মণিপুরে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৫ জন

গত মে মাস থেকে শুরু হওয়া সহিংসতায় মণিপুরে দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন
ফাইল ছবি: এএনআই

ভারতের মণিপুর রাজ্যে গত মে মাসে সহিংসতা শুরু হওয়ার দিন কয়েকের মধ্যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং নিহত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যার হিসাব দিয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ প্রায় চার মাস মুখ খোলেনি স্থানীয় প্রশাসন। শুক্রবার রাজ্য পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল (অপারেশনস) আই কে মুইভারের দেওয়া বেশ কয়েকটি তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে, যা থেকে মৃত্যু ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির একটি পূর্ণাঙ্গ হিসাব পাওয়া গেছে।

আই কে মুইভা নির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন, গত ৩ মে জাতিগত সহিংসতা শুরু হওয়ার পরে এখন পর্যন্ত ১৭৫ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ১৮ জন। আর নিখোঁজ রয়েছেন ৩২ জন। পারস্পরিক আস্থা তৈরির জন্য করা একটি সাংবাদিক বৈঠকে এসব তথ্য জানিয়েছেন মুইভা।

তিনি বলেছেন, অগ্নিসংযোগের ৫ হাজার ১৩২টি ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৪ হাজার ৭৮৬টি বাড়ি পোড়ানোর ঘটনা। এ ছাড়া অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে ৩৮৬টি ধর্মীয় স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৫৪টি গির্জা ও ১৩২টি মন্দির রয়েছে।

চার হাজারের বেশি অস্ত্র লুট
কত অস্ত্র লুট হয়েছে, তারও হিসাব দিয়েছেন ইন্সপেক্টর জেনারেল মুইভা। তিনি বলেছেন, সহিংসতা শুরু হওয়ার পর রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অস্ত্রাগার থেকে চার হাজারের বেশি অস্ত্র লুট করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।

একই সঙ্গে ১৫ হাজার ৫০টি গোলাবারুদ এবং ৪০০ বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও স্থানীয় পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, লুট হওয়া অস্ত্রের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে কত অস্ত্র মণিপুরে প্রবেশ করেছে, সে সম্পর্কে অবশ্য কোনো মন্তব্য করেননি মুইভা। সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং প্রভাবশালী মেইতেই সমাজের পক্ষ থেকে ধারাবাহিকভাবে বলা হচ্ছে, ক্ষুদ্র জাতিভুক্ত তফসিলি সমাজের মানুষ মিয়ানমার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র মণিপুরে নিয়ে আসছেন।

বস্তুত, আন্তর্জাতিক অস্ত্র ব্যবসার বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, ভারত যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মিয়ানমারে বিক্রি করে, তারই একটা অংশ অস্ত্র চোরাচালানকারীরা ঘুরপথে ভারতে নিয়ে আসছেন। এই বক্তব্যের প্রধান কারণ, ২০১৭-২০২১ সালের মধ্যে ভারত মিয়ানমারে অস্ত্রের তৃতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী ছিল।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) ২০২৩ সালের গোড়ায় জানিয়েছিল, মিয়ানমার যে পরিমাণ অস্ত্র আমদানি করে, তার ১৭ শতাংশ সরবরাহ করে ভারত। ভারতের আগে রয়েছে চীন, যারা ৩৬ শতাংশ অস্ত্র মিয়ানমারে রপ্তানি করে। এরপর রয়েছে রাশিয়া, দেশটি মিয়ানমারের আমদানি করা অস্ত্রের ২৭ শতাংশ সরবরাহ করে বলে জানিয়েছিল সিপ্রি।

সংঘর্ষরত দুই জেলার মধ্যকার ব্যারিকেড প্রত্যাহার
মণিপুরে ক্ষুদ্র তফসিলি জাতি এবং তফসিলি সমাজভুক্ত নয়, এমন সম্প্রদায় বসবাস করে যে দুই জেলায়, তার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল মুইভা জানিয়েছেন, মেইতেই-অধ্যুষিত বিষ্ণুপুর জেলা এবং কুকি-জোমি-অধ্যুষিত চূড়াচাঁদপুর জেলার সীমান্তে ফুগাকচাও ইখাই থেকে কাংভাই অঞ্চল পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা স্থাপন করা ব্যারিকেড বৃহস্পতিবার তুলে নেওয়া হয়েছে।

এই ব্যারিকেড গত সপ্তাহে সহিংসতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। কারণ, মেইতেই সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ ব্যারিকেডের পেছনে অবস্থান করছিলেন। একটা পর্যায়ে তাঁরা ব্যারিকেডগুলোকে ধাক্কা দিতে দিতে তা নিয়ে পুলিশের দিকে এগিয়ে যান এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর ব্যারিকেডের আড়াল থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। আত্মরক্ষার্থে নিরাপত্তা বাহিনীও গুলি চালায়, যাতে বহু মানুষ আহত হন। হতাহতের নির্দিষ্ট সংখ্যা অবশ্য জানানো হয়নি।

মনে করা হচ্ছে, মণিপুরের সংঘর্ষে এখনো পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৬০ হাজারের বেশি মানুষ। তবে এ নিয়ে পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল কিছু জানাননি।

বিজেপিশাসিত মণিপুর রাজ্য এবং কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, যার দায়িত্ব রয়েছেন অমিত শাহ, মণিপুরে এই সংঘাত থামাতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। ভারতের ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো মোটামুটি সর্বসম্মতভাবে এ কথা গত কয়েক মাসে জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এই সংঘাতের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ, কারণ এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে এখনো পর্যন্ত মুখ খোলেননি।