ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে তিন রাজ্যে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সিপিআই-এম সমর্থকেরা বিক্ষোভ করেন। আজ ১২ মার্চছবি: এএনআই

ভারতে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বাস্তবায়নের প্রতিবাদে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও কেরালায় প্রতিবাদ–বিক্ষোভ হয়েছে। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্টসহ (সিপিআইএম) বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই আইনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, সিএএ ব্যবহার করে আবার পশ্চিমবঙ্গ ভাগের খেলায় নেমেছে বিজেপি।

সিএএ আইন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে যেসব সংখ্যালঘু (হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ও পার্সিধর্মী) সাম্প্রদায়িক নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে ভারতে চলে এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দিতে পারবে কেন্দ্রীয় সরকার।

সিএএ বাস্তবায়নের ঘোষণার পর গতকাল রাতেই আসামের গুয়াহাটিতে আইনের নির্দেশিকার অনুলিপি পোড়ানোসহ বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ হয়।

আজ আসাম পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়েছে উত্তরপূর্ব আসামের শিবসাগর জেলায়। শিবসাগর জেলা ছাত্র সংসদ (এসডিএসইউ) আয়োজিত সমাবেশ পুলিশ রুখতে গেলে সন্ধ্যায় ছাত্রদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ কিছু প্রতিনিধি আহত হয়েছেন। স্থানীয় প্রচার মাধ্যম জানিয়েছে, কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ বলেছেন, সিএএ ব্যবহার করে আবার পশ্চিমবঙ্গ ভাগের খেলায় নেমেছে বিজেপি।

গতকাল সোমবার থেকে আসামের মানুষ রাস্তায় নেমেছেন—নলবাড়ি থেকে ডিব্রুগড়, গুয়াহাটি থেকে গোলাঘাট পর্যন্ত। উত্তর আসামের শিবসাগর থেকে জোরহাটে প্রতিবাদ চলছে আজ মঙ্গলবারেও।

২০১৯ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভকারীরা যে ধরনের স্লোগান দিয়েছিলেন, সোমবার রাতেও তা শোনা গেছে, যেমন—‘সিএএ আমি নামানু (আমরা সিএএ মেনে নেব না) বা ‘জয় অ্যাই অসম (মা আসামের জয়)।’ তাঁদের ধারাবাহিকভাবে সরকারবিরোধী স্লোগান দিতেও শোনা যায়।

আজ মঙ্গলবার অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) একটি গণ ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ আন্দোলন এখন চলবে বলে তারা জানিয়েছে। অসম জাতীয়তাবাদী যুব-ছাত্র পরিষদসহ ৩০টি জাতিগত সংগঠন এবং অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের সমর্থনে আসু এই আইনের প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার রাতে রাজ্যজুড়ে মশাল সমাবেশ করবে। সেখান থেকেই বিক্ষোভ কর্মসূচি দানা বাঁধবে বলে মনে করা হচ্ছে।

ছাত্র-যুব পরিষদের মুখপাত্র পলাশ চাংমাই স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সিএএ-বিরোধী আন্দোলন চলবে। আমরা কোনো অবস্থাতেই এই আন্দোলন থেকে সরে আসব না, যখন অসমিয়া সম্প্রদায় একটি অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে।’

মঙ্গলবার সকাল থেকে আসু, যুব-ছাত্র পরিষদ ও কৃষক মুক্তিসংগ্রাম সমিতি গোলাঘাট জেলায় মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে।

কয়েক বছর ধরে সারা দেশে সিএএর বিরুদ্ধে আদালতে ২৪৭টি আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ৫৩টি আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের। এর মধ্যে আসামেই ৫০টি আবেদন করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করতে আসুর প্রধান উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে একটি দল আজ নয়াদিল্লি রওনা হয়েছে।

১৬টি স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের জোট ইউনাইটেড অপজিশন ফোরাম আসাম (উয়ফা) আজ রাজ্যজুড়ে সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। তবে এ ধর্মঘটে বিশেষ সাড়া বিরোধীরা পায়নি। দোকানপাট ও অফিস খোলা ছিল, শহরে মোটামুটি যানবাহনও চলাচল করেছে। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির কয়েক বিক্ষোভকারী আজ গুয়াহাটির রাজীব ভবনের বাইরে প্রতিবাদ করেন। তবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।

আসামের শিবসাগরে কৃষক মুক্তিসংগ্রাম সমিতির সদস্যরা সিএএর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বের করলে পুলিশ তাঁদের ধরপাকড় করেন। আজ ১২ মার্চ
ছবি: এএনআই

গুয়াহাটির পুলিশ কমিশনারেট ১৬ দলের বিরোধী জোটকে আইনি নোটিশ দিয়ে সতর্ক করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়ে রাজ্য পুলিশের তরফে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ করা হয়েছে। এ আবেদন না মানলে রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।

আসাম পুলিশের মহানির্দেশক জি পি সিং বলেছেন, ‘ধর্মঘট করা হলে এবং ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে আইন ভাঙা হলে রাজ্য প্রশাসন কড়া ব্যবস্থা নেবে। রাস্তা বা রেল অবরোধ বেআইনি বলে অতীতেই আদালত জানিয়েছে। ফলে এ ধরনের কিছু করা হলে আমরা কড়া ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।’

বাংলাকে ভাগ করতে চাইছে বিজেপি: মমতা

আজ উত্তর চব্বিশ পরগনার হাবড়ার প্রশাসনিক সভা থেকে বিজেপিকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি একটা বিভাজনের খেলা খেলতে চাইছে। তা যদি না চাইত, তাহলে সিএএ আইনে পরিণত হওয়ার পর চার বছর বসে থাকত না। ওদের লক্ষ্য আবার বাংলাকে ভাগ করা এবং বাঙালিকে এখান থেকে তাড়ানো।

সিএএ আইন না মানার নির্দেশ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আইনের নীতি নির্দেশিকায় নাগরিকত্বের জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। একটা কথা মন দিয়ে শুনুন। আপনারা নাগরিকত্বের জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করবেন না। এটা করলেই আপনাদের নাগরিকত্ব চলে যাবে। আপনাকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলা হবে। আপনার সম্পত্তি কেড়ে নেবে। ওই ফাঁদে পা দেবেন না।’

মমতা বলেন, ২০১৯ সালে আসামে নাগরিকত্ব নথিভুক্তকরণের (এনআরসি) নামে ১৯ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ১৩ লাখ ছিলেন বাঙালি হিন্দু, ফলে পরিকল্পনা বোঝা যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘নাগরিকত্ব আইনের আবেদনপত্রের এক জায়গায় মা-বাবার জন্মসনদ চাওয়া হয়েছে। এটা কি দেখানো সম্ভব? যাঁদের এখন ৫০-৬০ বছর বয়স, তাঁদের সবার বাবার বার্থ জন্মসনদ আছে? আমি তো আমার মা-বাবার জন্মদিনই জানি না।’

সিএএর বিরোধিতা করেছে সিপিআইএমও (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট)। মমতার সুরেই দক্ষিণ ভারতের কেরালায় আইনটিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে বলেছে ওই রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল সিপিআইএম।

পশ্চিমবঙ্গেও আইনটির বিরোধিতা করেছে দলটি। তবে পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমও বলেছেন, কিছুদিন আগে রাজ্যে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৈঠক করেছিলেন। এ বৈঠকে কী কথা হয়েছিল, তা এখন বোঝা যাচ্ছে।

সেলিম বলেন, ‘তৃণমূল ও বিজেপি—দুই দলই সম্পূর্ণভাবে মেরুকরণের রাস্তায় হাঁটছে এবং সেই লক্ষ্যেই নির্বাচনের আগে সিএএ বাস্তবায়নের চেষ্টা, যাতে তৃণমূল ও বিজেপি—দুই দলই মেরুকরণের প্রভাবে নির্বাচনে লাভবান হতে পারে। আমরা সব স্তরে বিশেষত মাঠপর্যায়ে এই আইনের বিরোধিতা করব, মানুষকে বোঝাব।’