স্বামী বলেন, ‘ভিডিও ছাড়া কেউ সত্যিটা বিশ্বাস করত না, আমাদের কষ্টটা বুঝত না।’

মার্সি এখনো দুঃস্বপ্ন দেখেন। ভবিষ্যতের কথা ভাবতে, বিশেষ করে সন্তানদের জন্য ভয় পান। তিনি বলেন, ‘সন্তানদের দিয়ে যাওয়ার কিছুই অবশিষ্ট নেই, এটা ভেবে দুশ্চিন্তা হয়।’
আর কোনো নারীর সঙ্গে যেন এমন না হয়, সে কথা ভেবে তাঁরা মনে করেন কথা বলা উচিত। গ্লোরি বলেন, তিনি তাঁদের সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক প্রশাসন চান। নিরাপদে ও শান্তিতে বাঁচার এটিই একমাত্র পথ।

এই বিতর্কিত দাবিটি কুকি সম্প্রদায় একাধিকবার উত্থাপন করেছে এবং মেইতেই সম্প্রদায় তার বিরোধিতা করেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বারবার ঐক্যবদ্ধ মণিপুর গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন।

রাজ্য সরকারের ওপর গ্লোরি ও মার্সির তেমন আস্থা নেই। এমনকি এই সরকারের অবস্থান তাঁদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বলেও অভিযোগ করেন। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বিবিসি যোগাযোগ করলে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং সাড়া দেননি। তবে সম্প্রতি দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার তিনি বলেন, ‘আমার হৃদয়ে বা আমার কাজে কোনো ধরনের বৈষম্য নেই।’

ভিডিওটি যখন ভাইরাল হয়, তখন সুপ্রিম কোর্ট সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিষয়টি আমলে নিয়ে এ ঘটনায় করা সব মামলা স্বাধীন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো, যেমন সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (সিবিআই) কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে মরদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে বলেছেন।

গ্লোরি ভবিষ্যতে অন্য কলেজে পড়াশোনা শুরু করতে চান। যাতে পুলিশ বা সেনাসদস্য হওয়ার নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘নিরপেক্ষভাবে সবার জন্য কাজ করতে আমার সংকল্প দৃঢ় হয়েছে। আমি যেকোনো মূল্যে ন্যায়বিচার চাই। আজ আমি এ জন্যই কথা বলছি, যাতে আমার মতো অন্য কোনো নারীকে এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে না হয়।’

মার্সি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা আদিবাসী নারীরা খুব শক্ত। আমরা হাল ছেড়ে দেব না।’

সাক্ষাৎকার শেষে এই প্রতিবেদক যখন বিদায় নিতে ওঠে দাঁড়ান, তখন মার্সি বলেন, তাঁর একটি বার্তা আছে। তিনি বলেন, ‘আমি সব সম্প্রদায়ের মায়েদের উদ্দেশে বলতে চাই, যত কিছুই হোক না কেন নারীদের যেন কখনো অসম্মান না করে, সন্তানদের সেই শিক্ষা দিতে হবে।’