বিজেপির মুখে হঠাৎ কেন সেই পুরোনো এনডিএ জোট

ভারতের নতুন সংসদ ভবন
ছবি: এএনআই

দীর্ঘ ৯ বছর পর বিজেপির মুখে ফিরে এসেছে ‘এনডিএ’ জোটের কথা। শুরু হয়েছে সংখ্যার লড়াই। বিরোধী বনাম বিজেপি ও তার জোটবন্ধুদের লড়াইয়ে দলে কারা ভারী, আপাতত চলছে সেই প্রতিযোগিতা। নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জাতীয় রাজনীতি সরগরম।

বর্জনের পক্ষে সংখ্যাটা যদি হয় ২৫, বিজেপির পক্ষে সংখ্যাও তা হলে ২৬। সংখ্যার এই লড়াইয়ে বিরোধীদের চেয়ে তারা যে দলে ভারী, তা প্রমাণে গত দুই দিন ধরে বিজেপি অতি সক্রিয় এনডিএ জোটের পুনরুজ্জীবনে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে ক্রমেই এনডিএকে ছাপিয়ে বিজেপির মাথা উঁচু হয়েছে। ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দেওয়া সেই জোটকে সামনে এনে নরেন্দ্র মোদির সরকার ও বিজেপি প্রমাণ করতে ব্যগ্র যে আগামী রোববার নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান যত দল বর্জন করছে, তার চেয়ে বেশি দল শামিল হচ্ছে। রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন না করিয়ে দল বা সরকার অন্যায় কিছু করেনি।

দেশের ১৯টি রাজনৈতিক দল তিন দিন আগে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে অনুষ্ঠান বর্জনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। বিবৃতিতে সই না করলেও আরও ছয়টি দল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে

দেশের ১৯টি রাজনৈতিক দল তিন দিন আগে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে অনুষ্ঠান বর্জনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, জনতা দল (সংযুক্ত), আম আদমি পার্টি, এনসিপি, শিবসেনা (উদ্ধব), সিপিআই, সিপিএম, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, মুসলিম লিগ, জেএমএম, ন্যাশনাল কনফারেন্স, কেরল কংগ্রেস, আরএসপি, আরএলডি, এমডিএমকে ও ভিসিকে। যৌথ বিবৃতিতে সই না করলেও বর্জনের সিদ্ধান্তে সহমত তেলেঙ্গানার বিআরএস, হায়দরাবাদের এআইএমআইএম, আসামের এআইইউডিএফ, জম্মু–কাশ্মীরের পিডিপি, সিপিআই (এমএল) ও কর্ণাটকে কংগ্রেসের সমর্থনে একটি আসনে জয়ী সর্বোদয় জনতা পক্ষ (এসকেপি)।

সংখ্যার এই লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে বিজেপি শামিল করেছে উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ছোট ছোট দলকেও। যেমন মেঘালয়ের এনপিপি, নাগাল্যান্ডের এনডিপিপি, মিজোরামের এমএনএফ, মণিপুরের নাগা পিপলস ফ্রন্ট, সিকিমের এসকেএম, আসামের অগপ ও বোরো পিপলস পার্টি। ত্রিপুরার জোটসঙ্গী আইটিএফটিকেও তারা সমর্থক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। পুরোনো জোটসঙ্গীদের মধ্যে উত্তর প্রদেশের আপনা দল, বিহারের আরএলজেপি, মহারাষ্ট্রের আরপিআই, তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে, টিএমসি, এমকেএমকে, পিএমকে, গোয়ার মহারাষ্ট্র গোমন্তক পার্টি, হরিয়ানার জননায়ক পার্টি।

কিন্তু এসব ছোট ছোট দল নয়, বিজেপিকে আশ্বস্ত করেছে সাতটি বড় দল, যাদের অন্যতম পাঞ্জাবের শিরোমণি অকালি দল। এনডিএর শরিক থাকলেও কৃষি আইনের বিরোধিতা করে তারা জোট ছেড়েছিল। অন্যটি শিবসেনার শিন্ডে গোষ্ঠী, যারা দল ভাগাভাগি করে মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায়। বাকি চার দলের মধ্যে রয়েছে ওডিশার বিজেডি ও অন্ধ্র প্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেস।

ছোট ছোট ১৯ দল ছাড়াও বিজেপিকে আশ্বস্ত করেছে সাতটি বড় দল, যাদের অন্যতম পাঞ্জাবের শিরোমণি অকালি দল। অন্যটি শিবসেনার শিন্ডে গোষ্ঠী, যারা দল ভাগাভাগি করে মহারাষ্ট্রে ক্ষমতায়। বাকি চার দলের মধ্যে রয়েছে ওডিশার বিজেডি ও অন্ধ্র প্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেস।

জোটসঙ্গী না হয়েও ওয়াইএসআর কংগ্রেস নানাভাবে বিজেপিকে সঙ্গ দিয়ে চলেছে। এদের সঙ্গেই বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছে অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর দল টিডিপি ও উত্তর প্রদেশের মায়াবতীর দল বহুজন সমাজ পার্টি। কর্ণাটক নির্বাচনে বিজেপির ‘বিরোধিতা’ করলেও সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে জেডিএস। তাদের দলনেতা নবতিপর দেবেগৌড়া বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি আমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করেছেন। অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকবেন।

নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনকে বিজেপি তুলে ধরতে চাইছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘গণতন্ত্রের অনন্য নজির’ হিসেবে। পাশাপাশি এটাও প্রমাণের চেষ্টা চলছে, প্রধানমন্ত্রী অন্যায্য বা নজিরবিহীন কিছু করছেন না। এটা প্রমাণে বিজেপি হাজির করছে কোন রাজ্যে কংগ্রেস আমলে রাজ্যপালদের না ডেকে নতুন বিধানসভা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর মুখ্যমন্ত্রীরা করেছিলেন, সেই তালিকা। তবে বিজেপি রাষ্ট্রপতির নামোচ্চারণ করছে না। কেন রাষ্ট্রপতিকে ডাকা হয়নি অথবা তারা তাঁকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করেনি, সেই বিতর্কে বিজেপি ঢুকতে চাইছে না। বিষয়টিকে তারা পুরোপুরি কংগ্রেস–কেন্দ্রিক রাখতে চাইছে।

কংগ্রেস ও বিরোধীরা অবশ্য প্রচারকে অন্যমাত্রা দিতে ব্যস্ত। তাদের প্রচারের দুটি দিক। একটি প্রধানমন্ত্রী মোদি, তাঁর সরকার ও দল হিসেবে বিজেপি দিনের পর দিন কীভাবে ‘গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ’ করে চলেছে এবং গণতন্ত্রের পীঠস্থান থেকে ‘গণতান্ত্রিক অন্তরাত্মা শুষে’ নিয়েছে সেই প্রচার। অন্য প্রচারটি হলো, বিজেপি ও আরএসএসের ‘বর্ণবাদী’ চরিত্র। এই চরিত্র প্রমাণে তারা তুলে ধরতে চাইছে তাদের ‘আদিবাসী ও উপজাতি বিরোধিতা ও নারী বিদ্বেষকে’। বলছে, তারা ভোটের স্বার্থে এক দলিতকে ও উপজাতি নারীকে দেশের রাষ্ট্রপতি করেছে, কিন্তু অসম্মান করেছে তাঁদের দিয়ে সংসদ ভবনের শিলান্যাস কিংবা উদ্বোধন না করিয়ে। বিরোধীদের প্রচারে উঠে আসছে প্রধানমন্ত্রীর ‘তীব্র আমিত্ব ও প্রবল অহংবোধও’।

আরও পড়ুন

কংগ্রেসসহ বিরোধীরা ইতিমধ্যেই এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন আদিবাসী এলাকায় প্রচার শুরু করেছে। জনজাতি ও আদিবাসী মহলে বিজেপিবিরোধী এই প্রচার তীব্রতর করতে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। অল ইন্ডিয়া আদিবাসী কংগ্রেস আজ শুক্রবার বিভিন্ন রাজ্য, জেলা ও ব্লক পর্যায়ে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস সক্রিয় হচ্ছে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে তৎপর তৃণমূল কংগ্রেস।

মোদি জমানায় কীভাবে সংসদ ও সংসদীয় মূল্যবোধের অবমাননা হয়েছে, তার একটি তালিকা তৃণমূল কংগ্রেস তুলে ধরেছে। তাতে দেখানো হচ্ছে, রাজ্যসভার এক মনোনীত প্রার্থী (স্বপন দাশগুপ্ত) পদত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে বিজেপির হয়ে দাঁড়িয়ে হেরে এক মাসের মধ্যে ফের রাজ্যসভায় ফিরে আসেন। কীভাবে বিরোধীদের ভোটাভুটির দাবি অস্বীকার করে রাজ্যসভায় ধ্বনি ভোটে পাশ করানো হয়েছিল বিতর্কিত কৃষি বিল। কীভাবে বিজেপি আজও লোকসভায় ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করেনি। কীভাবে দিনের পর দিন সরকার পক্ষ সংসদ অচল করে রেখেছে। পৃথক রেল বাজেট বন্ধ করে দিয়েছে। অর্থ বিল পুনর্বিবেচনার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয় না বলে সরকার কীভাবে অর্থ বিলের সঙ্গে সম্পর্কহীন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিল বিনা আলোচনায় পাস করিয়ে নিচ্ছে।

নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক শিবিরের এই ভাগাভাগি স্থায়ী হলে বলা যায়, রাজ্যসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও শুধু বিজেডি ও ওয়াইএসআর কংগ্রেস সমর্থন করলে যেকোনো বিল সহজেই পাস হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে দিল্লিতে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ক্ষমতা খর্ব করতে আনা অর্ডিন্যান্স পাস করতে বিজেপিকে বেগ পেতে হবে না। বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপি এসব করছে ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগকে কাজে লাগিয়ে।

আরও পড়ুন