বিলকিসের মামলার অপরাধীদের কেন বেছে বেছে মুক্তি দেওয়া হলো

গুজরাট দাঙ্গার সময় দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার বিলকিস বানুর মামলায় দণ্ডিত ১১ জনকে মুক্তির প্রতিবাদে গত বছর দিল্লিতে বিভিন্ন নারী সংগঠনের বিক্ষোভ। ২০০২ সালের ওই দাঙ্গার সময় বিলকিসের তিন বছর বয়সী কন্যাসন্তানসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট
ছবি: এএনআই

বিলকিস বানুর মামলার অপরাধীদের বেছে বেছে কেন মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তার জবাবদিহি করতে বলা হলো গুজরাট সরকারকে। রাজ্য সরকারকে ভর্ৎসনা করে সুপ্রিম কোর্ট এ কথাও জানতে চান, শোধরানোর সুযোগ দেওয়াই যদি মুক্তি দেওয়ার একমাত্র যুক্তি হয়ে থাকে, তাহলে আর কত বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেই হিসাব সর্বোচ্চ আদালতে দাখিল করা হোক। সুপ্রিম কোর্টের এই প্রশ্নের মুখে গভীর অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপিশাসিত গুজরাট সরকার।

২১ বছর আগে ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার সময় ২১ বছর বয়সী গৃহবধু বিলকিস বানু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। সেই সময় তাঁর তিন বছরের শিশুকন্যাসহ পরিবারের সাত সদস্যকে হত্যা করা হয়।

সেই অত্যাচারের সময় বিলকিস পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ ওই মামলায় ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলাটি গুজরাট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল মুম্বাইয়ে। মামলা চলাকালে এক অভিযুক্তের মৃত্যু হয়। বাকি ১১ জনের প্রথমে মৃত্যুদণ্ড এবং পরে তা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়।

গত বছর স্বাধীনতা দিবসের দিন গুজরাট সরকার বিশেষ ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে ১১ জনকে মুক্তি দেয়। তারপর তাঁদের বীরের সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ঘটনা দেশবাসীকে হতবাক করেছিল। কেন এবং কোন যুক্তিতে তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়—তা জানতে একাধিক মামলা সুপ্রিম কোর্টে হয়েছিল। মামলা করেছিল বিলকিস বানুর পরিবারও।

গতকাল বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন ও বিচারপতি উজ্জ্বল ভূঁইয়ার বেঞ্চ গুজরাট সরকারের কাছে তাদের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে বলেন। তাঁদের প্রশ্ন, কেন শুধু বেছে বেছে বিলকিস বানুর ধর্ষকদের ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুনিদের ছেড়ে দেওয়া হলো? কেনই–বা অন্য অপরাধীরা কারাগারে পচছেন?

বিচারপতি নাগরত্ন বলেন, এই অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়েছিল। তা পরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পর্যবসিত হয়। অথচ ১৪ বছর কারাভোগের পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হলো? কেন?

উত্তরে রাজ্য সরকারের পক্ষে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল এস ভি রাজু বলেন, অপরাধীদের ব্যবহার ভালো ছিল। তা ছাড়া তাঁদের শোধরানোর একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং তা করা হয়েছে রাজ্য সরকারের ১৯৯২ সালের শাস্তি কমাতে ক্ষমতা প্রদর্শন নীতি মেনে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতিরা জানতে চান, সেই সুযোগ রাজ্যের আর কতজন অপরাধীকে দেওয়া হয়েছে? ১৪ বছর সাজাপ্রাপ্ত সব অপরাধীকে কি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? তা যদি না হয়, তাহলে এই ১১ জনকে কেন বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হলো? অন্য কতজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, কতজনকে দেওয়া হয়নি, রাজ্য সরকার চটজলদি সেই পরিসংখ্যান জমা দিতে পারেনি। তাদের তা জমা দিতে বলা হয়েছে। ২৪ আগস্ট এই মামলার পরবর্তী শুনানি।

এ মামলার অপরাধীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জেল উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়েছিল। কিসের ভিত্তিতে ওই কমিটি গঠন, তা–ও জানতে চান বিচারপতিরা। মামলা চালানো হয় মহারাষ্ট্রে অথচ মুক্তির বিষয়ে কমিটি মতামত জানতে চেয়েছিল গোধরা আদালতের! কেন? সেই প্রশ্নও বিচারপতিরা করেন।

বিলকিস বানুর আইনজীবী শোভা গুপ্ত এজলাসে বলেন, মহারাষ্ট্রের আদালতের বিচারপতি অপরাধীদের মুক্তি দিতে অস্বীকার করেছিলেন। তা ছাড়া রাজ্য সরকার ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়ে অপরাধের শিকার বিলকিস বানুর মতামতও কখনো জানতে চায়নি।

গতকাল শুনানির সময় বিচারপতিরা সুপ্রিম কোর্টের আগের এক সিদ্ধান্তকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করান। এই মামলার এক আসামি রাধশ্যাম ভগবানদাস শাহ তাঁর শাস্তি মওকুফের বিষয়ে গুজরাট সরকারকে নির্দেশ দিতে হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন।

হাইকোর্ট তা নাকচ করায় তিনি সুপ্রিম কোর্টে যান। সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদন গ্রহণ করে রাজ্য সরকারকে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বিচারপতি নাগরত্ন ও ভূঁইয়া সেই বিষয়েও আইনগত প্রশ্ন তুলেছেন।

বিলকিস বানুর ধর্ষকদের মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত এবং বিজেপি নেতারা তাঁদের যেভাবে বরণ করে সংবর্ধনা জানান, তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা সদস্য মহুয়া মৈত্র, সিপিআই নেত্রী সুভাষিনী আলীসহ অনেকেই মামলা করেন। পরে মামলা করেন খোদ বিলকিস বানু।