গত বৃহস্পতিবারই রাহুল সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জবাব দেওয়ার অধিকার তাঁর আছে। সেই অধিকার পেতে লোকসভার স্পিকারের সঙ্গেও তিনি দেখা করেছিলেন। রাহুল বলেছিলেন, দেশে গণতন্ত্র থাকলে সেই অধিকার তাঁকে দেওয়া হবে। তবে সংশয় প্রকাশ করে বলেছিলেন, তা পাবেন বলে মনে হয় না। রাহুলের আশঙ্কাই আজ শুক্রবার সকালে সত্য হলো। উপস্থিত থাকলেও তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সভা মুলতবি করা হয়।
রাহুলকে কোণঠাসা করতে বিজেপি গোটা দলকে নামিয়ে দিয়েছে। সভাপতি জে পি নাড্ডা আজ শুক্রবার রাহুলকে সরাসরি দেশদ্রোহী বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, রাহুল দেশবিরোধীদের টুলকিটের স্থায়ী অংশ হয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্য যে কংগ্রেস দলটা দেশবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।
মজার বিষয়, বিরোধীরা এত দিন তাঁদের মাইক বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ করতেন। রাহুল নিজেও বিদেশে সেই কথা বলেছেন। আজ সভা শুরুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লোকসভার সব মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে সরকার ও বিরোধীরা কে কী বলেন, তা সভার বাইরের কারও শোনার উপায় ছিল না।
কংগ্রেস তা নিয়ে টুইট করে বলে, ‘আগে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হতো, আজ পুরো সভাই শব্দহীন। প্রধানমন্ত্রী মোদির বন্ধুর জন্য সদন শব্দহীন!’ অন্য এক টুইটে কংগ্রেস বলে, ‘আওয়াজ উঠছে রাহুলকে বলতে দিন, অথচ স্পিকার ওম বিড়লা মুচকি হাসলেন ও তারপরই সভার সব মাইক বন্ধ করে দেওয়া হলো। এটাই কি গণতন্ত্র?’ কংগ্রেসের দাবি, সভার সব মাইক বন্ধ ছিল প্রায় ২০ মিনিট।
কংগ্রেস টুইট করে বলেছে, ‘আগে মাইক বন্ধ করে দেওয়া হতো, আজ পুরো সভাই শব্দহীন। প্রধানমন্ত্রী মোদির বন্ধুর জন্য সদন শব্দহীন!’
বিদেশে রাহুলের মন্তব্য ‘দেশবিরোধিতার শামিল’ জানিয়ে ক্ষমা চাওয়ার দাবিতে অটল থেকে এবং সংসদ চলতে না দেওয়ার মধ্য দিয়ে বিজেপি তার রণকৌশলও স্পষ্ট করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থেকে দলীয় নেতারা বলছেন, আগে রাহুলকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তারপর অন্য কিছু। পাশাপাশি কংগ্রেসের অভিযোগ, আদানি–কাণ্ড থেকে দেশের নজর ফেরাতে বিজেপির এই চাল। ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না; কারণ, তিনি দেশের সম্মানহানি করেননি।
রাহুলকে কোণঠাসা করতে বিজেপি গোটা দলকে নামিয়ে দিয়েছে। সভাপতি জে পি নাড্ডা আজ রাহুলকে সরাসরি দেশদ্রোহী বলে উল্লেখ করেন। এএনআইকে তিনি বলেন, ‘রাহুল দেশবিরোধীদের টুলকিটের স্থায়ী অংশ হয়ে গেছেন। দুর্ভাগ্য যে কংগ্রেস দলটা দেশবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। বারবার দেশের মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে রাহুল এখন পাকাপাকিভাবে দেশবিরোধীদের টুলকিটে পরিণত।’
নাড্ডা বলেন, সেই কারণে রাহুল দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু, অনুরাগ ঠাকুর, স্মৃতি ইরানি, পীযূষ গোয়েলসহ অনেক বিজেপি নেতা একই অভিযোগ করছেন।
বিজেপির বড় একটা অংশ চাইছে, দেশবিরোধী তকমা সেঁটে রাহুলের লোকসভা সদস্যপদ খারিজ করে দিতে। সে জন্য আগেই তাঁর বিরুদ্ধে অধিকারভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে। বিষয়টি বিবেচনাধীন। কিন্তু সেই পদ্ধতি এড়িয়ে বিজেপি চাইছে, লোকসভার অধ্যক্ষের বিশেষ অনুমতিতে কমিটি গড়ে দ্রুত রাহুলের সদস্যপদ খারিজ করতে। অধিকারভঙ্গের অভিযোগ যিনি দাখিল করেছেন, ঝাড়খন্ডের সেই সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে এই কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন। ২০০৫ সালে ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিশেষ বিশেষ বিষয়ে সভায় প্রশ্ন তোলার অপরাধে ১১ জনের সদস্যপদ খারিজ করে দিয়েছিলেন লোকসভার তৎকালীন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।
কংগ্রেসসহ বিরোধীরা অবশ্য লড়াইটা একপেশে হতে দিচ্ছে না। রাজ্যসভার কংগ্রেস সদস্য কে সি বেনুগোপাল আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে সভার অধিকারভঙ্গের নোটিশ জমা দেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি কতবার বিদেশ সফরে গিয়ে কী কী বলে দেশের সম্মানহানি করেছেন, সেই তালিকাও কংগ্রেস প্রকাশ করেছে।
এতে উল্লেখ করা হয়, ২০১৫ সালে চীন সফরে গিয়ে মোদি বলেছিলেন, ‘এক বছর আগেও ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা হতো।’ মনমোহন সিংকে কটাক্ষ করে আরব আমিরাতে বলেছিলেন, ‘দুর্ভাগ্য যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাহীন অলস, অথর্ব এক সরকারের উত্তরাধিকার হয়েছি।’ বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে একাধিকবার বলেছেন, ‘গত ৭০ বছরে এ দেশে কিছুই হয়নি। যা কিছু হয়েছে, তাঁর আমলে।’ প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সমালোচনাও করেছেন। কংগ্রেসের দাবি, ক্ষমা প্রধানমন্ত্রীরই চাওয়া উচিত। মোদির বলা ভাষণের সেই অংশগুলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
কংগ্রেসের বক্তব্য, আদানি–কাণ্ডে প্রধানমন্ত্রী বিশ্রীভাবে ফেঁসে গেছেন। গৌতম আদানির উত্থানে তাঁর অবদান স্পষ্ট। জেপিসির দাবি না মানা, আলোচনার দাবি কর্ণপাত না করা তারই লক্ষণ। আদানি–কাণ্ড থেকে দেশের নজর ঘোরাতে সরকার ও বিজেপি তাই রাহুলকে টার্গেট করেছে।
দিল্লি পুলিশও রাহুলকে ঘিরতে চাইছে। ভারত জোড়ো যাত্রার সময় শ্রীনগরে রাহুল বলেছিলেন, দেশের বহু নারী যৌন নির্যাতনের শিকার। সমাজে লজ্জায় পড়তে হবে বলে পুলিশের দ্বারস্থ হচ্ছেন না। নারীরা নিজেরাই তাঁর সঙ্গে দেখা করে এই অসহায়ত্বের কথা বলেছেন। কারা শিকার, কেন রাহুল প্রকাশ্যে ওই বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন, এসব বিষয় জানতে রাহুলকে দিল্লি পুলিশ নোটিশ পাঠিয়েছে। লম্বা প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে উত্তর দিতে বলা হয়েছে। কংগ্রেস জানিয়েছে, আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে তারা।
রাহুলের মন্তব্যের পরিণতি দেখে বিজেপির সংসদ সদস্য বরুণ গান্ধী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। মোদির নেতৃত্ব দেশকে কোথায় নিয়ে চলেছে, সে–সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় যোগ দিতে বরুণকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। প্রত্যাখ্যান করে বরুণ জানিয়ে দিয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে আলোচনায় তিনি আগ্রহী নন।