বিজেপি কীভাবে এত হেলিকপ্টার ভাড়া করে, কীভাবে এত গাড়ি ভাড়া করে?

কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্টের (সিপিআইএম) ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্র চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

১৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্টের (সিপিআইএম) ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক এবং জাতীয় স্তরে দলটির সর্বোচ্চ ফোরাম পলিটব্যুরোর সদস্য জিতেন্দ্র চৌধুরী এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

তিনি বাংলাদেশ–সংলগ্ন দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের জোট জিতলে তিনিই ত্রিপুরার পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারের ফাঁকে প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন দল বিজেপির প্রচার, দলটির নানা অনিয়মসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। নির্বাচনে বিজেপি আচরণবিধি লঙ্ঘন করছে দাবি করে তিনি বলেছেন, বিজেপি কীভাবে এত হেলিকপ্টার ভাড়া করে, কীভাবে তারা এত গাড়ি ভাড়া করে?

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত শনিবারের জনসভায় বারবার সিপিআইএমের দুর্নীতির কথা তুলে ধরেছেন। বিষয়টি আপনারা কীভাবে দেখছেন?

জিতেন্দ্র চৌধুরী: একজন প্রধানমন্ত্রী যদি সাধারণ বিজেপি নেতা হয়ে যান, পদ ও গরিমার প্রতি তাঁর যদি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা না থাকে, সেটা দেশের দুর্ভাগ্য। সিপিআইএম কোনো করপোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা তোলে না। যাদের কোটি কোটি কালোটাকা, তাদের কাছ থেকে সিপিআইএম পয়সা নেয় না। তারাও সিপিএমকে পয়সা দেয় না, আমরাও হাত পাতি না। জনগণই আমাদের শক্তি, জনগণের টাকাতেই দল চলে। আজকের বিজেপির দাবি, তারা চাঁদা নেয় না। তাহলে কোথা থেকে বিজেপি এত হেলিকপ্টার ভাড়া করে, কীভাবে তারা এত গাড়ি ভাড়া করে? কীভাবে এত পতাকা আসে? এটা প্রধানমন্ত্রী আগে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন যে তাঁরা টাকাটা কোথা থেকে পাচ্ছেন? এই টাকার উৎস কী? এই খরচ কোথা থেকে আসছে? ওরা যে অর্থ খরচ করছে, তার ১ শতাংশও তো আমরা করছি না। করতে পারছি না। তাহলে এত অর্থ তারা কীভাবে পাচ্ছে, এই প্রশ্ন মানুষ করবে না?
হ্যাঁ, আমরা মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলি, যদি তাঁরা তাঁদের ইচ্ছায় অর্থ দিতে চান। আমরা তো কোনো জবরদস্তি করে এই অর্থ তুলছি না বা কোনো অজানা উৎস থেকে আমাদের টাকা আসছে না। প্রধানমন্ত্রীর উচিত আগে নিজের স্বচ্ছতা দেখা, অন্যের স্বচ্ছতা খোঁজার আগে। তাঁর সৎ থাকা উচিত।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী গতকাল ভাষণে আরও একটা বিষয় ইঙ্গিত দিয়েছেন যে ত্রিপুরার রাজনৈতিক দল তিপ্রা মথা কংগ্রেস-সিপিএমকে পেছন থেকে সমর্থন দিচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার কী বক্তব্য?

জিতেন্দ্র চৌধুরী: তিপ্রা মথা আর আমাদের যদি আঁতাত হতে পারত, তাহলে তো বিজেপি আজ ঘর থেকে বেরোতেই পারত না। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আমরা চেষ্টা করলেও সেটা হয়নি। তিপ্রা মথা প্রকাশ্যে বলেছে যে ভোট ভাগ হয়ে যেন বিজেপির সুবিধা না হয়। কিন্তু তারা সেটা বললেও তার জন্য একটা (সমঝোতা) করা দরকার। সেটা তিপ্রা মথা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত করতে পারেনি। এটা হলে ভালোই হতো। কিন্তু বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রীর অন্তত নিজের সরকার এবং দলকে জিজ্ঞাসা করা উচিত যে নির্বাচনী আচরণবিধি চালু থাকা অবস্থায় কী করে বিমান পাঠিয়ে তিপ্রা মথার নেতাদের দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বৈঠক করলেন? কোন নৈতিকতায় এটা হলো? তিনি তো প্রধানমন্ত্রী, তিনি তো যেকোনো ব্যক্তি নন। আমরা বলছি, প্রধানমন্ত্রীর পদের মর্যাদা বজায় রাখুন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নিয়ে একটা উদ্বেগ আছে…।

জিতেন্দ্র চৌধুরী: হ্যাঁ, তা আছে…।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এই যে উদ্বেগ, এটা আপনারা বলছেন এবং তিপ্রা মথাও বলছে। এটাই বোধ হয় আপনাদের এবং তিপ্রা মথাকে কাছাকাছি নিয়ে আসছে। ইস্যুটাই এমন, তাই না?

জিতেন্দ্র চৌধুরী: তিপ্রা মথার সঙ্গে মৌলিক ইস্যুতে আমাদের কোনো ফারাক নেই। শুধু একটাই ইস্যুতে আমাদের মতপার্থক্য আছে। সেটা হলো গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড মানে নতুন অঞ্চল তৈরি করা বা (রাজ্য) বিভাজনের তাদের যে দাবি, তা আমরা সমর্থন করি না। অন্যান্য ইস্যুর মধ্যে সামাজিক বিষয় আছে, উন্নয়ন আছে, চাকরির ইস্যু আছে। এসব নিয়ে তো তাদের সঙ্গে কোনো মতপার্থক্য নেই।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জনজাতি সম্প্রদায়ের হাতে আরও বেশি করে ক্ষমতা দেওয়ার একটা প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, এই যে স্বশাসিত আদিবাসী পরিষদ, তা গঠন হওয়ার পরও দীর্ঘ সময় কেটে গেছে, এর বিশেষ পরিবর্তন হয়নি।

জিতেন্দ্র চৌধুরী: আমরা তো সেই কথা বারবারই বলেছি। আমরা এই ক্ষমতায়ন চাই। ওঁরাও (তিপ্রা মথা) তা–ই চান।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কিন্তু সিএএ নিয়ে একটা আতঙ্ক আমি এই পার্বত্য জনজাতি এলাকায় লক্ষ করলাম…

জিতেন্দ্র চৌধুরী: হ্যাঁ, অবশ্যই সেটা আছে। শুধু ত্রিপুরায় নয়, এটা গোটা উত্তর–পূর্বাঞ্চলেই আছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: হয়তো সেই কারণেই বিজেপি সিএএ বাস্তবায়ন করতে পারছে না?
জিতেন্দ্র চৌধুরী: হ্যাঁ।

প্রথম আলো: কংগ্রেসের সঙ্গে আপনাদের আসন সমঝোতার বেশ একটা আলোড়ন ত্রিপুরার রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে ২০১৬ সালে ত্রিপুরার মতোই সেখানেও বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে আসন সমঝোতা হয়েছিল। সিপিএমের কর্মী-সমর্থকেরা কংগ্রেসকে ভোট দিলেও কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকেরা কিন্তু তেমনভাবে বামফ্রন্টকে ভোট দেননি। এ ঘটনা যে ২০২৩ সালে ত্রিপুরায় ঘটবে না, সে সম্পর্কে আপনারা নিশ্চিত হচ্ছেন কীভাবে?
জিতেন্দ্র চৌধুরী: এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন, কেননা ত্রিপুরাতে এই যে সমঝোতা, সেটা কিন্তু ওপর থেকে নেতৃত্ব তৈরি করে দেয়নি। এই সমঝোতার পেছনে রয়েছেন একেবারে তলার দিকের সাধারণ কর্মীরা। এর কারণ, গত পাঁচ বছরে বিজেপির যে অত্যাচার, তা সাধারণ মানুষের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। মানুষ গণতন্ত্রের মধ্যে বাঁচতে চাইছেন। তাই তাঁরা বলছেন যে উন্নয়নের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্র প্রথমে ফিরিয়ে আনা। মানুষের সেই স্বতঃস্ফূর্ত যে আবেগ, সেই আবেগ থেকেই কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের সাধারণ কর্মীরা এই আসন সমঝোতা করেছেন।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: কিন্তু বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস দীর্ঘ সময় পরস্পরের বিরোধী ছিল, তাই তাদের মধ্যে কিছু তিক্ততাও আছে…

জিতেন্দ্র চৌধুরী: কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের আদর্শগত এবং কর্মসূচিভিত্তিক ফারাক অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু লড়াইয়ের জন্য একটা সমতল ভূমি তো থাকতে হবে, যাকে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বলে। একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে তবেই তো লড়াইটা করা যাবে। সংসদকে কাজ করতে হবে, বিধানসভাকে কাজ করতে হবে, এটা তো একটা মৌলিক চাহিদা। এগুলো থাকলেই তো সেই লড়াইয়ের সমতল ভূমিও থাকবে। আর যখন এই ভূমিটা থাকবে, তখনই আদর্শগত ফারাক নিয়ে এই বিতর্ক হতে পারে।

কিন্তু যখন ঘরটাই ভেঙে যাচ্ছে বা গেছে, তখন কী করব? আমি তো ঘরের ভেতরে বসেই তর্কবিতর্ক করব, সেই ঘরটাই তো শেষ করে দিচ্ছে। তর্কবিতর্কের সেই জায়গাই তো আর থাকছে না। এ পরিস্থিতিতে এই মতপার্থক্যগুলো থাকা সত্ত্বেও, একসঙ্গে আসার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাচ্ছে। একটা বৃহত্তর স্বার্থে এবং দেশকে ভালোবাসার ‘পেট্রিয়টিক’ স্বার্থেই দুটি দল কাছাকাছি চলে আসছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা থেকেই এই দুই দল আজ এক মঞ্চে আসতে বাধ্য হয়েছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে গত কয়েক বছরে। এখন আপনারা যদি ক্ষমতায় আসেন, তাহলে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার এবং এখানে আপনারা এ অবস্থায় এই উন্নতির যে ধারা তা কি ব্যাহত হবে না? তবে এটাও বলা প্রয়োজন যে আপনাদের সময়ও বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপুরার ও ভারতের সম্পর্কে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল।

জিতেন্দ্র চৌধুরী: আমাদের সময়ই উন্নতি হয়েছিল। আমাদের সময় যে বাণিজ্য শুরু হয়েছিল, তা এই পাঁচ বছরে এক পয়সাও বাড়েনি। বস্তুত, আপনি যদি খতিয়ে দেখেন, তাহলে দেখবেন যে বাংলাদেশের সঙ্গে যে আন্তর্জাতিক বিনিময়ের পরিকাঠামোগত ব্যবস্থা, তার কোনো উন্নতিই হয়নি। পাঁচ বছর আগে যা হয়েছিল, সেটাই শেষ। তারপর সব তলানিতে চলে গেছে। আপনি সীমান্তে গেলে দেখবেন যে সীমান্তের যে বাজার, যাকে বর্ডার হাট বলা হয়, তা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: জেতার ব্যাপারে আপনি কতটা আশাবাদী?

জিতেন্দ্র চৌধুরী: প্রধান ইস্যু বিজেপিকে হটাও এবং প্রগতিশীল মানুষের সরকারকে ক্ষমতায় আনা। আমি মনে করি, বিজেপি ‘সিঙ্গেল ডিজিটে’ (অর্থাৎ ৬০ আসনের মধ্যে ৯টির বেশি আসন পাবে না) থাকবে। তার পরের লক্ষ্য হলো সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রগতিশীল মানুষের সরকার তৈরি করা। এই লক্ষ্য পূরণ করার প্রশ্নে আমি ১০০ শতাংশ আশাবাদী।