ভারতভাগের ক্ষত প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করছে

১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গঠিত হয় দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন সাগর গেলানি (২৬) ও ফায়জা আওয়ান (৩১)। সাগর ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ফায়জার বাড়ি পাকিস্তানে। ৭৫ বছর আগে যখন ব্রিটিশ শাসকেরা ভারত ছেড়ে যায়, ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে—তারও অনেক পরে জন্ম তাঁদের। এরপরও দেশভাগের করুণ ও লাখো মানুষের আত্মত্যাগের গল্পগুলো তাড়া করে ফেরে দুজনকে। এক সাক্ষাৎকারে সাগর ও ফায়জা জানান, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলেছেন তাঁরা। খবর বিবিসির।

আজ সোমবার ভারত বিভক্তির ৭৫ বছর ছিল। বিবিসি জানিয়েছে, ভারতের স্বাধীনতার বিষয়টি ব্রিটিশ শাসকেরা আগে থেকেই ঠিক করেছিলেন। এরপর ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করা হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট জন্ম হয় পাকিস্তানের। আর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলো নিয়ে পরের দিন স্বাধীনতা লাভ করে ভারত।

ভারতের স্বাধীনতার কথা ভাবলে আমার দেশভাগের সময় আত্মত্যাগকারী মানুষদের কথা মনে হয়। তাঁদের সম্মান জানাতে ইচ্ছা করে। কেননা ভারতবাসীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাঁরা কষ্ট ভোগ করেছেন।
সাগর গেলানি, ভারতীয় বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক।

দেশভাগের পর অসংখ্য মানুষ ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে কিংবা পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান। যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষের সময় বাদে মানবেতিহাসে এটাকে সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় স্থানান্তরের ঘটনা বলা হয়ে থাকে। এ ঘটনায় উদ্বাস্তু হন এক কোটির বেশি মানুষ। ধর্মীয় দাঙ্গায় নিহত হয় ৫–২০ লাখ মানুষ। অপহরণের শিকার হন হাজার দশেক নারী।

দেশভাগের ৭৫ বছর পূর্তির দিনটি সম্পর্কে সাগর বলেন, ‘এটা ভুক্তভোগীদের স্মরণ করা এবং কীভাবে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারি, তার প্রতিফলন ঘটানো।’ অন্যদিকে ফায়জা বলেন, ‘স্বাধীন দেশ হওয়ার বিষয়টি খুশির সংবাদ। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন, অনেক কিছু হারিয়েছেন, তাঁদের ভুললে চলবে না।’

সাগর ও ফায়জার পরিবারও দেশভাগের সময় ভুগেছে। ফায়জা বলেন, ‘ওই সময় এমন কেউ ছিলেন না, যাঁকে দেশভাগের অভিঘাত মোকাবিলা করতে হয়নি। আমার দাদি, চাচা, ফুপুর কাছে কষ্টের নানা গল্প শুনেছি। পরিবারের সদস্যদের এসব গল্প আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বহন করে চলেছি।’

আরও পড়ুন

দেশভাগের সময় সবাইকে শত্রুর মতো দেখা হতো। এমনকি দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীদেরও বহিরাগত মনে করা হতো। এর ভিত্তিতে তাঁদের সঙ্গে আচরণ করা হতো। পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের কাছে এমন গল্প শুনেছেন সাগর। তিনি বলেন, ‘ভারতের স্বাধীনতার কথা ভাবলে আমার দেশভাগের সময় আত্মত্যাগকারী মানুষদের কথা মনে হয়। তাঁদের সম্মান জানাতে ইচ্ছা করে। কেননা ভারতবাসীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাঁরা কষ্ট ভোগ করেছেন।’

ফায়জা জানান, দেশভাগের সময়কার ভুক্তভোগী নারীদের কষ্টের গল্পগুলো তাঁকে ও তাঁর বোনকে নাড়া দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘শুনেছি, সম্মান বাঁচাতে অনেক নারী একসঙ্গে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। আমরা ভাগ্যবান, আমরা ওই প্রজন্মের কেউ না।’ একজন পাকিস্তানি হিসেবে গর্ববোধ করেন ফায়জা। তিনি বলেন, ‘দেশভাগের ইতিহাস আমার জন্য গর্বের। এটা আমাকে আমার সত্তা সম্পর্কে সচেতন রাখে।’

ভারত ও পাকিস্তানের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য অনেকটা অভিন্ন। আমি বুঝতে পারি, দুই দেশের সম্পর্কের ফাটলগুলো। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার গুরুত্বও সবাইকে বুঝতে হবে।
ফায়জা আওয়ান, পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক।

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরোলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এখনো নানা বিষয়ে বিরোধ রয়েছে। অবিশ্বাসের সম্পর্ক রয়ে গেছে। এ বিষয়ে ফায়জা বলেন, ‘দুই দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য অনেকটা অভিন্ন। আমি বুঝতে পারি, দুই দেশের সম্পর্কের ফাটলগুলো। কিন্তু শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার গুরুত্বও সবাইকে বুঝতে হবে।’

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ ভালো মন্তব্য করে ফায়জা বলেন, ‘এখানে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি থাকি। আমার প্রত্যাশা, সীমান্তের (ভারত ও পাকিস্তানের) দুই পাশের মানুষও একে অপরকে ভালোবাসবে। শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে।’

আরও পড়ুন

অন্যদিকে সাগরের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের এখনকার সম্পর্ক দেশভাগের ফল। ১৯৪৭ সালের পরবর্তী সময় থেকে এটা দুই দেশের মানুষ বয়ে চলেছেন। এর বিরোধিতা করে সাগর বলেন, ‘নিজেদের ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি পরিচয়ের পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা সবাই মানুষ। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়। তাই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখেই আমাদের চলা উচিত।’

আরও পড়ুন