বিহারে বিজেপিকে জেতাতেই কি ৮ কোটি ভোটারের নথিপত্র যাচাই করছে ইসি
সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশের পর ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসি) কী করবে, জানা না গেলেও কমিশন সূত্র অনুযায়ী, বিহারের সাড়ে ৩৫ লাখ ভোটারের নাম ইতিমধ্যে খসড়া তালিকা থেকে বাদ যেতে চলেছে। এই ব্যক্তিদের কেউ মারা গেছেন, কেউ অন্য রাজ্যে চলে গেছেন, কারও কারও নাম ভোটার তালিকায় একাধিকবার নথিবদ্ধ হয়েছে।
বিহারের প্রায় ৮ কোটি ভোটারের নথিপত্র নতুনভাবে যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এ জন্য যে বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, তা ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করতে চায় নির্বাচন কমিশন। এত কম সময়ে, মাত্র এক মাসের মধ্যে (২৪ জুন থেকে ২৬ জুলাই) এই কাজ শেষ করার তাগিদ কী, লক্ষ্য বা প্রয়োজনই–বা কী, তা নিয়ে বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলেছে। সুপ্রিম কোর্টে মামলাও রুজু হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টে প্রথম দিনের শুনানিতেই ইসির এই উদ্যোগের সময় বা টাইমিং নিয়ে সর্বোচ্চ আদালত প্রশ্ন তুলেছেন। যাচাই-বাছাইয়ের নথি জমা দেওয়ার তালিকায় আধার কার্ড, রেশন কার্ড ও ভোটার কার্ড গ্রাহ্য করার পরামর্শ দিয়েছেন। এখন দেখার, ২৬ জুলাই ইসি সেই নির্দেশ পালন করে ভোটার তালিকা প্রকাশ করে কি না। সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার পরবর্তী শুনানি ২৮ জুলাই।
তালিকা সংশোধনের কাজে ইসি বিহারের প্রত্যেক ভোটারকে একটি ‘এনুমারেশন ফরম’ জমা দিতে বলেছে। ইসি সূত্র জানিয়েছে, ৭ কোটি ৮৯ লাখ ভোটারের মধ্যে ইতিমধ্যে ৬ কোটি ৬০ লাখ ওই ফরম জমা দিয়েছেন, যা কিনা মোট ভোটারের ৮৮ দশমিক ১৮ শতাংশ।
কমিশন সূত্রের দাবি, তালিকায় নাম থাকলেও সাড়ে ১২ লাখ ভোটার মারা গেছেন। সাড়ে ১৭ লাখ স্থায়ীভাবে বিহার ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। তালিকায় নাম থাকলেও তাঁরা আর বিহারের ভোটার নন। এ ছাড়া সাড়ে ৫ লাখ ভোটারের নাম দুই জায়গায় নথিভুক্ত রয়েছে।
ইসির সূত্র অনুযায়ী, ‘এনুমারেশন ফর্ম’ যাচাই-বাছাইয়ের আগেই প্রায় ৩৫ লাখ ৫০ হাজার ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে। ইসির দাবি, মিয়ানমার, নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে এসে বিহারে বাস করছেন এমন কিছু মানুষের নামও তালিকায় পাওয়া গেছে। এসব নাম বাদ যাবে। ২৬ জুলাইয়ের আগে জমা পড়তে বাকি ১১ শতাংশ ‘এনুমারেশন ফরম’। তারপর পূর্ণ তালিকা।
বিতর্ক কী নিয়ে
বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে ইসির সিদ্ধান্ত। ইসি বিহারের ভোটার তালিকা সংশোধনের যে কাজে হাত দিয়েছে, তার পোশাকি নাম ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’ বা এসআইআর। বিহারে শেষবার এই পদ্ধতিতে ভোটার তালিকা যাচাই–বাছাই হয়েছিল ২০০৩ সালে। ২২ বছর পর বিধানসভা ভোটের যখন মাত্র কয়েক মাস বাকি (আগামী অক্টোবর বা নভেম্বরে ভোট) এবং যখন গোটা রাজ্য বৃষ্টি ও বন্যায় জর্জরিত, তখন মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে এই রাজসূয় যজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত করেছে।
বিহারের সব বিরোধী দল ইসির এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ। বিরোধীদের অভিযোগ, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ইসি বিজেপিকে ঠিক সেইভাবে সাহায্য করতে চাইছে, যেভাবে তারা ‘ভুয়া ভোটারের’ নাম বাদ দিয়ে মহারাষ্ট্রে বিজেপিকে ক্ষমতাসীন থাকতে সাহায্য করেছে। শুধু তা–ই নয়, বিরোধীদের অভিযোগ, এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে বিজেপি ঘুরপথে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরির কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। তারা চাইছে, অবাঞ্ছিতদের তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে ঠেলে পাঠাতে কিংবা তাঁদের ভোটারহীন নাগরিক করে রাখতে।
বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলো থেকে যেভাবে বাংলাভাষী ভারতীয়দেরও সীমান্তে নিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে, ভোটার তালিকায় এভাবে সংশোধন সেই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করবে।
ইসির নির্দেশ অনুযায়ী, ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের শুধু এনুমারেশন ফরম জমা দিলেই হবে। ১৯৮৭ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে যাঁদের জন্ম, তাঁদের নিজের অথবা মা–বাবার মধ্যে একজনের জন্মসনদ জমা দিতে হবে। ২০০৪ সালের পর যাঁদের জন্ম, তাঁদের নিজেদের সঙ্গে মা-বাবারও জন্মসনদ প্রয়োজন।
বিরোধীদের দাবি, এই নিয়মের ফাঁদে পড়ে রাজ্যের দলিত, আদিবাসী, অনগ্রসর এবং গরিব বানভাসি মানুষ ভোটাধিকার হারাবেন। অন্তত ২ কোটি ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে বিজেপি ইসিকে দিয়ে এই ছক কেটেছে।
জন্মসনদের প্রমাণ হিসেবে ইসি নির্ধারিত নথি
বৈধ ভোটারের প্রমাণ হিসেবে ইসি মোট ১১টি নথি চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: ১. কেন্দ্রীয়, রাজ্য অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মচারীর পরিচয়পত্র, পেনশনভোগীর পরিচয়, পেনশন পেমেন্ট অর্ডার। ২. ১৯৮৭ সালের আগে সরকার বা সরকারি সংস্থার দেওয়া যেকোনো ধরনের সনদ। ৩. জন্মসনদ। ৪. পাসপোর্ট। ৫. শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ। ৬. স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার প্রমাণ। ৭. বনের অধিকার প্রাপ্তির সনদ, যা কিনা আদিবাসী ও তফসিল উপজাতিদের দেওয়া হয়ে থাকে। ৮. তফসিল জাতি, উপজাতি ও অনগ্রসরদের দেওয়া সনদ। ৯. নিবন্ধিত নাগরিকত্বের প্রমাণ। ১০. বংশানুক্রমে তৈরি বংশতালিকা এবং ১১. জমি বা বাড়ি থাকার দলিল।
মজার বিষয়, এই ১১ ধরনের সনদের অনেকগুলো পেতে গেলে আধার কার্ড কিংবা রেশন কার্ড থাকা আবশ্যিক। যেমন পাসপোর্ট, স্থায়ী বাসিন্দার প্রমাণপত্র কিংবা জমি-বাড়ি কেনাবেচার ক্ষেত্রে আধার কার্ড থাকা আবশ্যক। অথচ নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় নিবন্ধনের ক্ষেত্রে এই প্রমাণপত্রগুলো গ্রাহ্য করতে রাজি নয়।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া ও বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী প্রশ্ন তুলে জানতে চেয়েছেন, আধার কার্ড, রেশন কার্ড এবং ইসির দেওয়া ভোটার কার্ড কেন বৈধ প্রমাণ হিসেবে গ্রাহ্য হবে না? কোন যুক্তিতে? কেনই–বা এত বড় একটা কাজ এক মাসের মধ্যে করে ফেলার পণ করেছে ইসি? কিসের এত তাড়াহুড়ো? বিহারে ভোটের মুখে কেন এই কর্মযজ্ঞের কাজে হাত দেওয়া হলো? কেন আরও আগে করা হয়নি, কিংবা ভোটের পর এই কাজ হাতে নেওয়া কেন হলো না?
ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজে হস্তক্ষেপ না করলেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা ইসিকে নির্দেশ দেন, ভোটারদের বৈধতা প্রমাণে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড ও রেশন কার্ডকে যেন মান্য করা হয়।
বিরোধীরা জোটবদ্ধ, বিহারের বিজেপি চিন্তিত
নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করা হলেও ইসি জানিয়েছে, গোটা দেশেই তারা এভাবে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এই সিদ্ধান্ত আসামের কাছে অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বভারতীয় সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, আসামের কর্তারা ইসিকে বলেছেন, এভাবে ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ হাতে নিতে গেলে তাঁরা বিপাকে পড়বেন। কারণ, একমাত্র আসামেই এনআরসি তালিকা তৈরি হয়েছে, যেখানে ১৯ লাখ ৬০ হাজার জনের নাগরিকত্বের প্রমাণ নেই।
নির্বাচন কমিশন এসআইআর অনুযায়ী, ভোটার তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে নাগরিকত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে আসামে অসুবিধা হতে পারে। আসামের ওই ১৯ লাখ ৬০ হাজার জনের নাগরিকত্ব নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া যায়নি। অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই ওই এনআরসি করা হয়েছিল।
বিহারের শাসক জোটও চিন্তিত। কমিশনের শর্ত পূরণ করে বৈধ ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতা নিয়ে রাজ্যের বিজেপি নেতারা নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন। তৃণমূল স্তর থেকে বিরূপ প্রতিবেদন আসতে শুরু করেছে। এই অবস্থায় রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব চিন্তিত।
রাজ্যে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ভিখু ভাই দালসানিয়া গত সোমবার দলের ২৬ জন সাংগঠনিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, জেলায় জেলায় দলীয় ভোটারদের সাহায্য করতে। তাঁদের শঙ্কা দূর করতে। প্রত্যেকে যাতে ‘এনুমারেশন ফরম’ জমা দিতে পারেন, সেই সহায়তা করতে।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, ২১ জুলাই নির্বাচন কমিশনকে হলফনামা জমা দিতে হবে। সময় মাত্র ৭ দিন। নির্বাচন কমিশন ভোটারদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিলে বাধ্য করছে। ১ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রস্তুত করার কথা ইসির। বিহারবাসীর ভাগ্যে কী আছে? কী করবেন সুপ্রিম কোর্ট?