শেষ সময়ে কেন মোদি সংরক্ষিত নারী আসনের বিল আনলেন

ভারতের নতুন পার্লামেন্ট ভবনে নরেন্দ্র মোদি। ১৯ সেপ্টেম্বর, দিল্লি
ছবি: এএনআই

প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী যে স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং চেষ্টা করেও যা সফল করতে পারেননি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা করতে যাচ্ছেন। লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভায় মোট আসনের ৩৩ শতাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত করা হচ্ছে। মঙ্গলবার ভারতের নতুন সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনের প্রথম দিনেই এ-সংক্রান্ত বিল পেশ করা হলো। বিলটি পেশ করেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল।

বিল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, নতুন সংসদ ভবনের প্রথম কাজ হিসেবে নারী শক্তির আবাহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নারীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে। এই বিলের আনুষ্ঠানিক নাম রাখা হয়েছে ‘নারী শক্তি বন্দন’।

নারী সংরক্ষণ বিল নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে আলোচনা দীর্ঘদিনের। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ‘এর আগে বহুবার এই বিল উত্থাপন ও পাসের চেষ্টা হয়েছিল। অটল বিহারি বাজপেয়ী সরকারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকা একটা বড় কারণ ছিল। সেই অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার সুযোগ ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন।’

নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের চিন্তাভাবনা প্রথম করেছিলেন রাজীব গান্ধী। তিনি শুরু করেছিলেন পঞ্চায়েত-পৌরসভা পর্যায় থেকে। তাঁরই প্রচেষ্টায় দেশের সর্বত্র পঞ্চায়েত ও পৌরসভার মোট আসনের ৩৩ শতাংশ নারীদের জন্য সংরক্ষিত হয়। কিন্তু লোকসভা ও বিধানসভার ক্ষেত্রে তিনি তা নিশ্চিত করতে পারেননি। তবে কংগ্রেস বরাবর সেই দাবি জানিয়ে এসেছে। কংগ্রেসকে সঙ্গ দিয়েছে বামপন্থীরাও। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৌড়ার আমলে বিলটি পেশের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি।

পরে মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নারী সংরক্ষণ বিল ২০১০ সালে আনা হয়। ২০১২ সালে রাজ্যসভায় পাস করানোও হয়। কিন্তু সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি, জেডি (ইউ) ও আরজেডির বিরোধিতায় তা লোকসভায় পাস করানো যায়নি। ২৭ বছর পর এখন বিজেপির উদ্যোগে ও কংগ্রেস-বামপন্থীসহ অন্য বিরোধী দলের সমর্থনে নারীদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিষয়টি বাস্তবায়িত হতে চলেছে।

বিলটি নিয়ে এবার তেমন একটা বাধা বা প্রতিরোধ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, সংসদের বিশেষ অধিবেশনের ঘোষণার পর বিরোধীরাই সম্মিলিতভাবে দাবি জানিয়েছিল এই বিল পাস করানোর। তা করতে গতকাল সোমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে বিলটি অনুমোদন করা হয়।

মঙ্গলবার নতুন সংসদ ভবনে প্রবেশের সময় বিষয়টি জানাজানি হলে কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী বলেন, ‘এটা তো আমাদেরই বিল। আমরাই তো বারবার এই বিল আনতে চেয়েছি।’ বিল পেশের সময় বিরোধী নেতা কংগ্রেসের অধীর রঞ্জন চৌধুরী তাঁর ভাষণেও সে কথা জানিয়ে বলেন, রাজীব গান্ধীই প্রথম এই ভাবনা ভেবেছিলেন। ১৩ বছর আগে মনমোহন সিং সরকারের আমলে বিলটি রাজ্যসভায় পাসও হয়েছিল। তা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে তাঁর তর্কও হয়।

প্রশ্ন উঠছে, ১০ বছর ধরে সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও মোদি সরকার কেন এত দিন এই বিল পেশে আগ্রহ দেখায়নি? বিশেষ করে কংগ্রেসসহ অনেক বিরোধী দল যেখানে বিলের পক্ষে? উত্তরটা পুরোপুরি রাজনৈতিক। নানা কারণে বিজেপি কোণঠাসা। নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তিও বেশ কিছুটা ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী নারী শক্তিকে সমর্থনের আধার করতে চাইছেন। চন্দ্রযান-৩-এর সাফল্যের পর ইসরোয় গিয়ে নারী বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে তিনি আলাদাভাবে বসেছিলেন। নারী শক্তির জয়গান গেয়েছিলেন। এই বিল পাস করিয়ে আগামী ভোটের প্রচারে গিয়ে তিনি বলতে পারবেন, নারীর ক্ষমতায়নের একমাত্র কান্ডারি তিনিই।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই সংরক্ষণ কার্যকর হচ্ছে না। বিলেই বলা আছে, এটি কার্যকর হবে ২০২৭ সালের জনগণনা পর্ব শেষে লোকসভা ও বিধানসভা কেন্দ্রের সীমানা পুনর্নির্ধারণের পর। ফলে ২০২৯ সালের আগে এই সংরক্ষিত নারী আসন কার্যকর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, এটা মোদির চমক ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, ২০২৪ সালের ভোটের আগে জনগণনা ও আসন পুনর্বিন্যাস কোনোটাই হচ্ছে না।

বর্তমানে লোকসভার মোট আসন ৫৪৩। এই বিল পাস হলে নারীদের জন্য ১৮১টি আসন সংরক্ষিত থাকবে। তবে কোনো আসনই স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত থাকবে না। আসনগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট করা হবে। এই ৩৩ শতাংশের মধ্যে তফসিলি ও উপজাতি নারীদের জন্যও আসন সংরক্ষিত থাকবে। তবে অনগ্রসর শ্রেণির নারীদের সংরক্ষণের বিষয়টি নির্দিষ্ট করা হয়নি। কংগ্রেস, জেডিইউ, আরজেডিসহ আরও কোনো কোনো দল—এমনকি বিজেপির একাংশও সেই দাবি তুলতে পারে। এই সংরক্ষণ সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা ও রাজ্যের বিধান পরিষদেও থাকবে না। কোনো কোনো দল অবশ্য উচ্চ কক্ষেও সংরক্ষণের দাবি জানাতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।