গ্রামের কিশোর থেকে আন্তর্জাতিক গ্যাং লিডার—জেলে বসেও নিয়ন্ত্রণ করেন অন্ধকার জগৎ

নয়াদিল্লির একটি আদালতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিবেষ্টিত লরেন্স বিষ্ণোই। ১৮ এপ্রিল ২০২৩ছবি: রয়টার্স

ভারতের উচ্চ নিরাপত্তার একটি কারাগারের সেল থেকেই লরেন্স বিষ্ণোই তাঁর সাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন বলে জানা গেছে।

বিষ্ণোইয়ের ‘রাজদণ্ড’ হলো একটি মুঠোফোন ও রাজসিংহাসন হলো কংক্রিটের বাক্স। এই স্মার্টফোনও তাঁর হাতে গেছে গোপনে পাচার হয়ে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, এখান থেকেই ৩২ বছর বয়সী এই গ্যাং লিডার এক বলিউড সুপারস্টারকে হুমকি দিয়েছেন, এক পপ তারকাকে হত্যা করিয়েছেন এবং বিশ্বের অন্য প্রান্তে একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সাজিয়েছেন।

উজ্জ্বল ত্বক, ঘন গোঁফ ও শান্ত দৃষ্টির বিষ্ণোইয়ের বিরুদ্ধে ভারতের শীর্ষ তদন্ত সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) বহু বছর ধরে অভিযোগ করছে যে তিনি কারাগারের ভেতর থেকে সাত শতাধিক সদস্যের এক ভয়ংকর গ্যাং (সন্ত্রাসী চক্র) নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে হত্যা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার মতো অনেক অভিযোগ রয়েছে।

গত মাসে বিষ্ণোই কানাডায় একটি চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংস্থার মুখচ্ছবি হয়ে ওঠেন। এর আগে দেশটির সরকার অভিযোগ করে, ভারত বিষ্ণোই গ্যাংকে ব্যবহার করে কানাডার মাটিতে শিখ ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করছে।

কানাডার এ সিদ্ধান্ত বিষ্ণোইকে ভারতের এক সুপরিচিত মাফিয়াপ্রধান থেকে আন্তর্জাতিকভাবে তাড়া করে ফেরা একজন শীর্ষ গ্যাং নেতায় পরিণত করেছে।

কানাডার জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী গ্যারি আনান্দাসাঙ্গারি গত সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘বিষ্ণোই গ্যাং নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে সন্ত্রাস, সহিংসতা ও ভয় দেখানোর লক্ষ্য করেছে। এ অপরাধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়টি তাদের অপরাধ মোকাবিলা করা ও থামানোর ক্ষেত্রে আমাদের আরও শক্তিশালী ও কার্যকর হাতিয়ার এনে দেবে।’

গত মাসে বিষ্ণোই কানাডায় একটি চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংস্থার মুখচ্ছবি হয়ে ওঠেন। এর আগে দেশটির সরকার অভিযোগ করে, ভারত বিষ্ণোই গ্যাংকে ব্যবহার করে কানাডার মাটিতে শিখ ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করছে।

বিষ্ণোই তাঁর বিরুদ্ধে আনা অনেক অভিযোগই অস্বীকার করেন এবং তাঁর আইনজীবী সিএনএনকে বলেছেন যে কানাডার সর্বশেষ অভিযোগগুলো তাঁদের তদন্ত করতে হবে।

সিএনএন পশ্চিম ভারতের গুজরাটে সবরমতী কারাগারে যোগাযোগ করেছে। বিষ্ণোই এখানেই বন্দী, তবে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

কয়েক বছরের তিক্ত সম্পর্কের পর দুই দেশ যখন সম্পর্ক ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছে, তখন কানাডার মন্ত্রী ওই বিবৃতি দিলেন। নয়াদিল্লি কানডার এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি।

গ্রামের ছেলে থেকে গ্যাং লিডার

বিষ্ণোইয়ের গল্প গোপন অন্ধকার জগতের বস্তিতে শুরু হয়নি। এটি শুরু হয় ভারতের ‘রুটির ঝুড়ি’ নামে পরিচিত পাঞ্জাব রাজ্যের উর্বর মাঠ থেকে, যেখানে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও স্থানীয় নানা গর্বের অনুভূতি আছে। তবে রাজ্যটি তরুণদের বেকারত্ব ও ব্যাপক গ্যাং সহিংসতায়ও আক্রান্ত।

সে খুব ভালো ছেলে ছিল এবং স্বভাবও ছিল ভালো। গ্রামের কারও কাছে গেলে, কেউ তাঁর সম্পর্কে খারাপ কিছু বলবে না…আমি বিশ্বাস করি না যে সে গ্যাংস্টার।

এ রাজ্যের ছোট একটি গ্রামের প্রাক্তন এই ছাত্র আন্দোলনকারী নিজেকে আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্রের কথিত পরিকল্পনাকারীর ভূমিকায় রূপান্তর করেন।

বিশ্ব তাঁকে লরেন্স বিষ্ণোই নামে চেনার আগে, তিনি ছিলেস বালকরন ব্রার। তাঁর জগৎ সীমাবদ্ধ ছিল দুতারাওয়ালির ধুলামাখা ছোট গ্রামীণ পথে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, এ গ্রামে মাত্র তিন হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করতেন।

ভারতের রাজধানী থেকে প্রায় সাত ঘণ্টা দূরত্বে এবং পাকিস্তান সীমান্ত থেকে প্রায় এক ঘণ্টা দূরে, এটি এমন একটি স্থান, যেখানে মানুষের জীবন ঘোরে ফসলের চারপাশে। সেখানে বিষ্ণোইকে মধ্যবিত্ত জীবনের জন্য উপযুক্ত বলেই মনে হচ্ছিল। হরিয়ানা পুলিশের একজন কনস্টেবলের ছেলে হিসেবে সাদামাটা এক স্কুলে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। তাঁকে নিয়ে ছিল মায়ের বড় স্বপ্ন।

তাঁর নিজ গ্রামেই সবচেয়ে বেশি বোঝা যায়, শিশুকালের বিষ্ণোই আর গ্যাং লিডার বিষ্ণোই যেন একেবারে দুই ভিন্ন মানুষ। গ্রামের মানুষ এখনো এ দুই রূপকে মেলাতে পারেন না।

বিষ্ণোই শিক্ষিত ও ‘খুব ভালো পরিবারের’ সদস্য—বলেছেন সাংবাদিক ও ‘হু কিল্ড মুসেওয়ালা?’ বইয়ের লেখক জুপিন্দারজিৎ সিং। বিষ্ণোই গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে ওঠা সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগের একটি—পাঞ্জাবি র‌্যাপার সিধু মুসেওয়ালার হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে বইটি লেখা হয়েছে।

লরেন্স বিষ্ণোই নামটি একজন হিন্দু ছেলের জন্য ‘অসাধারণ’, উল্লেখ করেছেন জুপিন্দারজিৎ সিং। তিনি বলেন, এটি তাঁর মায়ের দেওয়া নাম। স্যার হেনরি লরেন্সকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ছেলের ওই নাম দিয়েছিলেন তিনি। হেনরি লরেন্স পাঞ্জাবের প্রথম ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসক ছিলেন। বিষ্ণোইও খুব ফর্সা ত্বক নিয়ে জন্মেছিলেন।

তাঁর নিজ গ্রামেই সবচেয়ে বেশি বোঝা যায়, শিশুকালের বিষ্ণোই আর গ্যাং লিডার বিষ্ণোই যেন একেবারে দুই ভিন্ন মানুষ। গ্রামের মানুষ এখনো এ দুই রূপকে মেলাতে পারেন না।

বিষ্ণোই নিজেকে ঈশ্বরভক্ত ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ হিসেবে দেখাতে চান। বিষ্ণোই দাবি করেন, তিনি নেশা থেকে দূরে থাকেন ও প্রার্থনায় মনোযোগী।
—জুপিন্দারজিৎ সিং, সাংবাদিক ও লেখক

‘সে খুব ভালো ছেলে ছিল এবং স্বভাবও ছিল ভালো’, গত বছর দুতারাওয়ালির এক বাসিন্দা সিএনএন নিউজ ১৮–কে এক সাক্ষাৎকারে বলেন। ‘গ্রামের কারও কাছে গেলে, কেউ তাঁর সম্পর্কে খারাপ কিছু বলবে না…আমি বিশ্বাস করি না যে সে গ্যাংস্টার।’

অন্য একজন সিএনএন নিউজ ১৮-কে বললেন, ‘বিষ্ণোই গ্রামে কখনো কাউকে খারাপ কথা বলেনি। সে সবাইকে সম্মান দেখাত।’

কিন্তু গ্রামের সেই ধুলাবালুর পথ বিষ্ণোইয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। সমবয়সীদের সঙ্গে সেখানকার মাঠে ভলিবল আর ক্রিকেট খেলে দিন কাটানো বিষ্ণোইয়ের ভেতর তখন আরও বড় কিছু করার ইচ্ছা জন্মে।

অভিনেতা সালমান খান। ২০১৮ সালে বিষ্ণোই নতুন করে আলোচনায় আসেন এই বলিউড তারকাকে হত্যার হুমকি দিয়ে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

২০১০ সালের দিকে বিষ্ণোই গ্রাম ছেড়ে চলে যান চণ্ডীগড়ে—পাঞ্জাব ও হরিয়ানার আধুনিক রাজধানী শহরে। শোনা যায়, আইন পড়ার উদ্দেশ্যে সেখানে যান তিনি। সেখান থেকেই শুরু হয় ছোট গ্রামের ছেলে থেকে তাঁর ভয়ংকর গ্যাং লিডারে রূপান্তর। ২০২৩ সালে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তৈরি দীর্ঘ চার্জশিটে এ তথ্য উল্লেখ আছে। এটি সিএনএন হাতে পেয়েছে।

বিষ্ণোই ভর্তি হন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে। বহু বছর ধরে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি থেকে রাজনীতিবিদ ও কখনো কখনো ‘কুখ্যাত অপরাধীও’ জন্ম নিয়েছে। ছাত্ররাজনীতির সহিংস পরিবেশ তাঁকে শিখিয়েছে কীভাবে প্রভাব, আধিপত্য ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হয়।

বিষ্ণোই গ্যাং গোপন পরিচয়ে কাজ করেন। গ্যাংয়ের প্রত্যেক সদস্য শুধু তাঁর ওপরের জনকে চেনেন। একই অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যরাও একে অপরকে চেনেন না, যাতে একজন ধরা পড়লেও অন্যদের নিরাপদে রাখা যায়।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যে লরেন্স বিষ্ণোই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, চণ্ডীগড় ও রাজস্থানে অন্য গ্যাংয়ের সঙ্গে যোগ দিয়ে বিশাল অপরাধ ও সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।’

সাংবাদিক জুপিন্দারজিৎ সিং বলেন, বিষ্ণোই নিজেকে ঈশ্বরভক্ত ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ হিসেবে দেখাতে চান। বিষ্ণোই দাবি করেন, তিনি নেশা থেকে দূরে থাকেন ও প্রার্থনায় মনোযোগী।

এই ভাবমূর্তি বজায় রাখতে বিষ্ণোই নিজেকে ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘জাতীয়তাবাদী’ হিসেবেও তুলে ধরেন। ২০২৩ সালে কারাগার থেকে এবিপি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিষ্ণোই বলেছিলেন, পাকিস্তান ও খালিস্তান আন্দোলনের বিরোধী তিনি। খালিস্তান আন্দোলন হলো ভারতের অংশবিশেষ নিয়ে স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন।

আইনের সঙ্গে সংঘাত

বিষ্ণোই প্রথমবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ২০১০ সালে, এক হামলা মামলায়। দুই বছরের মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা হয়। প্রতিবারের গ্রেপ্তার ও জেলজীবন তাঁকে আরও শক্ত ও সংগঠিত করে তোলে—বলা হয়েছে অভিযোগপত্রে।

২০১৪ সালে রাজস্থানে পুলিশের এক তল্লাশিচলাকালে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তখন আবারও গ্রেপ্তার হন বিষ্ণোই। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর, এক আত্মীয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে কয়েক মাস পর নাটকীয়ভাবে তিনি পালিয়ে যান।

২০১৫ সালের মার্চে বিষ্ণোই আবার ধরা পড়েন পাঞ্জাবে। এবার আর পালানোর সুযোগ হয়নি। কিন্তু পুলিশ বুঝতে পারে—তাঁকে বন্দী করে রাখলেই তাঁর অপরাধ থেমে থাকবে না।

অভিযোগপত্রে লেখা হয়, ‘লরেন্স বিষ্ণোই জেল থেকেই পুরো গ্যাং পরিচালনা করেন। তিনি জেলের ভেতর থেকে এত দক্ষভাবে কাজ চালান যে বাইরে থেকেও তাঁকে থামানো যায় না।’

বিষ্ণোই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে তরুণদের প্রলুব্ধ এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন।

অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, বিষ্ণোই গ্যাং গোপন পরিচয়ে কাজ করে। গ্যাংয়ের প্রত্যেক সদস্য শুধু তাঁর ওপরের জনকে চেনেন। একই অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যরাও একে অপরকে চেনেন না, যাতে একজন ধরা পড়লেও অন্যদের নিরাপদে রাখা যায়।

বলিউডের তারকা ও পপ গায়ক হত্যার অভিযোগ

বিষ্ণোইয়ের গ্রেপ্তারের পরও তাঁর গ্যাং আরও সাহসী হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে তিনি আলোচনায় আসেন বলিউড তারকা সালমান খানকে হত্যার হুমকি দিয়ে। কারণ ছিল, ১৯৯৮ সালে খানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া এক মামলার অভিযোগ। অভিযোগ অনুযায়ী, সালমান দুটি কৃষ্ণসার হরিণ শিকার করেছিলেন, যেগুলো বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র।

বিষ্ণোই সম্প্রদায় উত্তর ভারতের এক হিন্দু গোষ্ঠী। তাদের ‘প্রকৃতির রক্ষক’ বলা হয়। তাদের গুরু জাম্ভেশ্বর দেবের দেওয়া ২৯টি উপদেশের একটি হলো, সব প্রাণীর সুরক্ষা দেওয়া।

জুপিন্দারজিৎ সিংয়ের ভাষায়, ‘তাঁর (বিষ্ণোই) প্রথম উদ্দেশ্য ছিল (২০১৮ সালে), সালমান খানকে ভয় দেখানো এবং কৃষ্ণসার হরিণ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া।’

এর চার বছর পর, ২০২২ সালে, পুলিশের অভিযোগ—বিষ্ণোইয়ের নির্দেশেই খুন হন পাঞ্জাবি গায়ক সিধু মুসেওয়ালা। তিনি তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন।

বিষ্ণোই এ হত্যায় নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে জেল থেকে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী হত্যার পরিকল্পনা করেছেন। একই সাক্ষাৎকারে তিনি আবার সালমান খানকে হুমকি দেন। বলেন, ‘ওকে শাস্তি দেওয়াই আমার জীবনের লক্ষ্য।’

বিষ্ণোইয়ের আন্তর্জাতিক সংযোগ

প্রায় এক দশক কারাগারে বন্দী থাকা সত্ত্বেও বিষ্ণোইয়ের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে দেশের সীমানার বাইরে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তাঁর গ্যাং এখন যুক্তরাষ্ট্র, দুবাই ও কানাডা পর্যন্ত সক্রিয়।

গত বছর কানাডার কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করে, বিষ্ণোই কানাডায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর হামলার পেছনে যুক্ত। ২০২৩ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় গুলিতে নিহত হন শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর। তাঁর হত্যার সূত্রেও বিষ্ণোইয়ের নাম আসে।

নিজ্জরকে ভারত সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ভারতের অভিযোগ ছিল, তিনি একটি নিষিদ্ধ সংগঠন চালাতেন। সংগঠনটি বিশ্বজুড়ে শিখ সম্প্রদায়কে খালিস্তানের পক্ষে উসকে দিত।

খালিস্তান আন্দোলনকে ভারত তার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে এবং বহুদিন ধরে কানাডাকে দেশটিতে শিখ ‘উগ্রপন্থীদের’ আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছে।

অন্যদিকে কানাডার অভিযোগ, তার মাটিতে শিখ রাজনীতিকদের ওপর সহিংসতা ছড়াচ্ছে ভারত।

গত বছরের অক্টোবরে কানাডার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পার্লামেন্টারি কমিটিতে বলেন, ভারত লরেন্স বিষ্ণোই গ্যাংয়ের মতো অপরাধী সংগঠনকে ব্যবহার করছে, যাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারত সরকারের সমালোচক এমন কানাডীয়দের ওপর হামলা চালানো যায়।

তবে ভারত নিজ্জর হত্যায় নিজেদের কোনো ভূমিকা থাকার কথা বারবারই অস্বীকার করেছে। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনিতা আনন্দ চলতি মাসে সিবিসি নিউজকে বলেছেন, ভারতীয় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তদন্তে সহযোগিতা করছে।

সিএনএন এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কোনো মন্তব্য করেনি।

কানাডায় বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা

কানাডা সরকার এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিষ্ণোই গ্যাংকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে। অভিযোগ, তারা প্রবাসী সম্প্রদায়ের ওপর ভয় ও সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছে।

কানাডার জননিরাপত্তা বিভাগ এক বিবৃতিতে বলেছে, বিষ্ণোই গ্যাং খুন, গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগে জড়িত। তারা ভয় দেখিয়ে ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে আতঙ্ক তৈরি করে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে এসব কর্মকাণ্ড চালানো হয়।

কানাডার ‘বিশ্ব শিখ সংস্থা’ এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। তাদের দাবি, বিষ্ণোই গ্যাং কানাডায় শিখদের বিরুদ্ধে ভারতের দমন অভিযানের বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যে নিজ্জর হত্যাকাণ্ডও অন্তর্ভুক্ত।

এ ঘোষণার ফলে কানাডা সরকার এখন বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্যদের সম্পদ ও তহবিল জব্দ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচার করার ক্ষমতা পেয়েছে।

কারাগারে থেকেও আত্মবিশ্বাসী বিষ্ণোই

এত সব অভিযোগ ও কয়েক ডজন মামলাও বিষ্ণোইকে বিচলিত করতে পারেনি। গত বছর এবিপি নিউজকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমাকে গ্যাংস্টার বলা নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। এটা সেই পরিচয়, যা ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন।’

বিষ্ণোই আরও বলেন, ‘৯ বছর জেলে কাটিয়ে আমি এখন ভালো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখি না। আমি যেমন আছি, তাতেই ভালো আছি।’