ব্যবসায়ী থেকে অর্থ নিয়ে কি আদানির বিরুদ্ধে সংসদে প্রশ্ন করতেন মহুয়া

মহুয়া মৈত্র
ফাইল ছবি: এএনআই

ভারতের সংসদে অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন করার অভিযোগে ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য মহুয়া মৈত্র। যাঁর কাছ থেকে অর্থ ও অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মহুয়া প্রশ্ন তুলেছেন বলে অভিযোগ, সেই শিল্পগোষ্ঠী হিরানন্দানির সিইও দর্শন হিরানন্দানি নিজেই এক হলফনামায় মহুয়ার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন বলে সংবাদ সংস্থা পিটিআই দাবি করেছে।

সংবাদমাধ্যমের খবর, সেই হলফনামা লোকসভার ‘এথিক্স কমিটির’ কাছেও জমা পড়েছে। এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান উত্তর প্রদেশ থেকে নির্বাচিত বিজেপির বিনোদ সোনকর এনডিটিভিকে বলেছেন, প্রয়োজনে তাঁরা মহুয়াকেও তলব করবেন।

মহুয়ার বিরুদ্ধে অর্থ নিয়ে প্রশ্ন করার দুটি অভিযোগ এসেছে। একটি এনেছেন ঝাড়খন্ডের গোড্ডা থেকে নির্বাচিত বিজেপির সদস্য নিশিকান্ত দুবে। তিনি লোকসভার স্পিকারকে চিঠি লিখে মহুয়ার সদস্যপদ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। অন্য অভিযোগটি করেছেন আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদ্রাই, সিবিআইয়ের কাছে। তিনি চান তাঁর অভিযোগের সত্যাসত্য সিবিআই তদন্ত করুক।

এই সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে মহুয়া আজ শুক্রবার ‘এক্স’ হ্যান্ডেল মারফত বলেন, ‘সিবিআই ও এথিক্স কমিটিকে স্বাগত। যখন তারা ডাকবে তখন হাজির হব। আদানির পোঁ ধরা মিডিয়া কী বলল, কী লিখল তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো আগ্রহ বা সময় কোনোটাই আমার নেই। আমি এখন নদিয়ায় (নির্বাচনী কেন্দ্র) দুর্গাপূজা উপভোগ করছি। শুভ ষষ্ঠী।’

লোকসভার এথিক্স কমিটিতে বিজেপিরই যে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা রয়েছে, ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে মহুয়া সে কথাও জানাতে ভোলেননি। বিনোদ সোনকর আবার জানিয়েছেন, অভিযোগকারী নিশিকান্ত দুবেকে ২৬ অক্টোবর কমিটির বৈঠকে তলব করা হয়েছে। দরকার হলে মহুয়াকেও ডাকা হবে।

আইনজীবী দেহাদ্রাই কিছুদিন আগেও মহুয়ার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। দুজনের সম্পর্ক নানা কারণে ভেঙে যায়। মহুয়ার দাবি, তার পর থেকেই দেহাদ্রাই তাঁর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন। অভিযোগ, তিনিই নাকি মহুয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ‘তথ্য’ দুবের হাতে তুলে দিয়েছেন।

দুবে ও দেহাদ্রাইয়ের অভিযোগের চরিত্র প্রায় একই ধরনের। তাঁদের দাবি, হিরানন্দানি গোষ্ঠীর হয়ে শিল্পপতি আদানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রশ্ন মহুয়া লোকসভায় এনেছেন। অভিযোগটি জানাজানি হওয়ার পর হিরানন্দানি গোষ্ঠী এক বিবৃতিতে সবকিছু অস্বীকারও করেছিল।

তিন দিন আগে দেওয়া হিরানন্দানি গোষ্ঠীর সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তাঁরা ব্যবসায় আছেন, রাজনীতির ব্যবসায় নন। সেই সংস্থার সিইও দর্শন হিরানন্দানির সই করা এক হলফনামা থেকে উল্লেখ করে পিটিআই গত বৃহস্পতিবার জানায়, তিনি নাকি সব অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছেন।

পিটিআইয়ের দাবি অনুযায়ী, হলফনামায় দর্শন হিরানন্দানি বলেছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইন্ডিয়ান অয়েল যখন তাঁর বদলে আদানি গোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস কিনতে আগ্রহী হয়, তখন তিনি মহুয়ার সংসদীয় ই-মেইল অ্যাকাউন্টে লগইন করে আদানির বিরুদ্ধে প্রশ্ন দাখিল করেছিলেন। তিনি বলেছেন, মহুয়াই নাকি তাঁকে তাঁর সংসদীয় ই-মেইল অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন, যাতে তিনি সরাসরি প্রশ্ন পাঠাতে পারেন।

মহুয়াকে ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষী’ বর্ণনা করে হিরানন্দানি হলফনামায় লিখেছেন, তিনি দ্রুত খ্যাতি চান। সেই কারণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণের লক্ষ্য করেন। মহুয়া ভেবেছিলেন, আদানিকে আক্রমণ করলে মোদির ভাবমূর্তি কলুষিত করা যাবে। তাই হিরানন্দানি নাকি মহুয়ার প্রস্তাব মেনে তাঁকে আদানিবিরোধী তথ্যাদি দিতে থাকেন, যেগুলো তিনি সংসদে তোলেন।

এই হলফনামায় মহুয়াকে নানা সময়ে নানা দামি উপহার দেওয়ার কথাও হিরানন্দানি লিখেছেন। বলেছেন, মহুয়ার সরকারি বাড়ি সাজানোর খরচ দিয়েছেন। বিদেশে দেখভাল করেছেন। দামি উপহার দিয়েছেন।

পিটিআইয়ের দাবি, কেন মহুয়াকে তিনি ভরসা করেছিলেন—সেই কথাও হিরানন্দানি হলফনামায় লিখেছেন। হিরানন্দানি ভেবেছিলেন, মহুয়ার সাহচর্যে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোয় তাঁর ব্যবসায়িক লাভ হবে। ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বাণিজ্য সম্মেলনে তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক মহুয়ার সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল। সেই থেকে ঘনিষ্ঠতা।

ওই হলফনামা সম্পর্কে মহুয়া অবশ্য একাধিক প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর দাবি, হলফনামাটি সাদা কাগজে লেখা ও সই করা। হিরানন্দানি গোষ্ঠীর প্যাডে তা লেখা হয়নি। কোনো প্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত, সম্মানীয় ব্যবসায়ী এভাবে সাদা কাগজে লেখা হলফনামায় সই করতে পারেন না, যদি না তাঁকে তেমন করতে বাধ্য করা হয়। সেই হলফনামা ‘নোটারি’ করাও হয়নি।

মহুয়া বলেছেন, হিরানন্দানি সংবাদ সম্মেলন করতে পারতেন। ‘স্বীকারোক্তি’ দিতে পারতেন আনুষ্ঠানিকভাবে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা যাবতীয় অভিযোগ টুইট করে জানাতে পারতেন। সাদা কাগজে সই করবেন কেন? মহুয়া আরও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে বলেছেন, ওই গোষ্ঠীই তিন দিন আগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপির আনা অভিযোগ সরাসরি ভিত্তিহীন জানিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছিল। তাহলে এমন কী হলো যে তিন দিনের মাথায় তিনি পুরোপুরি অন্য কথা বলছেন?

উত্তরটাও মহুয়া তাঁর মতো করে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ওই হলফনামা তৈরি করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হিরানন্দানিকে তাতে সই করতে বাধ্য করা হয়েছে। মহুয়ার কথায়, ওই হলফনামা এক মস্ত বড় কৌতুক! বিজেপির আইটি সেলের কাজ। কৌশলে তা সংবাদমাধ্যমে ফাঁসও করা হয়েছে, যাতে মানুষের নজর ঘোরানো যায়। মহুয়ার দাবি, হিরানন্দানিদের ব্যবসা-বাণিজ্য চৌপাট করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তাঁদের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যে ওই সাজানো হলফনামায় তাঁদের সই করানো হয়েছে।