মোদি সরকার অর্জনের চেয়ে বিভাজনকে কৌশল করেছে যে কারণে
ভারতে এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন নরেন্দ্র মোদি। ধারণা করা হচ্ছিল, এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর ১০ বছরের অর্জনগুলোকেই সামনে টেনে আনবেন। বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং মহাকাশে অভিযানের ক্ষেত্রে অর্জনগুলোকে বারবার প্রচার করবেন।
নির্বাচন–পূর্ববর্তী বিভিন্ন জনমত জরিপে আভাস দেওয়া হয়, মোদির দল বিজেপি তৃতীয়বারের মতো জয়ী হতে যাচ্ছে। তবে ছয় সপ্তাহব্যাপী নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শুরু হতে না হতেই মোদিকে নিজের অর্জনের চেয়ে বিভাজনের প্রচারের দিকে বেশি ঝুঁকতে দেখা গেছে। আর তাতে তাঁর এমন প্রচারের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। মোদির অভিযোগ, কংগ্রেস দলের নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়কে খুশি করার চেষ্টা করছে।
ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটির বেশি। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ মুসলিম।
গত ২১ এপ্রিল এক সমাবেশে মোদি বলেন, বিরোধী দল কংগ্রেস ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং ‘যাদের অনেক সন্তান আছে তাদের’ মধ্যে সম্পদ বণ্টন করে দিতে চায়। এর মধ্য দিয়ে মোদি মূলত মুসলিমদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
আরেকটি সমাবেশে মোদি নারীদের সতর্ক করে বলেন, বিরোধী দল তাদের সোনাদানা জব্দ করে তা মুসলিমদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। তাঁর অভিযোগ, কংগ্রেস একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে তাঁর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ‘ভোট জিহাদ’-এর প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। মোদি এমনটিও বলেছেন যে ধর্মের ওপর ভিত্তি করে ভারতীয় ক্রিকেটকে সাজাবে কংগ্রেস।
এটাই শেষ নয়। সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছেন, পুরো বিশ্ব এ নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। সম্প্রতি মোদি অভিযোগ করেন, ধনকুবের মুকেশ আম্বানি এবং গৌতম আদানির কাছ থেকে কংগ্রেস ‘ট্রাকভর্তি’ অর্থ নিয়েছে। অথচ কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দীর্ঘদিন ধরেই দেশের এ দুই শীর্ষ ধনী ব্যক্তির সঙ্গে মোদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলে আসছেন।
মোদির বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইতিমধ্যে একটি ভিডিও বার্তা দিয়েছেন রাহুল। সেখানে তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মতো আপনি জনসমক্ষে আদানি এবং আম্বানিকে নিয়ে কথা বলেছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কি আপনি জানেন যে তারা ট্রাকভর্তি করে অর্থ দেয়?’
মোদির মন্তব্যের ব্যাপারে দুই ব্যবসায়ীর কেউই এখনো প্রতিক্রিয়া জানাননি।
ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেস আরও অভিযোগ করেছে, মোদির মধ্যে ‘ইসলামভীতি’ (ইসলামোফোবিয়া) আছে। তাঁর বক্তব্যকে ‘বিভাজন ও বিদ্বেষমূলক’ বলে উল্লেখ করেছে দলটি।
মোদি আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন কি না, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি তদন্তের দাবি জানিয়েছে কংগ্রেস।
বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে ২০ কোটি মুসলিমের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের হার বেড়েছে। তবে মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারে এ হাতিয়ারকে ব্যবহার করায় অনেকে অবাক হয়েছেন। কারণ, তাঁদের ধারণা ছিল, মোদি ওই পথে হাঁটবেন না। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি যেসব সাফল্য পেয়েছেন, সেগুলোকে বারবার সামনে টেনে আনবেন।
দিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিআর) গবেষক রাহুল ভার্মা বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে আমি ভেবেছিলাম, মোদি তাঁর প্রচারণায় ভারতের অগ্রগতির গল্পগুলো বেশি বেশি করে শোনাবেন। তাঁরা জনগণের জন্য কী কী করেছেন, সেগুলো বলবেন।’
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, মোদির এমন মন্তব্য নতুন কিছু নয়। পূর্ববর্তী বিভিন্ন নির্বাচনী প্রচারে মোদির এ ধরনের কর্মকাণ্ডের নানা উদাহরণ তুলে ধরছেন তাঁরা। যার মধ্যে আছে ২০০২ সালে বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে গুজরাট রাজ্যে যে দাঙ্গা হয়েছিল, তারপর মোদির দেওয়া কিছু বিদ্বেষমূলক বক্তব্য।
ওয়াশিংটনে কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশেষজ্ঞ মিলন বৈষ্ণব বলেন, ‘সুতরাং, এতে আমি বিস্মিত হইনি, কিন্তু বিষয়টি আমাকে মর্মাহত করেছে।’
২০১৯ সালে ৩০৩টি আসনে জয়ী হয়েছিল মোদির দল। এবার তারা ৩৭০টি আসনে জয়ের আশা করছে। আর মিত্র দলগুলোর আসন মিলে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ৪০০-এর বেশি আসনে জয়ী হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। তবে তাদের ‘আবকি বার, চার শ পার’ (এবার, ৪০০-এর বেশি) স্লোগানটি যেন হিতে বিপরীত হয়ে উঠছে। বিরোধী দলগুলো এই স্লোগানকে পাল্টা এনডিএর বিরুদ্ধেই ব্যবহার করছে।।
দিল্লিভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিআর) গবেষক রাহুল ভার্মা বলেন, বিরোধীরা এই স্লোগানের ব্যাখ্যা এভাবে দিচ্ছে যে, তারা (বিজেপি) যদি এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসে, তবে তারা সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে। বিরোধীরা দরিদ্র এবং নিম্নবর্ণের মানুষদের ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। আর প্রাক্-নির্বাচনী জরিপগুলোতে মানুষের মধ্যে অর্থনীতি নিয়ে যে উচ্চমাত্রার উদ্বেগ দেখা গেছে, তাতে বিরোধীদের এমন প্রচারের প্রতি কিছুটা আকর্ষণ তৈরি হয়েও যেতে পারে।’
ভার্মা মনে করেন, এতেই হয়তো মোদি বিষয়টিতে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নির্বাচনী প্রচারে ‘হিন্দু-মুসলিম’ বিভাজন টেনে আনছেন।
মোদির বিভাজনমূলক বক্তব্য কি হতাশার চিহ্ন?
মোদির বিভাজনমূলক বক্তব্যকে হতাশার চিহ্ন বলে মনে করেন না কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশেষজ্ঞ মিলন বৈষ্ণব। তিনি মনে করেন, অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করতেই এমনটি করছেন বিজেপি নেতা।
মিলন বৈষ্ণব বলেন, ‘হতাশা বললে মনে হবে বিজেপি হেরে যাচ্ছে, যা আমি এ ক্ষেত্রে মনে করি না। ২০১৯ সালে বিজেপি যত আসনে জয়ী হয়েছে, সেগুলো ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন আসনে জয়ী না হলে বিজেপির জন্য ৪০০ আসন পাওয়ার নতুন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করাটা কঠিন হবে।’
বিভাজনমূলক প্রচারণা চালিয়ে গেলেও সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদির কণ্ঠে ভিন্ন সুর শোনা গেছে। টাইমস নাউকে তিনি বলেন, ‘আমি ইসলামবিরোধী নই, মুসলিমবিরোধীও নই।’
মোদি দাবি করেছেন, তাঁর সরকারের জনকল্যাণ সুবিধাগুলো সম্প্রদায় বা ধর্মভিত্তিক নয়। তা সবার জন্যই নির্ধারিত। তিনি আরও দাবি করেছেন, মোদি সরকার সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নিশ্চয়তা দেয়।
মোদি পাল্টা অভিযোগ করেছেন, বিরোধীরা মুসলিমদের রাজনৈতিক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। তাঁর মতে, মুসলিম সম্প্রদায় কী পরিস্থিতিতে আছে, তা তাদের নিজেদেরই তুলে ধরা উচিত।
মোদি বলেন, নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে কী কী ঘাটতি আছে, তা নিয়ে মুসলিমদের আত্মবিশ্লেষণ করা উচিত।
সারা বিশ্বে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে উল্লেখ করে মোদি বলেন, ‘উপসাগরীয় দেশগুলোতে গেলে ভারত এবং আমাকে অনেক সম্মান দেখানো হয়। আর এখানে তার উল্টো।’
ভারতে নির্বাচনে জয়ের পেছনের জটিলতা উন্মোচন করা সব সময়ই একটি চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গিলেস ভার্নিয়ারস মনে করেন, অতীতের অর্জনের ওপর ভিত্তি করে কোনো দলের নির্বাচনে জেতার ঘটনা বিরল।
ভার্নিয়ারস বলেন, ‘ভোটাররা বরং দেখে, যেসব দল এবং প্রার্থীরা যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তা তাদের চাওয়া পূরণ করতে পারবে কি না।’
ভার্নিয়ারস মনে করেন, অতীতে নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি, নিরাপত্তা ও জাতীয়তাবাদের মতো বিষয়গুলোতে জোর দিয়েছিল। এবার তারা ভোটারদের জন্য খুব বেশি নতুন ধারণা নিয়ে আসতে পারেনি। এ কারণে জাতিগত ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ তীব্র হয়েছে।
মোদি এবং তাঁর দল হয়তো একমত হবে না। তবে একটি বিষয় অনস্বীকার্য: এ নির্বাচন এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষের ব্যাপক জয়ের ইঙ্গিত দেয়নি। কে জয়ী হচ্ছে, কে হারছে—সে ধরনের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
রাজনীতি বিশ্লেষক প্রতাপ ভানু মেহতা বলেন, ‘রাজনীতিতে কখনোই একঘেয়েমির শক্তিকে অবমূল্যায়ন করবেন না।’
অনেকে যে বলছে বিজেপি ‘বিচলিত’ হয়ে উঠেছে, তার কারণ হয়তো এটাই।