মোদির তৃতীয় মেয়াদে এক বছরেই ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধ, নিশানা মুসলিমসহ সংখ্যালঘুরা

কোনো আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। উত্তর প্রদেশ, ২০২২ফাইল ছবি–রয়টার্স

ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ (হেট ক্রাইম) বেড়েই চলেছে। শুধু মুসলিম ও খ্রিষ্টান নয়, ঘৃণা অপরাধ বেড়ে গেছে দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শাসনের প্রথম বছরে এ ধরনের অপরাধের হার মারাত্মকভাবে বেড়েছে। মানবাধিকার রক্ষা সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস (এপিসিআর)’–এর সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে এ প্রবণতার চিত্র উঠে এসেছে।

মোদি সরকারের তৃতীয় দফার শাসনের প্রথম বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি, সেসব ঘটনায় রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মদদ, তাদের উৎসাহদান এবং সামাজিক–রাজনৈতিক আদর্শগত পরিবর্তনগুলো এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় দফার শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে ২০২৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণ, বাকি ৬০২টি ঘৃণা অপরাধ, যাতে হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘুদের জানমালের ওপর সরাসরি ভয়ানক আক্রমণ করেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ৬০২ ঘৃণা অপরাধের ঘটনার মধ্যে ১৭৩টিতে সংখ্যালঘুরা শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২৫টি ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিহত হয়েছেন। তাঁদের সবাই মুসলিম। এই এক বছরে ঘৃণা অপরাধে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ জন হিন্দুও আছেন। অবশ্য তাঁরা আক্রমণের মূল নিশানা ছিলেন না। ঘটনাস্থলে থাকার কারণে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের মধ্যে নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি।

এপিসিআর সংগঠনটি তৈরি হয়েছিল ২০০৬ সালে। তাদের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ভারতে দিন দিন ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধ বাড়লেও এবং তাতে প্রধানত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এসব অপরাধ রেকর্ড বা নথিভুক্ত করার কোনো পদ্ধতিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা নেই। দলিত হিন্দুদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও অপরাধ নথিভুক্ত করা হয় ১৯৮৯ সালের তফসিল জাতি ও উপজাতি (অত্যাচার নিরোধ) আইন মোতাবেক। এ আইনে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার বিশেষ বিধান রয়েছে; কিন্তু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ মোকাবিলায় এ ধরনের কোনো আইনি ব্যবস্থা এখনো তৈরি করা হয়নি।

জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, সামাজিক পরিচয়ের দরুন কোনো ব্যক্তি যখন আক্রান্ত হন, তাঁর জীবন বিপন্ন ও সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তা ঘৃণা অপরাধের আওতায় পড়ে। ঘৃণা ভাষণ মানুষকে হিংসাত্মক করে তোলে। সামাজিক শান্তি ও সম্প্রীতি নষ্ট করে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ঘৃণা ভাষণ হলো সেই সব আপত্তিকর কথা, যার লক্ষ্য ব্যক্তির সামাজিক ও ধর্মীয় পরিচয়।

মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধের প্রতিবাদে ভারতে বিক্ষোভ। ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, নয়াদিল্লি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

এপিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সারা দেশে যে ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের প্রমাণ পাওয়া গেছে, সেসব ভাষণের ১৭৮টিই দিয়েছেন শাসক দল বিজেপির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু তা–ই নয়, ঘৃণা অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটেছে বিজেপি–শাসিত রাজ্যগুলোতে। ঘৃণা ভাষণ ও অপরাধের প্রবণতাও এসব রাজ্যে বেশি। আরও দেখা গেছে, যে রাজ্যে নির্বাচন হচ্ছে, সেখানে নির্বাচনী প্রচারে ঘৃণা ভাষণ বেশি হচ্ছে। লোকসভা বা বিধানসভা ভোটেই শুধু নয়, স্থানীয় নির্বাচনেও ঘৃণা ভাষণ ও অপরাধের ঘটনা ঘটছে। এক বছরের এই সময়কালে উত্তরাখন্ডের পৌরসভার কাউন্সিলর নির্বাচন তার প্রমাণ।

এই প্রতিবেদনে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীরা ঘৃণা ভাষণ দিচ্ছেন। শুধু দিয়েই ক্ষান্ত নন তাঁরা, ঘৃণা অপরাধ ও অপরাধীদের সমর্থন ও মদদ দিচ্ছেন।

এক বছরের ঘটনাবলির বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের মধ্যে ১৭৮টি দিয়েছেন বিজেপি দলের সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে পাঁচটি ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন। ৬৩টি ভাষণ দিয়েছেন বিজেপির বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রীরা, ৭১টি ভাষণ দিয়েছেন অন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা। সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য, দুজন বিচারপতি এবং একজন রাজ্যপালও ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন।

শুধু এপিসিআরের প্রতিবেদনই নয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয় ছিল ঘৃণা ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা বারবার প্রান্তিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য, শত্রুতা ও হিংসা উদ্রেক করার মতো ভাষণ দিয়েছেন।

সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজে ১১০টি নির্বাচনী ভাষণে ইসলামবিরোধী বক্তব্য পেশ করেছিলেন। এপিসিআরের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিজেপি নেতাদের ঘৃণা ভাষণ সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর হিংসাত্মক হয়ে ওঠার বড় কারণ। গত এক বছরের ৩৪৫টি ঘৃণা ভাষণের মধ্যে বিজেপি নেতাদের ১৭৮টি ছাড়া বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) ও বজরং দলের নেতারা দিয়েছেন যথাক্রমে ২১ ও ২০টি।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ৭ জুন থেকে চলতি বছরের ৭ জুন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ৯৪৭টি ঘৃণা অপরাধের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিজেপি–শাসিত উত্তর প্রদেশ। শুধু এই রাজ্যেই ঘটেছে ২১৭টি ঘৃণা অপরাধের ঘটনা। বিজেপি–শাসিত মহারাষ্ট্র (১০১) সেই তালিকায় দ্বিতীয়। তৃতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ (১০০), চতুর্থ স্থানে উত্তরাখন্ড (৮৪)। এ ছাড়া বিজেপিশাসিত রাজস্থান (৬০), বিহার (৩৬), গুজরাট (২৩), হরিয়ানা (২৩), আসাম (২০) উল্লেখযোগ্য।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দিল্লিতে এমন ঘটনা ঘটেছে ৪২টি ও ঝাড়খন্ডে ৫২টি। রাজনৈতিক ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধের ঘটনা সবচেয়ে কম ঘটেছে মণিপুরে (১), কাশ্মীরে (১), কেরালায় (২), তামিলনাড়ুতে (২), অন্ধ্র প্রদেশে (৩) এবং গোয়াতে (৩), কংগ্রেসশাসিত হিমাচল প্রদেশে (৩১), কর্ণাটকে (৩১), তৃণমূল কংগ্রেস–শাসিত পশ্চিমবঙ্গে (১৮) তুলনামূলকভাবে কম হলেও ঘৃণা ভাষণ ও ঘৃণা অপরাধপ্রবণতামুক্ত নয়।

এপিসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলা ও তারপর ভারত–পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অপরাধ বেড়ে যায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত ঘৃণা অপরাধের আধিক্য দেখা দেয়, যদিও ঘৃণা ভাষণ বন্ধ হয় গত ১ জুন। এ সময়ের মধ্যে দেশে ৮৭টি ঘৃণা অপরাধ ঘটে, যার মধ্যে ৫১টি সরাসরি পেহেলগামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল। এ সময়ের মধ্যে ১৩৬ জন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।

ঘৃণা ভাষণ ও অপরাধের জন্য বিভিন্ন হিন্দুধর্মীয় উৎসবকে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা এই প্রতিবেদনের আরেক উল্লেখযোগ্য দিক। বলা হয়েছে, গণেশ চতুর্থী, নবরাত্রি, রাম নবমী এবং দোল উৎসবকে সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছড়ানো ও ঘৃণা অপরাধ সংঘটিত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে, রাজনৈতিক বক্তব্য, সংবাদমাধ্যমে প্রচার এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক হয়ে ওঠার কাজে ব্যবহার করেছে। পুলিশ কতটা নিষ্ক্রিয় তার প্রমাণ হিসেবে বলা হয়েছে, ৬০২ ঘৃণা অপরাধের মধ্যে এফআইআর দাখিল হয়েছে মাত্র ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে।

‘বাংলাদেশি’ দাবি তুলে ভারতে প্রায় দুই হাজার মুসলিম পরিবারের বস্তিঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে সরকার। ২০২৫, গুজরাট
ফাইল ছবি: এএফপি

প্রতিবেদনে বলা হয়, মধ্য প্রদেশের জব্বলপুরে এক খ্রিষ্টান পাদরি থানায় সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন; কিন্তু সেখানেই তিনি বজরং দলের নেতা–কর্মীদের হাতে নিগৃহীত হন। একইভাবে নবরাত্রির সময়ে দেখা গেছে, বহু স্থানে পুলিশের লোকজন অতিথিদের পরিচয়পত্র দেখতে হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্য করছে। উদ্দেশ্য, মুসলিমরা যাতে অনুষ্ঠানে না থাকেন।  

আরএসএস ও বিজেপি বরাবর বলে এসেছে, হিন্দুত্ব হলো ভারতীয়দের জীবনশৈলী; কিন্তু নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক ক্ষমতাপ্রাপ্তি সেই ধারণা ও বিশ্বাসের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। শাসক দলের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের আচরণ দেশকে এক বিপজ্জনক খাদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এই প্রতিবেদন তারই প্রতিচ্ছবি।

গত এক বছরের ঘটনা দেখাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদ স্রেফ মতাদর্শ নয়, জীবনশৈলী নয়, সেটিই হয়ে উঠেছে দেশ শাসনের কাঠামো, যার প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্দিষ্ট হয়ে গেছেন সংখ্যালঘু, দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ।