যশোর রোডের গাছগুলো কেটে ফেলার চেষ্টা, প্রতিবাদে মুখর পরিবেশবাদীরা

দুই ধারে গাছে ঢাকা ঐতিহাসিক যশোর রোড
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক যশোর রোডের দুই পাশের বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়েছে। উন্নয়নকাজে রোডের পাশে থাকা ৩৫৬টি গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন বৃক্ষপ্রেমীরা।

এই উপমহাদেশে এক পরিচিত নাম যশোর রোড। বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের বুক চিরে চলে গেছে এই রোড। শুরু বাংলাদেশের যশোর জেলা থেকে। চলে এসেছে বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত বেনাপোল-পেট্রাপোল পেরিয়ে সোজা কলকাতায়। সেই যশোর রোড নিয়ে কত কথা, কাহিনি, কত ইতিহাস এখনো ঘুরে বেড়ায় উপমহাদেশজুড়ে।

আর মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যশোর রোড যেন হয়ে উঠেছিল এক জীবন্ত ইতিহাস। এই রোড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাড়ি দিয়েছে শত্রুর মোকাবিলায়, ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এই রোড ঘুরেছেন সেদিন বিশ্বের তাবড় নেতারা, কবি-সাহিত্যিকেরা। মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এই যশোর রোড দেখে একাত্তর সালে লিখেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। রোডের দুই ধারের বৃক্ষরাজিই যশোর রোডের গর্ব।

এখন যশোর রোডের বারাসাত থেকে বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার রোডের দুই পাশে থাকা শতবর্ষী গাছকে কেটে রাস্তা সম্প্রসারণ করার চেষ্টা চলছে। আর এ গাছ কাটার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এলাকার মানুষসহ এ রাজ্যের বৃক্ষপ্রেমীরা। গঠন করেছেন—‘যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটি’। তারা শুরু করেছে আন্দোলন। গেল শনিবার এ কমিটি কলকাতার ধর্মতলার লেনিন মূর্তির পাদদেশে মানববন্ধন করেছে। আন্দোলনকারীরা দাবি তুলেছেন, ‘জান দেব, তবু গাছ কাটতে দেব না।’

যশোর থেকে বেনাপোল-পেট্রাপোল-বনগাঁ-হাবড়া-বারাসাত পাড় হয়ে কলকাতার শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত ১২৫ কিলোমিটারের এই যশোর রোড। বাংলাদেশের অংশটুকু যশোর বেনাপোল সড়ক নামে পরিচিত হলেও পেট্রাপোল সীমান্ত থেকে একেবারে কলকাতা এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে নাগের বাজার হয়ে শ্যমবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত এই সড়ককে যশোর রোড নামেই জানে লোকজন। সাইনবোর্ডে কোথাও কোথাও লেখায় এই যশোর রোডের নাম চোখে পড়ে।

কলকাতায় যশোর রোডের গাছ বাঁচানোর দাবিতে মানববন্ধন
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

যশোর রোডের ইতিহাস

শেরশাহ ১৫৪০ থেকে ১৫৪৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সোনারগাঁও থেকে আজকের পাকিস্তান পর্যন্ত তৈরি করেন গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। যশোর-বেনাপোল-বনগাঁ-কলকাতা ছুঁয়ে লাহোর-পেশোয়ার অবধি চলে গেছে এই রোড। আবার ইংরেজদের বাংলা দখলের আগে সংস্কারের অভাবে এ রোড মেঠো পথে পরিণত হয়ে যায়। তখন দস্যু-তস্করের হামলার ভয়ে ঝুঁকি নিয়ে এ পথ দিয়েই চলাচল করতেন রাজকর্মচারী ও ব্যবসায়ীরা। তখন যশোর থেকে কলকাতায় যাওয়ার বিকল্প মাধ্যম ছিল নৌপথ। এরপর যশোর জেলা হওয়ার সুবাদে বেড়ে যায় যশোরের গুরুত্ব। প্রসার ঘটে ব্যবসা-বাণিজ্যের। তখন যশোরের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। হিন্দুরের কাছে তখনো গঙ্গাস্নান একটি পুণ্যের কাজ। বহু হিন্দু নারী গঙ্গাস্নানের জন্য নদীপথে কলকাতায় যেতেন। আবার কেউ কেউ পালকিযোগেও যেতেন। যেতেন বনগাঁ হয়ে চাকদহের গঙ্গার ঘাটে। যশোর থেকে চাকদহের দূরত্ব ছিল ৮০ কিলোমিটার।

সে সময় যশোর শহরের বকচরের জমিদার ছিলেন কালী প্রসাদ পোদ্দার। কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। নৌকার মাঝিদের অসহযোগিতার কারণে একবার জমিদারের মা গঙ্গাস্নানে যেতে না পারায় নিজেকে অপমানিত বোধ করেন। সেদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে মা অনশনে বসেন। উদ্বিগ্ন পুত্র দরজা খোলার অনুরোধ জানালে মা শর্ত দেন, গঙ্গাস্নানের জন্য যশোর থেকে চাকদা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করে দিলেই তিনি অনশন প্রত্যাহার করবেন। পুত্র কালী প্রসাদ মায়ের দাবি মেনে রাস্তা নির্মাণ করেন। ফলে এ রাস্তাকে অনেকে কালীবাবুর সড়ক বলেও অভিহিত করেন। ১৮৪৫ সালের দিকে ভারতের তৎকালীন গভর্নর অকল্যান্ডের সহযোগিতায় এ সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ হয়। আর সেদিন এ সড়কের পাশে বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে লাগানো হয় প্রচুর শিশুগাছ। সেই গাছই আজ শতবর্ষ ধরে দাঁড়িয়ে আছে যশোর রোডজুড়ে।

যশোর রোডের গাছ বাঁচানোর দাবিতে প্রতিবাদ চলছে
ছবি: ভাস্কর মুখার্জি

এবারের প্রতিবাদ

পশ্চিমবঙ্গের যশোর রোডের শতবর্ষী গাছ কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছিল ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ২০১৮ সালে। মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।। তবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে ক্ষোভ দেখা দেয় যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির সদস্যদের মধ্যে। তাঁরা নেমে পড়েন আবার আন্দোলনে।

যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির অন্যতম নেতা সুরজিৎ দাস বলেন, ‘গাছ আমাদের প্রাণ, অন্নদাতা, তাদের মারতে দেব না, মরতে দেব না।’

এ আন্দোলনের শুরু থেকেই আছেন আরেক কর্মী অর্পিতা সাহা। তাঁর কথা, ‘গাছ আমাদের পরিবেশ বাঁচায়, আমাদের জীবন রক্ষা করে, তাদের কাটতে দেব না। জীবন দেব, কিন্তু গাছ রক্ষা করব।’