বিজেপির সঙ্গে কত দিন নিশ্চিন্তে থাকবেন নীতীশ

শপথ অনুষ্ঠানে দুই উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরী ও বিজয় কুমার সিনহার সঙ্গে নীতীশ কুমার (বাঁ থেকে দ্বিতীয়)। ২৮ জানুয়ারি পাটনায়ছবি: এএনআই

জোটত্যাগের জন্য কংগ্রেসকে দুষছেন নীতীশ কুমার। বলেছেন, শতাব্দীপ্রাচীন দলটা নাকি আঞ্চলিক দলগুলোকে শক্তিহীন করে মাথা তোলার চেষ্টা করছিল। সে কারণেই বিজেপির হাত ধরতে তিনি বাধ্য হয়েছেন। জেডিইউ সভাপতি ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর এ দাবি কিন্তু নস্যাৎ করে দিলেন তাঁর নবগঠিত সরকারের উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরী।

শপথ গ্রহণ মিটতে না মিটতেই গতকাল সোমবার পাটনায় হাটে হাঁড়ি ভেঙে সম্রাট বলেছেন, নীতীশ কুমারই বিজেপির শরণাপন্ন হয়েছিলেন দল অটুট রাখতে। কেননা, তিনি বুঝতে পারছিলেন, এভাবে চললে লালু প্রসাদের আরজেডি তাঁর ঘর ভেঙে দেবে।

বিজেপিতে যাঁরা নীতীশের ঘোর সমালোচক বলে পরিচিত, প্রদেশ সভাপতি সম্রাট চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। তাঁরই মতো নীতীশের সমালোচক অন্য উপমুখ্যমন্ত্রী বিজয় সিনহাও। বিজেপি আমলে স্পিকার হিসেবে একটা সময় বিধানসভায় নীতীশের সঙ্গে তাঁর তুলকালাম কাণ্ড বেধেছিল।

বিজেপির আগ্রাসন রুখতেই মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরে বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন। এর ফলে তাঁর দল দুই টুকরা হয়েছে। কে বলতে পারে, রাজনৈতিক জীবনের সায়াহ্নে নীতীশের ভাগ্যে কী লেখা আছে।

বিজেপিদলীয় নতুন দুই উপমুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গী করে নীতীশ কত দিন নিশ্চিন্তে থাকবেন, রাজ্য রাজনীতিতে সেই শঙ্কা ইতিমধ্যেই জেগে উঠেছে। জনপ্রিয় ধারণা, নবমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু রাজ্য পরিচালনার চাবিকাঠি থাকবে বিজেপিরই হাতে।

এ ধারণার প্রথম নমুনা সুশীল মোদিকে উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নীতীশের না পাওয়া। নীতীশ ও সুশীল মোদি দুজনেই পুরোনো সমাজবাদী। জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন থেকে উঠে আসা। পরবর্তী সময়ে বিজেপির নেতা হলেও সুশীলের সঙ্গে নীতীশের সম্পর্ক মধুরই। এমনকি, উপমুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও নীতীশের সঙ্গে সুশীল চমৎকারভাবে মিলেমিশে কাজ করেছেন।

সেই সুশীলকে বিজেপি রাজ্য থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে কেন্দ্রে, রাজ্যসভার সদস্য করে। রাজ্যে দলের বিস্তারের দায়িত্ব দিয়েছে পরবর্তী প্রজন্মের নেতাদের। সম্রাট চৌধুরী ও বিজয় সিনহা তাঁদের অন্যতম।

সম্রাট চৌধুরী যা বলেছেন, তাতে সারবত্তা আছে। সে কারণেই মাসখানেক আগে দলের সভাপতি রাজীব রঞ্জন সিংয়ের (লালন) হাত থেকে দলের সভাপতিত্ব কেড়ে নীতীশ নিজের হাতে নেন। দলে যাঁরা আরজেডির সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলতেন, লালন ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

বিজেপিদলীয় নতুন দুই উপমুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গী করে নীতীশ কত দিন নিশ্চিন্তে থাকবেন, রাজ্য রাজনীতিতে সেই শঙ্কা ইতিমধ্যেই জেগে উঠেছে। জনপ্রিয় ধারণা, নবমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু রাজ্য পরিচালনার চাবিকাঠি থাকবে বিজেপিরই হাতে।

তবে অন্তত সাতজন বিধায়ক নীতীশকে চাপ দিচ্ছিলেন মহাজোট ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাতে। ওই বিধায়কদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বিজেপির সাহচর্য না পেলে লোকসভার ভোটে তাঁদের হার অবধারিত। নীতীশও বুঝতে পেরেছিলেন, জোট না বদলালে ওই বিধায়কদের ধরে রাখা কঠিন হতে পারে।

বিজেপি ও লালু প্রসাদের আরজেডিকে ভয় পাওয়ার সংগত কারণও নীতীশের রয়েছে। ১০ বছর আগেও রাজ্যে তাঁদের দল জেডিইউ ছিল ১ নম্বর, ক্রমে তারা ৩ নম্বরে নেমে গেছে। ২০১০ সালের বিধানসভা ভোটে তারা জিতেছিল ১১৫ আসনে। প্রাপ্ত ভোটের সাড়ে ২২ শতাংশ ছিল তাঁর দলের। সেবার বিজেপি পেয়েছিল ৯১টি আসন। ভোটের হার ছিল সাড়ে ১৬। আরজেডি পেয়েছিল মাত্র ২২ আসন। ভোটের হার প্রায় ১৯। ৫ বছর পর ২০১৫ সালে জেডিইউয়ের আসন কমে দাঁড়ায় ৭১। ভোটের হার কমে ৫ শতাংশ। বিজেপির আসনও কমে। ৯১ থেকে হয় ৫৩। কিন্তু প্রাপ্ত ভোটের হার বাড়ে ৮ শতাংশ! মারাত্মকভাবে বেড়ে যায় আরজেডির আসন, ২২ থেকে ৮০। অথচ ভোটের হার ছিল প্রায় অপরিবর্তিত।

২০২০ সালে নীতীশের জেডিইউ হয় আরও শক্তিহীন। আসনসংখ্যা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪৩। ভোটের হারও কমে যায় ১ শতাংশের বেশি। বিজেপির বেড়ে হয় ৭৩, আরজেডির ৭৫। নীতীশ বুঝেছিলেন, দল ধরে রেখে ক্ষমতায় আরও কিছুদিন টিকে থাকতে হলে বিজেপির হাত ধরা ছাড়া উপায় নেই। নইলে দলও ভাঙবে, তাঁর ভাগ্যও।

এই উপলব্ধি দৃঢ় করে তোলে অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধন। নীতীশ বুঝেছিলেন, রামলহর তুলে নরেন্দ্র মোদি বানভাসি করে দেবেন রাজ্যকে। বাঁচতে গেলে তাই বিজেপির হাত ধরা ছাড়া দ্বিতীয় উপায় নেই।

কিন্তু বিজেপি কেন নীতীশকে সেই সুযোগ দিল? যখন তারা বুঝতে পারছে, মোদির ভাবমূর্তি ও রামলহর তাদের হ্যাটট্রিকের রাস্তা প্রশস্ত করে দিয়েছে?

এতে তিনটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, লোকসভা ভোটে বিহারে আগেরবারের ফলের পুনরাবৃত্তি তাদের লক্ষ্য পূরণে প্রয়োজন। ২০১৯ সালে রাজ্যের ৪০ আসনের মধ্যে এনডিএ জোট পেয়েছিল ৩৯টি। সে জন্য এবারও জাতপাতভিত্তিক বিহারে মেরুকরণ দরকার। নীতীশকে জোটে টানার অর্থ তাঁর কুর্মি সম্প্রদায়ের ৩ শতাংশ ভোট হাতে পাওয়া। নীতীশের সঙ্গেই রয়েছে অতি অনগ্রসর, নারী ও দলিতরা। সব মিলিয়ে ছবিটা হবে বিজেপির উচ্চবর্ণ, অযাদব ‘ওবিসি’ বা অনগ্রসর (মোদি নিজে ওবিসি), অতি অনগ্রসর, পাসোয়ান ও মুশাহরদের সমারোহ। সব মিলিয়ে প্রায় ৫৫ শতাংশের সমর্থন। বিপরীতে ‘ইন্ডিয়া’ জোট হবে স্রেফ মুসলমান ও যাদবদের।

দ্বিতীয়ত, নীতীশকে টানতে পারলে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দেওয়া যাবে। প্রমাণ করা যাবে, মোদি যে জোটকে ‘ঘামন্ডিয়া’ বা উদ্ধত অপদার্থ বলে কটাক্ষ করেছেন, তা কতটা সত্য। ভোটের ঠিক আগে ওই ধাক্কা ‘ইন্ডিয়া’ জোট সামলাতে পারবে না। তাদের বদনাম হবে। প্রত্যাশার যে ফানুস উড়িয়েছিল, তা চুপসে যাবে। পাশাপাশি, এ কথাও বলা যাবে, ‘ইন্ডিয়া’ জোটে প্রধানমন্ত্রী মুখ বলে কেউ রইল না। ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

তৃতীয়, জাত গণনার দাবি নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। বিহারে জাত গণনাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে তুলেছিলেন নীতীশ। আরজেডি ও কংগ্রেসও সেই সুরে সুর মিলিয়েছিল। ওই দাবি বিজেপির পক্ষে ছিল মহাবিড়ম্বনার। তারা না পারছিল তা মানতে, না উপেক্ষা করতে। নীতীশকে এনডিএতে ভেড়ানোর মধ্য দিয়ে সেই দাবি কমজোরি করে দেওয়া যাবে বলে বিজেপির ধারণা।

বারবার জোটবদলের মধ্য দিয়ে নীতীশ কুমার ক্ষমতাসীন থাকতে পারছেন ঠিকই; কিন্তু নিজের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে এনে ফেলেছেন। বিজেপি জানিয়েছে, আগামী বছর বিধানসভা ভোট পর্যন্ত নীতীশই থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী। এ ঘোষণার অন্তর্নিহিত অর্থ, বিধানসভার ভোটের পর তাঁর রাজনৈতিক জীবন ঘোর অনিশ্চিত।

বিজেপির আগ্রাসন জেডিইউর জমি কেড়ে নিচ্ছে। সে আগ্রাসন রুখতেই মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরে বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন। এর ফলে তাঁর দল দুই টুকরা হয়েছে। কে বলতে পারে, রাজনৈতিক জীবনের সায়াহ্নে নীতীশের ভাগ্যে কী লেখা আছে।