আদানির জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব নিয়ে এবার মাঠে আরএসএস-বিজেপি

গৌতম আদানি
ফাইল ছবি

হিনডেনবার্গকে জবাব দিতে আদানি গোষ্ঠী জাতীয়তাবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। বলেছিল, হিনডেনবার্গের আক্রমণ কোনো শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়। এই আক্রমণ ভারতের বিরুদ্ধে, ভারতের উন্নয়নের গতি রোধ করতে ভারতীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। উদ্দেশ্য, ভারতীয় অর্থনীতির গতি রুদ্ধ করা। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং বিজেপিও সেই যুক্তিই বড় করে মেলে ধরছে।

আরএসএসের মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’ একাধিক নিবন্ধে ওই তত্ত্বকেই খাড়া করেছে। তারা বলছে, এ চক্রান্তের মূলে রয়েছে ভারতের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী চীন।

আরএসএসের এ তত্ত্ব অনুযায়ী, আদানিকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা চাইছে নরেন্দ্র মোদি সরকারকে দুর্বল করতে। মোদি দুর্বল হলে অর্থনীতি রুগ্‌ণ হবে। ভারত কমজোরি হয়ে পড়বে। তাতে শত্রুদের শক্তিই শুধু বাড়বে না, অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা লাভবান হবে।

আরএসএস মুখপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধের রাজনৈতিক তির বিরোধীদের দিকে নিবদ্ধ। এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তারা দেশের বিরোধীদের, বিশেষ করে কংগ্রেসকে শত্রুদেশের সহযোগী বলে প্রচার করতে চাইছে।

‘অর্গানাইজার’-এর একটি নিবন্ধের প্রতিপাদ্য, কোভিডের জেরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীনসহ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি এখনো সংকুচিত। ২০২২ সালে দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি খারাপ ছিল। ওই বছরের পুরোটাই চীনের প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশে ঠেকেছে।

তুলনায় ২০২৩ সালে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ হবে বলে সব মহলের ধারণা। অর্থনীতির ওই বাড়বাড়ন্তের সবচেয়ে বড় শরিক আদানি গোষ্ঠী। সড়ক, বিমান ও স্থলবন্দর, লজিস্টিকসের মতো অবকাঠামো শিল্প; সিমেন্ট, তামা, পিভিসির মতো ধাতু ও বস্তু; সব ধরনের বিদ্যুৎ কিংবা ভোগ্যপণ্যের মতো বাণিজ্যে তারা অগ্রগণ্য।

তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রিলায়েন্স ও টাটারাও ভারতের অর্থনীতিকে ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। সেই উন্নয়ন ঠেকানোই হিনডেনবার্গের মতো সংস্থার লক্ষ্য। আর এর পেছনের শক্তি হলো চীন ও তাদের সর্বঋতুর সঙ্গী পাকিস্তান।

হিনডেনবার্গ বিতর্ক

‘আ ম্যালাফাইড ইনটেন্ট টু হর্ট ইন্ডিয়াজ ইকোনমিক গ্রোথ’ শীর্ষক নিবন্ধে লেখা হয়েছে, এই আক্রমণের অন্য এক লক্ষ্য সাধারণ ভারতীয়দের মনোবল ভেঙে দেওয়া। কোটি কোটি ভারতীয়র সঞ্চিত অর্থ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক এবং জীবনবিমা করপোরেশনে। আদানি গোষ্ঠীতে এসব সংস্থার লগ্নি রয়েছে। আদানি ক্ষতিগ্রস্ত হলে সাধারণ মানুষের ভরসাও নষ্ট হবে।

নড়ে যাবে অর্থনীতির ভিত ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। লাভবান হবে শত্রুপক্ষ। নিবন্ধকারের মতে, দেশ ও শিল্পপতিদের স্বার্থে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে দরকার আইনের সাহায্য নিয়ে চক্রান্তের মোকাবিলা করা। তাতে চক্রান্তের স্বরূপও প্রকাশ পাবে।

আরেকটি নিবন্ধের শিরোনাম ‘হিনডেনবার্গ-আদানি কন্ট্রোভার্সি: অ্যাটাক অন আদানি ইজ কন্টিনিউয়েশন অব অ্যাসল্টস অন ইন্ডিয়ান ইকোনমি’। এ প্রতিবেদনেও চীনকে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে লেখা হয়েছে—শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, ভারতের উত্তরাঞ্চলের এই বৈরী প্রতিবেশী এর আগেও ভারতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক আগ্রাসনের চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। যেমন ২০১৮ সালে তামিলনাড়ুর টুটিকোরিনে (অধুনা টুটুকোড়ি) স্টারলাইট ইন্ডাস্ট্রিজের কপার (তামা) স্মেল্টার বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা।

এতে লেখা হয়েছে, পরিবেশদূষণের মিথ্যা দোহাই দিয়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদী ও প্রগতিশীল’ গণমাধ্যমের সাহায্যে শক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ওই সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে যে ভারত তামা রপ্তানি করত, তারা শুরু করে আমদানি। তাতে লাভ হয় চীনের, ক্ষতি হয় ভারতের। পরে দেখা যায়, ওই ‘স্মেলটার’ পরিবেশকে বিন্দুমাত্র দূষিত করছিল না।

নিবন্ধে লেখা হয়েছে, আরও বিস্ময়কর যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ‘ফয়েল বেদান্ত’কে অর্থ দিয়ে স্টারলাইটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলিয়েছিল চীন।

আরএসএসের মতে, শুধু এটাই নয়, ভারতের অর্থনৈতিক অগ্রগতি রুখতে চীন চক্রান্ত করেছিল কৃষি আইনের বিরুদ্ধেও। নিবন্ধকারদের মতে, কৃষক আন্দোলনের সময় রিলায়েন্সের জিও মোবাইল টাওয়ার আন্দোলনকারীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চীন তাতে মদদ দিয়েছিল। কারণ, ফাইভ–জি স্পেকট্রামের ক্ষেত্রে ভারত সরকার চীনের বিরোধিতা করেছিল। আটকাতে চেয়েছিল চীনের ‘হুয়াওয়ে’ ও ‘জেডটিই’ সংস্থাকে। ভারতের পছন্দ ছিল রিলায়েন্স।

নিবন্ধকারদের তত্ত্ব অনুযায়ী, শত্রুরা ভারতকে দুভাবে দুর্বল করতে উদ্যোগী। একদিকে তাদের লক্ষ্য হলো কৃষক, পরিবেশবাদীদের মতো লোকজনকে খেপিয়ে আন্দোলনে নামানো।

অন্যদিকে, হিনডেনবার্গ বা জর্জ সোরোসের মতো প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নত বিশেষজ্ঞ ও সংস্থাগুলোকে কাজে লাগানো। তারা এ কথাও বলতে চেয়েছে, মার্কিন ডলারের আধিপত্য খর্ব করতে ভারত ‘ইউপিআই’ ও ‘রুপি ট্রেড’ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধিতা করে রাশিয়ার কাছে থেকে তেল কিনছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতকে শত্রুপক্ষের আক্রমণ রুখতে সতর্ক থাকতে হবে।

আরএসএস মনে করছে, হিনডেনবার্গের মতো এমন অর্থনৈতিক অপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো একান্তই দরকার। আরএসএস মুখপত্রের নিবন্ধকারেরা মনে করেন, গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিবিসির ‘কদর্য’ তথ্যচিত্রও এই চক্রান্তের অংশ।