আংশিকার মৃত্যুর কারণ কি যৌতুক, শ্বশুরবাড়িতে আগুন দিল কারা

অংশু কেসারওয়ানি ও তাঁর স্ত্রী আংশিকা কেসারওয়ানির বিয়ে হয়েছিল ধুমধাম করে। বিয়ের এক বছর পর শ্বশুরবাড়ি থেকে আংশিকার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়ছবি: বিবিসি এশিয়ার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

ভারতের প্রয়াগরাজে সম্প্রতি দুটি পরিবারে ভয়ংকর এক ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। কারাগারে গেছেন সাতজন।

ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৮ মার্চ রাতে, ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় শহর প্রয়াগরাজে (সাবেক এলাহাবাদ)। ঘটনার প্রভাব শুধু মধ্যবিত্ত দুটি পরিবারের ওপর পড়েনি। এলাকার অন্য বাসিন্দারাও এতে মর্মাহত হয়েছেন।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে শিবানী কেসারওয়ানি নামের এক নারী বিবিসিকে বলেন, ‘রাত ১১টার দিকে প্রায় ৬০-৭০ জন মানুষ আমাদের বাড়িতে জড়ো হয়েছিলেন। তাঁরা নির্দয়ভাবে আমাদের মারতে শুরু করেন।’

শিবানীদের বাড়ি থেকে তাঁর ভাই অংশুর স্ত্রী আংশিকার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারের পর এই হামলা হয়েছিল। শিবানী ও তাঁর পরিবারের অভিযোগ, হামলাকারীরা আংশিকার পরিবারের সদস্য ও স্বজন। আর আংশিকার পরিবারের অভিযোগ, হত্যার পর আংশিকার মরদেহ ঝুলিয়ে রেখেছিল শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ১৬ লাখ রুপি দিয়ে গাড়ি দেওয়ার পরও যৌতুকের জন্য আংশিকাকে নির্যাতন করা হতো বলেও অভিযোগ তাঁদের।

শিবানীর দাবি, আংশিকা আত্মহত্যা করেছেন। পুলিশও তেমনটাই বলছে।

কী ঘটেছিল

কেসারওয়ানিদের পারিবারিক কাঠের ব্যবসা আছে। তারা যৌথ পরিবারে থাকত। ভবনের নিচতলা এবং বেজমেন্টে দোকান ও গুদাম ছিল। পরিবারটি থাকত ওপর দিকের তলায়। প্রতিটি তলায় একটি করে শয়নকক্ষ। অংশুর এক বছর আগে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ভবনের সবচেয়ে ওপরের তলায় থাকতেন। তাঁর মা-বাবা দ্বিতীয় তলায় এবং বোন শিবানী তৃতীয় তলায় থাকতেন।

শিবানী বিবিসিকে বলেন, ‘সাধারণত রাত আটটার দিকে আংশিকা খেতে নামতেন। তবে সেদিন তাঁকে দেখা যায়নি। আমরা ভেবেছিলাম তিনি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন।’

শিবানী বলেন, ‘সেদিন তাঁর ভাই রাত ১০টায় দোকান থেকে ফিরেছিলেন। এরপর তিনি তাঁর স্ত্রীকে খাওয়ার জন্য ডাকতে যান। কিন্তু দরজায় কড়া নেড়ে এবং ফোনে কল দিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তিনি দরজার ওপরের দিকে থাকা কাচের দেয়াল ভেঙে ছিটকিনি খোলেন এবং আংশিকাকে মৃত অবস্থায় পান। তিনি চিৎকার করতে থাকেন। আমরা সবাই তাঁর চিৎকার শুনে দ্রুত ওপরের তলায় উঠি।’

অংশু এবং তাঁর চাচা পুলিশ স্টেশনে আংশিকার মৃত্যুর খবর জানিয়েছিলেন। তাঁদের বাড়ি থেকে পুলিশ স্টেশনের দূরত্ব আধা কিলোমিটারেরও কম। আংশিকার মা-বাবাকেও তাঁর মৃত্যুর খবর জানানো হয়।

পুলিশ বলছে, এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আংশিকার পরিবারের সদস্যরা অংশুদের বাড়িতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন আত্মীয়স্বজনও ছিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি ও মারামারি শুরু হয়।

শিবানী তাঁর মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিওগুলো বিবিসির প্রতিনিধিদের দেখান। সেখানে দেখা গেছে, লোকজন চিৎকার করছেন এবং একে অপরকে লাঠি দিয়ে আঘাত করছেন। এক পুলিশ সদস্য মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাঁদের থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন।

আংশিকার পরিবারের ১২ জন সদস্য এবং ৬০-৭০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন শিবানী কেসারওয়ানি
ছবি: বিবিসি এশিয়ার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

পুলিশ বলেছে, ওই বাড়ি থেকে আংশিকার মরদেহ বের করে আনার পর তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেন।

নিচতলা ও বেজমেন্টে সংরক্ষণ করে রাখা কাঠগুলো জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়। শিবানী, তাঁর মা-বাবা এবং চাচি বাড়িতে আটকা পড়েন।

শিবানী ও তাঁর চাচি তৃতীয় তলার জানালা ভেঙে পাশের লাগোয়া বাড়িতে নিরাপদে সরে পড়েন। বাড়িটি তাঁর চাচার। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের আগুন নেভাতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। আগুন নেভার পর রাত তিনটার দিকে তাঁরা ওই বাড়িতে ঢোকেন। সেখান থেকে শিবানীর মা-বাবার পুড়ে যাওয়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

শিবানী চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমার মায়ের মরদেহ সিঁড়িতে বসা অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাঁর মরদেহ বস্তায় ভরে হিমঘরে নেওয়া হয়।’

আংশিকার পরিবারের ১২ জন সদস্য এবং ৬০-৭০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন শিবানী।

এক পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, আংশিকার বাবা, চাচা এবং তাঁদের ছেলেরাসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা কারাগারে আছেন।

আংশিকার বাবাও পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগ করেছেন, অংশু, তাঁর মা-বাবা এবং বোনেরা তাঁর মেয়েকে যৌতুকের জন্য হয়রানি এবং হত্যা করেছেন।

শিবানী তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন বিয়েতে আংশিকার পরিবারের কাছ থেকে একটি গাড়িসহ বিভিন্ন উপহার তাঁরা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তাঁরা মেয়েকে যা দিতে চেয়েছেন, তা–ই দিয়েছেন। আমরা কোনো কিছু চাইনি।’

স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে অংশু গা ঢাকা দিয়েছেন। শিবানীর দাবি, প্রাণের ভয়ে তাঁর ভাই পালিয়ে আছেন। কারণ, আংশিকার বেশির ভাগ আত্মীয়স্বজনই কারাগারের বাইরে আছেন।

ভারতে যৌতুকের যত ঘটনা

১৯৬১ সাল থেকে ভারতে যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশটিতে এখনো ৯০ শতাংশ বিয়েতে যৌতুক আদান-প্রদানের ঘটনা ঘটে।

প্রতিবছর পুলিশের কাছে স্ত্রীকে হয়রানির হাজার হাজার অভিযোগ দায়ের হয়। অপরাধসংক্রান্ত নথিতে দেখা গেছে, পর্যাপ্ত যৌতুক না আনতে পারায় ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে ৩৫ হাজার ৪৯৩ জন কনেকে হত্যা করা হয়েছে।

তবে যৌতুকের কারণে হত্যার অভিযোগ তুলে এমন প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনার কথা ভারতে শোনা যায়নি।

শিবানী বলেন, ‘আমি ন্যায়বিচার চাই। আমার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার বাড়ি, পরিবার শেষ হয়ে গেছে। আমি অবাধ ও স্বচ্ছ তদন্ত চাই। যাঁরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাঁদের সবার সাজা নিশ্চিত করতে হবে। কেন তাঁরা বাড়িতে আগুন দিলেন? এখন আমরা কোনো আলামত কীভাবে খুঁজে পাব?’

তিনি পুলিশের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ জানিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, সেদিন তাঁদের বাড়ির বাইরে অন্তত ২৪ জন পুলিশ সদস্য থাকলেও তাঁরা কোনো ব্যবস্থা নেননি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন তাঁরা।

তবে পুলিশ শিবানীর অভিযোগ মানতে নারাজ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জ্যেষ্ঠ এক পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, তাঁরা বাড়ির ভেতর থেকে মরদেহ সরাতে এবং তা ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কারও ধারণা ছিল না যে বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে।

শিবানীদের বাড়িটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে
ছবি: বিবিসি এশিয়ার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

আংশিকার পরিবার কী বলছে

ভয়াবহ ঘটনাটি আংশিকার পরিবারকেও ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। বিবিসির প্রতিনিধিদল আংশিকার মা-বাবার বাড়িতে গিয়েছিল। বিয়ের আগে আংশিকা সেখানেই থাকতেন। বাড়ির প্রধান ফটকে দেখা গেল, বড় একটি তালা ঝুলছে।

আংশিকার বাড়ি থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে তাঁর চাচার বাড়ি। তিনি এবং তাঁর ছেলেরাও গ্রেপ্তার হয়েছেন। পরিবারটি গণমাধ্যমে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।

দরজায় কড়া নাড়তেই আংশিকার দাদা জওহর লাল কেসারওয়ানি বের হয়ে আসেন। বয়স ৯০-এর কোঠায়। তাঁর এক নাতি প্লাস্টিকের একটি চেয়ার নিয়ে আসেন। তিনি সেখানে বসেন। তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।

কয়েক মিনিট থেমে থাকার পর জওহর লাল কেসারওয়ানি বলেন, ‘আপনাদের কী বলব? আমার পুরো পরিবার, সন্তান, নাতিরা কারাগারে আছেন। তাঁরা আংশিকাকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রেখেছিল, যেন তা দেখে আত্মহত্যা বলে মনে হয়।’

জওহর লাল কেসারওয়ানি আরও বলেন, আংশিকার বিয়ে হয়েছিল ধুমধাম করে। বিয়েতে ৫০ লাখ রুপি খরচ হয়েছিল। বাড়ির প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাঁকে দেওয়া হয়েছে। ১৬ লাখ রুপি দিয়ে একটি গাড়ি কিনে দেওয়া হয়েছিল।

সবশেষে গত ফেব্রুয়ারিতে আংশিকা নিজ বাড়িতে গিয়েছিলেন। জওহর লাল কেসারওয়ানি সে কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ও আমাদের বলেছিল যে তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা তাকে চুপচাপ থাকতে বলেছিলাম, মানিয়ে নিতে বলেছিলাম। আমরা বলেছিলাম সব ঠিক হয়ে যাবে।’

স্থানীয়ভাবে কেসারওয়ানি পরিবারটির বেশ সুনাম আছে। তারা আন্তরিক, বন্ধুসুলভ এবং উপকারী হিসেবে পরিচিত। পরিবারটির এমন বিপদের কথা শুনে তাঁরা মর্মাহত।

তাঁদের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘তারা অত্যন্ত ভালো মানুষ। কীভাবে এমনটা হলো, তা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। তারা বিবাদে জড়ানোর মতো মানুষ না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি না কে আগুন দিয়েছে। তবে মেয়ের মৃতদেহ দেখে যে কারোরই মেজাজ ধরে রাখা কঠিন।’

আরেক প্রতিবেশী বলেন, ‘আংশিকা খুবই সদাচারী, মায়াবী মেয়ে ছিল। তার পরিবারও সাদাসিধা ছিল।’ ওই নারীর মতে, আংশিকার পরিবারের বিরুদ্ধে যে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা তারা করতে পারে না।

তিনি বলেন, ‘তার শ্বশুর-শাশুড়ি আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক। তবে আমার অত্যন্ত আক্ষেপের জায়গা হলো, আংশিকার কী হয়েছিল, তা নিয়ে এখন আর কেউ কথা বলছে না। কীভাবে সে মারা গেল?’