ভারতে ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় কংগ্রেসের ৭৫২ কোটির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত

দিল্লিতে ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকার কার্যালয়
ছবি: এএনআই

ভারতের পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোট–আবহের মধ্যেই ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় কংগ্রেসের ৭৫২ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। গতকাল মঙ্গলবার রাতে ইডি এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ফলে ‘অ্যাসোসিয়েটেড জার্নাল লিমিটেডের’(এজিএল) নামে রাজধানী দিল্লিসহ দেশের বিভিন্ন শহরে থাকা কংগ্রেস দলের সব স্থাবর সম্পত্তি ইডির হাতে চলে এল। কংগ্রেস এসব সম্পত্তি–সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপকে কংগ্রেস ‘প্রতিহিংসার লজ্জাজনক রাজনীতি’ বলে বর্ণনা করেছে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘গোটা দেশ জেনে গেছে, কীভাবে বিরোধীদের মোকাবিলায় বিজেপি ভোটের সময় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে কাজে লাগায়। ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকাটি ছিল পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বর। স্বাধীনতার লড়াইয়ে কংগ্রেস তার ভূমিকার জন্য গর্বিত।’

কংগ্রেস নেতা কে সি বেনুগোপাল ও অভিষেক মনু সিংভিরা বিজেপির এই পদক্ষেপকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেছেন। বেনুগোপাল বলেছেন, ‘মনগড়া মামলা সাজিয়ে বিজেপি প্রতিহিংসার লজ্জাজনক রাজনীতি করছে। বিজেপি হয়তো ভাবছে, এভাবে ভয় দেখিয়ে কংগ্রেসকে দাবিয়ে রাখা যাবে ও মানুষের চোখে হেয় করতে পারবে। কিন্তু তা সফল হবে না। বিজেপি ভুল করছে।’

অভিষেক মনু সিংভি বলেছেন, ‘এসব করে বিজেপি পাঁচ রাজ্যের সম্ভাব্য পরাজয় থেকে মানুষের নজর ফেরাতে পারবে না। ইডি, সিবিআই বা আয়কর বিভাগ কেউই বিজেপির পরাজয় ঠেকাতে পারবে না।’

রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা ও মিজোরাম রাজ্যে বিধানসভার ভোট চলছে। দফায় দফায় ভোটের পর ফল প্রকাশ হবে ৩ ডিসেম্বর। এই আবহেই কংগ্রেসের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি।

কংগ্রেস বরাবর বলে আসছে, ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলাটা পুরোপুরি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে।

মামলাটি বেশ পুরোনো। ন্যাশনাল্ড হেরাল্ড পত্রিকা আরও পুরোনো। পরাধীন ভারতে ১৯৩৮ সালে এই পত্রিকাটি শুরু করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। প্রকাশক ছিল অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালস লিমিটেড। এই সংস্থা থেকে প্রকাশিত হতো আরও দুটি দৈনিক পত্রিকা। উর্দুতে ‘কউমি আওয়াজ’ ও হিন্দিতে ‘নবজীবন’। রাজরোষে পড়ে ১৯৪২ সালে ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার।

অবশ্য তিন বছর পর থেকে ন্যাশনাল হেরাল্ড আবার প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই সংস্থার শীর্ষ পদ ছেড়ে জওহরলাল নেহরু দেশের প্রধানমন্ত্রী হন। জাতীয়তাবাদী স্বদেশীয় চেতনায় কংগ্রেসের আদর্শ মেনে দেশ গঠনে পত্রিকাটি ভূমিকা পালন করতে থাকে।

২০০৮ সালে ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৬ সালে সেটি ডিজিটাল পত্রিকা হিসেবে আবার আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৮ সালে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় কংগ্রেসের কাছে এজেএলের ঋণ ছিল ৯০ কোটি রুপি। ২০১০ সালে কংগ্রেস এই ঋণ ‘ইয়ং ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে এক নতুন সংস্থাকে হস্তান্তর করে। সেটি একটি অলাভজনক সংস্থা। তার পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী।

দুজনের মোট শেয়ার ৭৬ শতাংশ। বাকি ২৪ শতাংশ ছিল তৎকালীন কংগ্রেস নেতা মোতিলাল ভোরা, অস্কার ফার্নান্দেজ, স্যাম পিত্রোদা ও সাংবাদিক সুমন দুবের নামে। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় এঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন বিজেপি নেতা সুব্রামানিয়াম স্বামী।

স্বামী ২০১২ সালে কংগ্রেস আমলে মামলাটি করেন। তাঁর অভিযোগ, ৯০ কোটি রুপির দেনা এজেএলের পক্ষে মেটানো সম্ভবপর নয় বলে কংগ্রেস তা মওকুফ করে দেয়। তার আগে ইয়াং ইন্ডিয়া লিমিটেড সংস্থাটি মাত্র ৫০ লাখ রুপি দিয়ে এজেএল অধিগ্রহণ করে। এর ফলে দিল্লি, মুম্বাই, লক্ষ্ণৌসহ বিভিন্ন শহরে ন্যাশনাল হেরাল্ডের স্থাবর সম্পত্তির অধিকারী হয় ইয়ং ইন্ডিয়া, যা কিনা বকলমে গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেসের সংস্থা। এভাবেই গান্ধী পরিবার অর্থ ও সম্পত্তি হস্তান্তর করেছে।

স্বামীর যুক্তি, কংগ্রেস রাজনৈতিক দল। তাদের কোনো কর দিতে হয় না। কোনো বাণিজ্যিক সংস্থাকে ঋণও তারা দিতে পারে না। তা ছাড়া ওই অধিগ্রহণও নিয়ম মেনে হয়নি। কাজেই পুরো লেনদেন বেআইনি। এবং এভাবে মাত্র ৫০ লাখ টাকা খরচ করে গান্ধী পরিবারের কংগ্রেস সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা এজেএলের ২ হাজার কোটি রুপির স্থাবর সম্পত্তির মালিক হয়ে গেল।

কংগ্রেসের যুক্তি, ইয়াং ইন্ডিয়া একটি পুরোপুরি অলাভজনক সংস্থা। এই সংস্থা কোনো শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশও দেয় না। কোনো সম্পত্তির কোনো রকম হাতবদলও হয়নি। ১৯৩৮ সালে যা কিছু কংগ্রেসের ছিল, এখনো তা কংগ্রেসেরই রয়েছে। প্রথম দফা তদন্তের পর ইডি কংগ্রেসের যুক্তিকেই মান্যতা দিয়েছিল। কিন্তু সেই কারণে ইডির তৎকালীন পরিচালক রাজেন কাটোচকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং মোদি সরকার ইডির আগের সেই সিদ্ধান্তও খারিজ করে দেয়।

সোনিয়া, রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গেকে এই মামলায় ইডি একাধিকবার জেরা করেছে। জেরা করেছে দলের অন্য নেতাদেরও। এ মামলায় সোনিয়া ও রাহুল দুজনেই জামিনে মুক্ত আছেন।