পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী পার্থকে সেনাবাহিনীর হাসপাতালে নেওয়ার আবেদন

পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়
ছবি: টুইটার

তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব এবং শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে কলকাতার সেনাবাহিনীর কমান্ড হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার আবেদন জানিয়েছে ভারতের আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। কলকাতা হাইকোর্টে এ আবেদন জানিয়েছে ইডি। বর্তমানে পার্থ চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল এসএসকেএমে আছেন। বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্ট আজ রোববারই তাঁর মতামত জানাতে পারেন।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে গতকাল শনিবার রাতেই তাঁকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তির পর আজ রোববার সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তাঁর স্বাস্থ্যের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে টানা ২৭ ঘণ্টা জেরা করার পর গতকাল সকালে গ্রেপ্তার করে ইডি। তাঁকে আদালতে তোলা হলে দুই দিন ইডির হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন আদালত। এরপর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর একাধিক শারীরিক অসুস্থতা রয়েছে।

স্থানীয় সময় গত শুক্রবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে দক্ষিণ কলকাতার নাকতলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যায় ইডির একটি দল। সারা দিন তো বটেই, রাতভর পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। শনিবার সকাল ১০টার দিকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গতকাল রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইডি জানায়, পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পরিষদ ও পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির তদন্তের সূত্রে বেশ কয়েকটি জায়গায় তল্লাশি অভিযান চালানো হচ্ছে। এর সঙ্গে প্রচুর টাকার ছবিও দেওয়া হয়। ছবিগুলো ইতিমধ্যেই অন্তর্জালে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে।

পার্থ চট্টোপাধ্যায় ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব। তাঁকে গ্রেপ্তার করার আগে অর্পিতা মুখোপাধ্যায় নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করে ইডি। অর্পিতা পার্থর সহকারী বলে জানিয়েছে ইডি। গতকাল অর্পিতার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ২০ কোটি রুপি জব্দ করেন ইডি কর্মকর্তারা।

অর্পিতা মুখোপাধ্যায়কে এ মামলায় আজ রোববার আদালতে তুলবে ইডি। ইতিমধ্যে তাঁকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে গতকাল অর্পিতা সাংবাদিকদের বলেন, তিনি আইনের প্রতি আস্থা রাখছেন এবং আইন আইনের পথেই চলবে। গতকাল রাতে গ্রেপ্তারের সময় তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন, বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) চক্রান্ত করে তাঁকে ফাঁসিয়েছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া

ইতিমধ্যে গতকাল শনিবার রাতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেপ্তার নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা না বললেও তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব জানিয়েছেন, তাঁরা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাশে আছেন এবং যতক্ষণ না মহাসচিবের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ তিনি দলেই তাঁর পদে থাকছেন।

গতকাল সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ইডির তদন্তকে বিজেপির চক্রান্ত বলে চিহ্নিত করা হয়।

দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘এ ধরনের মামলায় আমাকেও জেলে ঢোকানো হয়েছিল। অথচ ওই মামলায় আরও যাঁর নাম ছিল, তাঁকে কিন্তু আজও কিছু করা হয়নি (এখানে হাকিম রাজ্য বিধানসভায় বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারীর দিকে ইঙ্গিত করলেন)। পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে আজকে গ্রেপ্তার করা হলো। কারণ, তিনি তৃণমূল কংগ্রেস দলটার সঙ্গে যুক্ত। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে বিজেপি কত দূর যেতে পারে, এটা তার প্রমাণ। আজ কংগ্রেস ও সিপিআইএম নিজেদের অতীত ভুলে বিজেপিকে সমর্থন করছে।’

দলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো তথ্যপ্রমাণ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়নি, যা পাওয়া গিয়েছে তা হলো এক নারীর বাড়ি থেকে অর্থ। ওই নারীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো সম্পর্ক নেই এবং তাঁর বক্তব্য তাঁর আইনজীবীরা বলতে পারবেন। আমরা অতীতেও দেখেছি, এ ধরনের মামলা দীর্ঘমেয়াদি হয়। আমাদের দাবি, দু-তিন মাসের মধ্যে এ মামলা শেষ করতে হবে এবং এরপর আদালত যা সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা তা মেনে নেব। আমাদের পক্ষ থেকেও একটা প্রশ্ন হলো, এই যে কোটি কোটি টাকার কথা প্রচারমাধ্যমে বলা হচ্ছে, এই টাকা কীভাবে এল বিজেপি সব কালো টাকা বাজার থেকে তুলে নেওয়ার পর (এখানে ২০১৬ সালের ডিমনিটাইজেশনের কথা বলা হচ্ছে), সেটাও তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন।’

বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত সরকার বলেন, এ ঘটনা প্রমাণ করছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের দুর্নীতি কোনো পর্যায়ে পৌঁছেছে। একদিকে চাকরির পরীক্ষায় পাস করে চাকরিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দিনের পর দিন কলকাতা শহরে বসে আন্দোলন করছেন, অনশন করছেন, কিন্তু চাকরি পাচ্ছেন না। বহু মানুষ এ কারণে আত্মহত্যা করেছেন, অথচ একদল মানুষ ঘুষ দিয়ে চাকরি পাচ্ছেন।

বিজেপির সাবেক সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, এ দুর্নীতি হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, এটা তৃণমূলের দু-একজন নেতা-নেত্রীর ব্যাপার নয়, গোটা তৃণমূল এভাবে চলছে। বাড়ি-জমি, হোটেল, রিসোর্ট—এসব বানিয়ে সব জায়গায় টাকা ঢোকানো হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে, তৃণমূল নেতাদের আত্মীয়স্বজন, পরিচিত লোকজন, বন্ধু-বান্ধব—সবাই এর সঙ্গে জড়িত। এ নীতির শিকড় অনেক গভীরে চলে গিয়েছে। আরও আগে তদন্ত করে তাঁদের ধরার কাজ শুরু হলে আরও অনেক বেশি টাকা পাওয়া যেত।

১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তিনি আগে বেসরকারি একটি সংস্থার ব্যবস্থাপনা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন।