রাহুল এবার সাংবাদিকের ভূমিকায়, নিলেন সাক্ষাৎকার

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ও জম্মু–কাশ্মীরের শেষ সাবেক রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক
ফাইল ছবি: এএনআই

ভারত জোড়ো যাত্রার পর কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে নানা সময়ে নানা পেশার মানুষের সঙ্গে মিশতে দেখা গেছে। কখনো হরিয়ানায় এক হাঁটুকাদাজলে দাঁড়িয়ে তিনি ধান রোপণ করেছেন, কখনো ট্রাকচালকদের পাশে বসে পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ (দেশে ও যুক্তরাষ্ট্রে)। কখনো বা তাঁকে দেখা গেছে ছুতার মিস্ত্রি কিংবা মোটরবাইক সারাই কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে। কখনো ‘সুইগি’, ‘জোমাটোর’ডেলিভারি বয়দের বাইকের পেছনে বসে জানতে চেয়েছেন তাঁদের জীবন, দাবি, অভিযোগ ও দুর্দশার কাহিনি। তাঁর কাছে দেশের নানা শ্রেণিপেশার মানুষের মন–ব্যথা–চাহিদা জানার এটাই সেরা উপায়। সেই রাহুল এবার অবতীর্ণ সাংবাদিকের ভূমিকায়। তাঁর কথায়, এই পেশাকে কুক্ষিগত করে পছন্দমতো সংবাদ পরিবেশনে সরকার বাধ্য করছে। তথ্য জানার অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করছে।

রাহুল সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জম্মু–কাশ্মীরের শেষ সাবেক রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের, যিনি কিছুদিন আগেই অভিযোগ করেছিলেন, পুলওয়ামাকাণ্ড হয়েছিল সরকারের নিজের দোষে। অথচ তা স্বীকার না করে সেই ঘটনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

রাহুল গান্ধী এক ঘণ্টার ওই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ১৪ অক্টোবর। গতকাল বুধবার কংগ্রেসের পক্ষ থেকে তা ইউটিউবে সম্প্রচার করা হয়। সেই সাক্ষাৎকার থেকে ২৮ মিনিটের সম্পাদিত একটি অংশও কংগ্রেস প্রকাশ করেছে। সাক্ষাৎকারে রাহুলকে সংশয়ী হয়ে বলতে শোনা গেছে, বড় বড় সংবাদমাধ্যম কি এসব সম্প্রচার করবে? কে জানে, হয়তো দেখা যাবে, এই কারণে সিবিআই–ইডির সক্রিয় হয়ে উঠবে।

সত্যপাল মালিক অনেক দিন থেকেই অভিযোগ করে আসছেন, কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ২০১৯ সালের বিস্ফোরণে ভারতীয় জওয়ানদের নিহত হওয়ার ঘটনায় সরকার ও প্রশাসনের গাফিলতি ছিল। রাহুলের প্রশ্নের জবাবেও তিনি সেই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেন। ওই ঘটনার সময় মালিক ছিলেন জম্মু–কাশ্মীরের রাজ্যপাল।

সত্যপাল বলেন, সড়কপথ এড়িয়ে জওয়ানদের পরিবহনের জন্য সিআরপিএফ পাঁচটি বিমান চেয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চার মাস পর সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক পথে জওয়ানদের পরিবহন করতে হয়েছিল। কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে সংযোগকারী সড়কগুলো পর্যন্ত বন্ধ করা হয়নি।

মালিকের আরও অভিযোগ, বিস্ফোরণে ব্যবহৃত সন্ত্রাসীদের গাড়িটি ১০ দিন ধরে ওই তল্লাটে অবাধে ঘুরছিল। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। গাড়ির মালিক ও চালক আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ছাড়াও পেয়েছিলেন। অথচ প্রশাসন ছিল নির্বিকার। এই গাফিলতির কথা সত্যপাল মালিক জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তাঁকে মুখ খুলতে বারণ করেছিলেন।

সত্যপাল বলেন, তিনি ভেবেছিলেন পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাঁকে নীরব থাকতে বলা হচ্ছে। পরে বোঝেন, ওই ঘটনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। পুলওয়ামার শহীদদের স্মরণে তিনি ভোট চাইলেন!
রাহুল এই সময়ে সত্যপালের কাছে জানতে চান, পুলওয়ামার শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গেলে তাঁকে বিমান বন্দরে জবরদস্তি আটকে রাখা হয়েছিল। অনেক ঝক্কি–ঝামেলার পর তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। এত বিস্ফোরক কোথা থেকে এল, কীভাবে এল।
সত্যপাল বলেন, পাকিস্তান থেকেই এসেছিল। কারণ, দেশের ভেতর থেকে এত বিস্ফোরক সংগ্রহ করা হলে সে কথা জানাজানি হয়ে যেত।

সত্যপাল মালিক কৃষক নেতা। বিতর্কিত তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম থেকেই সরব। বিজেপির সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ‘জি হুজুর’ না হওয়ায় তাঁকে কাশ্মীর থেকে প্রথমে গোয়া ও পরে মেঘালয়ের রাজ্যপাল করা হয়। তাঁর কথায়, মেঘালয় ছিল ‘পানিশমেন্ট পোস্টিং’। সরকারের বিরোধিতা করায় তাঁর অফিসে তল্লাশিও হয়েছিল। যদিও তাঁর কথায়, জেল যেতে ভয় পান না।

সংবাদমাধ্যমকে কীভাবে সরকারের প্রচারে ব্যবহার করা হচ্ছে, সে কথা রাহুল বারবার বলেন। তাঁর কথায়, আদানি নিয়ে এত প্রশ্ন তুলেছেন অথচ সরকার নীরব। জাত গণনা নিয়েও সরকার নীরব। জরুরি কোনো বিষয় নিয়েই সরকার আগ্রহী নয়। বরং সেই স্বর চাপা দিতে সরকার অন্য বিষয় সামনে আনে। যেমন ইসরায়েল, বলিউড, ক্রিকেট। এসব নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম সরব।

সত্যপাল বলেন, ‘আদানি নিয়ে আপনার প্রচার দেশের প্রতিটি গ্রামে পৌঁছে গেছে। আপনি ২০ হাজার কোটি টাকা লগ্নির প্রশ্ন তুলেছেন। সত্যিই তো? এত বিপুল লগ্নি কোথা থেকে এল?

এ সময় রাহুল আদানির কয়লা কেলেংকারি নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য ফিনানশিয়াল টাইমস’–এর খবরটির উল্লেখ করে বলেন, ইন্দোনেশিয়া থেকে জাহাজবোঝাই কয়লা দেশে আসতে আসতে দাম বেড়ে যাচ্ছে। মানুষকে বিজলির জন্য বাড়তি দাম দিতে হচ্ছে। অথচ গণমাধ্যম এ নিয়ে খবর প্রকাশে প্রস্তুত নয়।
সত্যপাল বলেন, বিশেষ বিশেষ খবর ধামাচাপা দিতে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে গণমাধ্যমে ফোন করা হয়। পুলওয়ামা নিয়ে করণ থাপার প্রথম তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেটা সম্প্রচার না করতে গণমাধ্যমে নির্দেশ গিয়েছিল। অভিযোগ চাপা দিতে উত্তর প্রদেশে পুলিশি হেফাজতে আতিক আহমেদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ১০ দিন ধরে গণমাধ্যমকে ব্যস্ত রাখা হয়েছিল।

সত্যপালের সঙ্গের রাহুলের আলাপচারিতায় কৃষক আন্দোলন, তাতে আদানির স্বার্থ, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আইনের প্রয়োজনীয়তা, মণিপুরসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। সত্যপালের অভিযোগ, আদানির স্বার্থবিরোধী বলে কৃষকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে সরকার আজও এগোয়নি। আদানি গোষ্ঠী ফসল মজুত রাখতে বড় বড় গুদাম তৈরি করেছে। কৃষকের ফসল সস্তায় কিনে পরে বেশি দামে বেচতে চায় তারা। সেই কারণে সরকার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে আইন করতে অনিচ্ছুক।

সাক্ষাৎকারে উঠে আসে জম্মু–কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল ও রাজ্য দ্বিখণ্ডিকরণের প্রশ্নও। সত্যপাল মনে করেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের চেয়েও কাশ্মীরি সত্তা বেশি আহত হয়েছে রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়ায়। তিনি মনে করেন, অবিলম্বে তা ফিরিয়ে দিয়ে সেখানে ভোট করানো উচিত। সত্যপালের ধারণা, সরকার ওটা করেছিল পুলিশ বিদ্রোহ করতে পারে, এমন ভ্রান্ত ধারণা থেকে।

দেশের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গও এই আলাপচারিতায় উঠে আসে। মণিপুর দুটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে বলে রাহুলের কথার খেই ধরে সত্যপাল বলেন, গোটা উত্তর–পূর্বাঞ্চলে শান্তি ছিল। এরা তা অগ্নিগর্ভ করে দিয়েছে।

রাহুল মনে করেন, আগামী দিনের লড়াই ক্রমশ দুই বিচারধারার মধ্যে হতে চলেছে। দুটিই হিন্দুত্বের রকমফের। একটি গান্ধীজির অহিংস ও ভ্রাতৃত্ববোধের পথ, অন্যটি সংঘ পরিবারের কট্টর হিন্দুত্ববাদী ধারণা। সত্যপাল এই ধারণার সঙ্গে সহমত পোষণ করে বলেন, বড় গণমাধ্যম সরকারের পক্ষে থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিরাটভাবে উঠে এসেছে। তাতে মানুষের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটছে। মানুষ বেশ বুঝতে পারছে, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ।

সত্যপালের শেষ কথা, ‘আর মাত্র ছয় মাস। লিখে দিতে পারি, এই সরকার আর ক্ষমতায় ফিরতে পারবে না।’