মোদি কি ‘অনগ্রসর’ সম্প্রদায়ের, যা বলছেন রাহুল

নরেন্দ্র মোদি ও রাহুল গান্ধীফাইল ছবি: এএনআই

লোকসভা ভোটের আগে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। তাঁর কেন্দ্রে জড়িয়ে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই। উঠে গেছে সেই প্রশ্ন, মোদি জন্মগতভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত বা ‘ওবিসি’ কি না। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর দাবি, মোদি জন্মগতভাবে সাধারণ শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। ওবিসি নন। বিজেপি আমলে গুজরাট সরকার তাঁর সম্প্রদায়কে অনগ্রসর তালিকাভুক্ত করেছে।

গত সোমবার সংসদের উচ্চকক্ষ লোকসভায় রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বিতর্কে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজের বুক ঠুকে বলেছিলেন, কংগ্রেস দুরবিন নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ‘অনগ্রসর’ (ওবিসি) খুঁজে বেড়ায়। অথচ সবচেয়ে বড় অনগ্রসর যে তিনি নিজে, কংগ্রেসের নজরে তা পড়ে না। কেন পড়ে না? কারণ, কংগ্রেস কোনো কালেই ওবিসিদের দেখেনি। তাদের জন্য কিছু করেনি।

মোদির ওই দাবির জবাব দেন রাহুল। ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা চলাকালে ওডিশার ঝাড়সুগুদায় গতকাল বৃহস্পতিবার রাহুল বলেন, ‘জন্মের সময় আপনাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওবিসি ছিলেন না। ছিলেন তেলি সম্প্রদায়ভুক্ত। বিজেপি সরকার তেলি সম্প্রদায়কে ২০০০ সালে ওবিসি তালিকাভুক্ত করে। এর অর্থ, জন্মগতভাবে নরেন্দ্র মোদি অনগ্রসর ছিলেন না।

রাহুলের এই মন্তব্যই হয়ে উঠেছে ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন ঘৃতাহুতি। রে রে করে উঠেছে বিজেপির ‘আইটি সেল’ ও মন্ত্রীরা। কিন্তু তা করতে গিয়ে বিজেপি বুঝিয়ে দিয়েছে, রাহুল যা বলেছেন, তা সত্যি। জন্মের সময় নরেন্দ্র মোদি ছিলেন ‘সাধারণ শ্রেণিভুক্ত’। ওবিসি হয়েছেন পরে।

রাহুলের বিরোধিতা করতে গিয়ে সংসদবিষয়কমন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি তাঁকে ‘মিথ্যাবাদী’ প্রতিপন্নের চেষ্টা করলেও প্রমাণ করেছেন, কংগ্রেস নেতারা ভুল বলেননি। যোশির কথায়, তেলির এক উপজাতি ‘মোঢ়–ঘাঞ্চি’ সম্প্রদায়। মোদি ওই সম্প্রদায়ের মানুষ। গুজরাট সরকার ১৯৯৯ সালে সেই সম্প্রদায়কে ‘অনগ্রসর’ তালিকাভুক্ত করে। যে সময় তা করা হয়, মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন না।

যোশির মন্তব্য কংগ্রেস লুফে নিয়েছে। ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে রাহুল লেখেন, ‘মোদি জন্মগতভাবে ওবিসি নন, উনি কাগুজে ওবিসি। কারণ, জন্মের পাঁচ দশক পর পর্যন্ত তিনি ওবিসি ছিলেন না। আমার এই সত্যি কথাটা স্বীকার করে নেওয়ার জন্য বিজেপি সরকারকে ধন্যবাদ।’

রাজ্য ও কেন্দ্রের কংগ্রেস নেতারা আরও বলছেন, সেই সময় গুজরাটের পাশাপাশি দিল্লির ক্ষমতায়ও ছিল বিজেপি। এর পাল্টা বিজেপি বলার চেষ্টা করছে, মোঢ়–ঘাঞ্চিদের ওবিসিভুক্ত করার প্রচেষ্টা যখন শুরু হয়েছিল, তখন গুজরাটে শাসন করত কংগ্রেস। কিন্তু তাতে প্রমাণ হচ্ছে না রাহুল মিথ্যাবাদী অথবা মোদি জন্মগতভাবে ওবিসি।

ওবিসি নিয়ে বিজেপি বরাবরই স্পর্শকাতর। তা বেড়েছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট দৃঢ়ভাবে সারা দেশে জাত গণনার দাবি তোলায়। নীতীশ কুমার ‘ইন্ডিয়া’ জোট ছেড়ে এনডিএর হাত ধরার আগে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যে জাত গণনা করিয়েছিলেন। সারা দেশেও তা করার দাবি জানিয়েছিলেন। এখন তিনি চুপ থাকলেও কংগ্রেস, আরজেডিসহ অনেকেই এই দাবিতে সরব।

বিজেপি আবার ঐতিহাসিকভাবে জাত গণনার বিরোধী। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘও (আরএসএস)। এই দুই সমভাবাপন্ন দল ও সংগঠন বরাবর বর্ণপ্রথায় বিশ্বাসী। আরএসএস ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষে। জাত গণনা হলে শিক্ষা, চাকরি ও সরকারের সর্বত্র সমহারে সেই সমাজের প্রতিফলন ঘটানোর দাবি ঠেকানো কঠিন হবে।

সেই কারণে প্রকাশ্যে বিরোধিতার রাস্তায় না গিয়েও বিজেপি ওই দাবি প্রতিহত করে চলেছে, তা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁর সরকার কতটা ওবিসির পক্ষে। সে ক্ষেত্রে নিজের জাত তুলে ধরে তিনি বুক বাজিয়ে নিজেকে ‘সবচেয়ে বড় ওবিসি’ বলে জাহির করেছেন।

ভোটের মুখে ওবিসি সমাজের মন জিততে কিছুদিন আগে বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও অনগ্রসর নেতা প্রয়াত কর্পূরী ঠাকুরকে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ খেতাব দেওয়া হয়েছে। তার পাশাপাশি বিজেপির প্রচারে উঠে আসছে, এত বছর ধরে ওবিসি সমাজের জন্য তারা কী কী করেছে, সেই ফিরিস্তি। সেই সঙ্গে বলছে, গোটা নেহরু–গান্ধী খানদান বরাবর ওবিসিবিরোধী।

বিজেপির পাল্টা প্রচারে কংগ্রেসও সচেষ্ট। ওডিশার জনসভায় গতকাল রাহুল কংগ্রেস কর্মীদের পরামর্শ দেন, ‘প্রত্যেককে এটা বলতে হবে, প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে নিজের অনগ্রসরতা নিয়ে মিথ্যা বলেছেন। তিনি জন্মেছেন সাধারণ বর্গ হিসেবে। পরে ওবিসি হয়েছেন। বিজেপির মুখের ওপর এই কথাটা জোর দিয়ে বলতে হবে যে, তাদের অনগ্রসর প্রেম মেকি।’

মোদিকে আক্রমণ করে রাহুল এ কথাও বলেছেন, তিনি নাকি বলেন, তাঁর কাছে শ্রেণি মাত্র দুটি। ধনী ও দরিদ্র। তা তিনি কোন শ্রেণিতে পড়েন? দরিদ্র? দরিদ্র হলে সকাল–সন্ধ্যা এত দামি দামি পোশাক কী করে পরেন? এত টাকা বেতন পেলে কী করে তিনি দরিদ্র হন?

ওবিসি ও জাত গণনার দাবি নিয়ে বিজেপির অস্বস্তি কাটছে না। কংগ্রেসসহ বিরোধীদের কাছেও ‘অনগ্রসর’ প্রচারের অন্যতম ইস্যু। বোঝা যাচ্ছে, লোকসভা ভোটে প্রচারের অভিমুখ ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে।