ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি কি তাহলে ভুট্টায় আটকে আছে

যুক্তরাষ্ট্রে নিজের ভুট্টা খেতে এক কৃষক। ২৯ অক্টোবর, ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যছবি: রয়টার্স

তবে কি ভুট্টা নিয়ে টানাপোড়েনের অবসান ঘটতে চলেছে? বিহার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি আলোচনা ‘ইতিবাচক’ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নটা উঠতে শুরু করেছে।

ভুট্টার সঙ্গে বিহার জড়িয়ে পড়ছে, কারণ, ভারতে যত রাজ্যে ভুট্টা উৎপাদিত হয়, বিহার তাদের মধ্যে তৃতীয়। প্রথম কর্নাটক, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুট্টা আমদানিতে ভারত রাজি হলে বিহারের ভুট্টাচাষিদের প্রমাদ গুণতে হতে পারে। সেই ঝুঁকি কি নরেন্দ্র মোদি নেবেন? বিশেষ করে বিহারে জেডিইউয়ের সঙ্গে বিজেপিও যখন ক্ষমতায়?

গতকাল মঙ্গলবার দিনভর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধ থাকা বাণিজ্য আলোচনা চলেছে। আলোচনায় অংশ নিতে দিল্লি এসেছিলেন মার্কিন সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় ভারতের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব রাজেশ আগারওয়াল।

আলোচনার পর দুই দেশই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, কথাবার্তা হয়েছে খুবই ইতিবাচক। দুই দেশই চাইছে উভয়ের লাভের দিকে তাকিয়ে ভবিষ্যতের উপযুক্ত চুক্তি করতে। দুই দেশই আপাতত পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে।

বিবৃতিতে বলা কথাগুলো শুনতে ভালো হলেও এই বাণিজ্য আলোচনা সেই দশ হাতি শাড়ির মতো, যা দিয়ে মাথা ও পেছন দুই অঙ্গ ঢাকা দেওয়া যায় না। একটা ঢাকতে গেলে অন্যটা উন্মুক্ত হয়। ভারতের পক্ষে মার্কিন প্রস্তাব তাই ‘দো ধারি তরোয়ালের’ মতো। মেনে নিলে ঘরে বিপদের মুখোমুখি হতে হবে, না মানলে করতে হবে বাইরের বিপদের মোকাবিলা। কী করবেন নরেন্দ্র মোদি?

এই পরিস্থিতিতে লড়াইটা এখন হচ্ছে ভুট্টা নিয়ে।

এটা এখন আর গোপন নয় যে ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইছেন ভারতের কৃষি ও দুগ্ধজাত শিল্প তাঁদের জন্য উন্মুক্ত করা হোক। মোদি তা হতে দিতে চান না। কৃষিক্ষেত্রে মার্কিন রপ্তানি মেনে নিলে দেশের ৭০ কোটি কৃষিজীবীর রোষে গদি উল্টে যাবে। তা যে তিনি হতে দেবেন না, লালকেল্লা থেকে দেওয়া ভাষণে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ভুট্টা ওই কৃষিক্ষেত্রেরই একটা অঙ্গ।

যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, মার্কিন মুলুকে উৎপাদিত ভুট্টার কিছুটা অন্তত ভারতে রপ্তানি করার অনুমতি মোদি সরকার দিক। ট্রাম্পের বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘ভারত ১৪০ কোটি মানুষের দেশ বলে বড়াই করে বেড়ায় অথচ আমাদের কাছ থেকে এক বুশেল (ব্যারেলের মতো আরেক পরিমাপ, এক বুশেল প্রায় সাড়ে ২৪ কেজি) ভুট্টা কিনতে পারে না? ওরা আমাদের কাছে সব বেচবে, অথচ সামান্য ভুট্টাও কিনবে না!’

বোঝাই যাচ্ছে, এই মুহূর্তে ট্রাম্প প্রশাসনের তালিকার ১ নম্বরে রয়েছে ভুট্টা।

ভুট্টা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণও আছে।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভুট্টা উৎপাদিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২৪-২৫ সালে তারা উৎপাদন করেছে প্রায় ৩৭ কোটি ৮০ লাখ টন। এর মধ্যে রপ্তানি করেছে প্রায় ৭ কোটি ২০ লাখ টন।

২০২৫-২৬ সালে তাদের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে ৪২ কোটি ৭০ লাখ টন। রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ৭ কোটি ৫০ লাখ টন। এ অবস্থায় গোল বাধিয়েছে ট্রাম্পের বাণিজ্য শুল্কনীতি। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টাচাষিদের মাথায় বজ্রাঘাত।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদি

চিন্তায় ফেলেছে চীন

যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টাচাষিরা চীন বেঁকে বসেছে বলে চিন্তায় পড়েছেন। শুল্কনীতি নিয়ে রেষারেষির ফলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুট্টা আমদানি চীন কমিয়ে দিয়েছে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভুট্টা রপ্তানি করেছিল ১ হাজার ৮৫০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে শুধু চীনে রপ্তানি হয়েছিল ৫২৫ কোটি ডলারের ভুট্টা।

বাকি আমদানিকারকদের মধ্যে ছিল মেক্সিকো, জাপান, কানাডা ও কলম্বিয়া। তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ভুট্টা আমদানি করেছিল ১০ লাখ টনের কম। তার অর্ধেক এসেছিল মিয়ানমার থেকে, বাকিটা ছিল ইউক্রেন থেকে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ওই বছর ভারত ভুট্টা কিনেছিল মাত্র ১ হাজার ১০০ টন।

গত বছর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভুট্টা আমদানি চীন কমিয়ে দেয়। ২০২২ সালে যেখানে চীন আমদানি করেছিল ৫২৫ কোটি ডলারে, ২০২৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩৩ কোটি ১০ লাখ ডলারে। ওই বছর ভুট্টা রপ্তানি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আয়ও কমে যায় প্রায় ৫০০ কোটি ডলার।

চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য রেষারেষি শুরু হওয়ায় চীন ভুট্টা আমদানি আরও কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঠিক করেছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তারা স্রেফ ২৪০ কোটি ডলারের ভুট্টা আমদানি করবে।

এই সিদ্ধান্তে মাথায় হাত পড়েছে ট্রাম্পের।

ট্রাম্পের মাথায় হাত পড়ার কারণও আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টা উৎপাদনকারী রাজ্যগুলো হলো—আইওয়া, নেব্রাস্কা, ইলিনয়, মিনেসোটা, ইন্ডিয়ানা, উত্তর ও দক্ষিণ ডাকোটা, কানসাস, মিজৌরি, ওহায়ো ও উইসকনসিন। এসব রাজ্যের অধিকাংশ রিপাবলিকান ট্রাম্পের সমর্থক। গত নির্বাচনে তাদের অধিকাংশই ট্রাম্পকে ঢালাও ভোট দিয়েছিলেন। ভুট্টা বেচা না গেলে ট্রাম্পের সমর্থনেও ভাটা পড়বে।

মাথায় হাত পড়ায় ট্রাম্প এখন চেয়ে আছেন ভারতের দিকে। তাঁর চোখে চীনের বিকল্প দেশ একটাই। ভারত। তিনি ভাবছেন, ভারতই হতে পারে তাঁর মুশকিল আসান।

কিন্তু বিপদ ভারতেরও। ভুট্টা আমদানির সিদ্ধান্ত পথে বসাতে পারে নরেন্দ্র মোদির দল ও সরকারকে।

ভারতের বর্তমান নীতি অনুযায়ী, এখনো পর্যন্ত পাঁচ লাখ টন পর্যন্ত ভুট্টা আমদানির ওপর শুল্ক ধার্য রয়েছে ১৫ শতাংশ। তার বেশি হলে শুল্কের পরিমাণ বেড়ে হয় ৫০ শতাংশ। দ্বিতীয়ত, জিনগতভাবে পরিবর্তিত বা জেনেটিক্যালি মডিফায়েড (জিএম) ভুট্টা আমদানি ভারতে নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে যে ভুট্টা উৎপাদিত হয়, তার ৯৪ শতাংশ জেনেটিক্যালি মডিফায়েড।

ওই ভুট্টা ভারতবাসীর খাওয়ার জন্য তো নয়ই, পশুখাদ্য হিসেবেও আমদানি নিষিদ্ধ। জিএম ভুট্টা চাষও এ দেশে নিষিদ্ধ।

ভুট্টা মানুষ ও পশু—উভয়েরই খাদ্য হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু ভারতে জিএম ভুট্টা ওই দুই ক্ষেত্রেও নিষিদ্ধ। ভুট্টা যদিও অন্যভাবে ব্যবহৃত হয়। ভুট্টা থেকে ইথানল তৈরি করা যায়, যা জৈব জ্বালানির বিকল্প।

ভারতে সম্প্রতি পেট্রল-ডিজেলে ২০ শতাংশ ইথানল মেশানো হচ্ছে। এতে দূষণের মাত্রা কমছে। সেই ইথানল ভারতে তৈরি হচ্ছে মূলত আখ থেকে। ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় আখ চাষ হয়। পেট্রলে ২০ শতাংশ ইথানল মেশানো বাধ্যতামূলক হওয়ায় আখচাষিরা উপকৃত হচ্ছেন।

ভারতের রাজনীতিতে উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও পাঞ্জাবে আখচাষি, চিনি মিল বা ‘সুগার লবি’র প্রভূত প্রভাব রয়েছে। এই মহল চায় না মার্কিন মুলুকের ভুট্টা আমদানি করে তা ইথানল তৈরিতে ব্যবহৃত হোক।

যেমন বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও কর্নাটক চায় না ভুট্টা চাষে তাদের যা দখল, তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা ভুট্টা হাতিয়ে নিক। না চাওয়ার কারণও আছে। সারা পৃথিবীতেই যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদিত জিএম ভুট্টার দাম সবচেয়ে কম। ভারতে প্রস্তুত ভুট্টার গড় দাম যেখানে প্রতি কেজি ২২-২৩ রুপি, মার্কিন জিএম ভুট্টার দাম সেখানে মাত্র ১৫ রুপি।

শুধু ইথানল প্রস্তুতের জন্য মার্কিন মুলুকের জিএম ভুট্টা আমদানি করা যায়। কিন্তু ভারতের নীতি আয়োগ এখনো পর্যন্ত সেই অনুমতি দেয়নি। নীতি আয়োগের সিদ্ধান্তের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, সিদ্ধান্তটি হতে হবে রাজনৈতিক।

বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে ঠিকই, কিন্তু জট অত সহজে খোলার নয়। একদিকে রয়েছে দেশের রপ্তানিকারকদের স্বার্থ, ৫০ শতাংশ শুল্কের ধাক্কায় যাঁদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়; অন্যদিকে রয়েছে গ্রামীণ ভারতের জীবিকার প্রশ্ন ও তাকে ঘিরে তীব্র রাজনৈতিক চাপ। এই পরিস্থিতিতে শ্যাম না কুল—কোনটা রাখবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি?