তরবারি দিয়ে কেক কেটে উদ্‌যাপনের ছয় মাসের মধ্যেই আবার প্যারোলে মুক্ত রাম রহিম

গুরমিত রাম রহিম সিং গ্রেপ্তার হওয়ার আগে হানিপ্রীতের সঙ্গে
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

প্যারোলে মুক্তি নিয়ে সমালোচনা থামতে না থামতেই আবারও এক মাসের জন্য মুক্তি পেয়েছেন হত্যা ও দুই শিষ্যকে ধর্ষণের অপরাধে ২০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ভারতের কথিত ধর্মগুরু গুরমিত রাম রহিম সিং। প্যারোল মঞ্জুর হওয়ার পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাম রহিম হরিয়ানার কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন।

এর আগে গত জানুয়ারিতে কারাগার থেকে ৪০ দিন প্যারোলে মুক্তি পেয়ে ডেরা সচ সউদার প্রধান রাম রহিম তাঁর পালিত কন্যা হানিপ্রীতকে সঙ্গে নিয়ে কেক কেটেছেন। সে সময় কারাগারের বাইরে এসে তিনি আগের মতোই হাজারো অনুসারী নিয়ে বৈঠক করেছেন এবং আনন্দ-উল্লাস করছেন। প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁর আনন্দ-উল্লাসের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সেই সমালোচনার রেশ শেষ হতে না হতেই আবারও ৩০ দিনের প্যারোল পেলেন রাম রহিম। দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এটা তাঁর পঞ্চম প্যারোল। তিনি মোট সাতবার প্যারোল পেয়েছেন।

জানুয়ারিতে রাম রহিমের ৪০ দিনের প্যারোল নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টর বলেছিলেন, সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্যারোল পাওয়া ডেরা সচ সউদার প্রধানের অধিকার।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘রাম রহিমের প্যারোল পাওয়ার বিষয়টি আমার জানা ছিল না। তবে তিনি যদি তা পেয়ে থাকেন, তা অবশ্যই সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পর হবে এবং এটি তাঁর অধিকার। এতে আমি হস্তক্ষেপ করব না।’

ইনস্টাগ্রামে গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের অনুসারীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছানো উপলক্ষে জানুয়ারিতে প্যারোল পেয়ে কেক কাটার আয়োজন করা হয়। সে সময়ের এক ভিডিও চিত্রে রাম রহিমকে বলতে শোনা যায়, ‘পাঁচ বছর পর এভাবে উদ্‌যাপন করার সুযোগ পেয়েছি, তাই আমার অন্তত পাঁচটি কেক কাটা উচিত। এটা প্রথম কেক।’
পিটিআইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে হরিয়ানা রাজ্যের রোহতাক জেলার সুনারিয়া কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর সেখান থেকে তাঁর উত্তর প্রদেশে বাগপতের বারনাওয়াতে ডেরা সচ সউদা আশ্রমে যাওয়ার কথা।

এর আগে প্যারোল নিয়ে রাম রহিম এই আশ্রম থেকেই কয়েক হাজার অনুসারীদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করছেন। ভার্চ্যুয়ালি বেশ কয়েকটি ‘সৎসঙ্গ’ বৈঠকও করেছেন।
এ ধরনের গুরুতর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া সত্ত্বেও রাম রহিম গত বছর তিন দফা কারাগারের বাইরে ছিলেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাঞ্জাবের নির্বাচনের সময় ২১ দিন, জুনে ৩০ দিন ও অক্টোবরে ৪০ দিনের জন্য তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। আর চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি তাঁকে ৪০ দিনের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়। এবার পেলেন ৩০ দিনের প্যারোল।

গত অক্টোবরে হরিয়ানার পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে রাম রহিম প্যারোল পেয়েছিলেন। সে সময় তাঁর বৈঠকে বিজেপির কয়েক রাজনীতিকের উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। এ কারণে বিরোধী দলগুলো রাম রহিমেকে বারবার প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার পেছনে বিজেপির হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করছে।

দুই শিষ্যকে ধর্ষণের অপরাধে ২০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হন রাম রহিম। ২০১৭ সাল থেকে তিনি এ মামলায় ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের সুনারিয়া কারাগারে বন্দী। এরপর একজন সাংবাদিককে হত্যার দায়ে ২০১৯ সালে যাবজ্জীবন ও ২০০২ সালে এক কর্মচারীকে হত্যার দায়ে ২০২১ সালে আবারও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

গত ফেব্রুয়ারিতে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে রাম রহিমের সাবেক গাড়িচালক খাট্টা সিং ও তাঁর ছেলে গুরদাস সিং অভিযোগ করেছিলেন, পালিত কন্যা বললেও রাম রহিমের সার্বক্ষণিক সহযোগী হওয়ার আগে হানিপ্রীত তাঁর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ২০১৭ সালে হানিপ্রীতের সাবেক স্বামী বিশ্বাস গুপ্তও দাবি করেছিলেন, পালিত কন্যা হলেও হানিপ্রীতের সঙ্গে রাম রহিমের অবৈধ সম্পর্ক ছিল।

২০১৭ সালে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে রাম রহিম বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। তাঁর লাখ লাখ অনুসারী ছিল। সিরসা শহরে ডেরা সচ সউদায় থাকতেন তিনি। সেখানে প্রতিবছর লাখ লাখ ভক্ত তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন।

গত জানুয়ারিতে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে রাম রহিম তলোয়ার দিয়ে বিশাল একটি কেক কাটছেন
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

নানা রঙের বিদেশি পোশাক ও গয়নার প্রতি ভালোবাসার কারণে রাম রহিমকে ‘রকস্টার বাবা’ নামেও ডাকা হতো। তিনি নিজের নির্মাণ করা চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়াও রক কনসার্ট করেছিলেন। ভারতের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সংস্পর্শে ছিলেন।
বিপুলসংখ্যক অনুসারী থাকায় অনেক বছর থেকেই ভারতের রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও ক্ষমতাসীন দল বিজেপির কাছে গুরুত্ব পেয়েছেন রাম রহিম। অনুসারীদের ভোট ফল পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে তিনি দুই দলেরই প্রশ্রয় পেয়েছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তিনি বিজেপির হয়ে কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে হরিয়ানা রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তিনি অনুসারীদের বিজেপিকে ভোট দিতে অনুরোধ করেছিলেন। সে বছর এ রাজ্যে বিজেপি জয় পেয়েছিল। এরপর বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খাট্টরের সঙ্গে ছবিতে তাঁকে দেখা গেছে। দোষী সাব্যস্ত হয়ে দীর্ঘ কারাবাসের পরও রাম রহিমের প্রভাব কমেনি বলে অনেকেই মনে করছেন।

১৯৪৮ সালের ২৯ এপ্রিল ডেরা সচ সউদা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান কার্যালয় হরিয়ানার সিরসা জেলায়। ভারতজুড়ে এ ডেরার প্রায় অর্ধশত আশ্রম রয়েছে। অভিনেতা, পরিচালক ও লেখক হিসেবে জনপ্রিয়তার কারণে ২০১৬ সালে ডেরাপ্রধান রাম রহিম দাদাসাহেব ফালকে চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। বেশ কয়টি গানের অ্যালবামও বেরিয়েছে রাম রহিমের। এ ছাড়া নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তিনি। এক দিনে সর্বোচ্চ পরিমাণ রক্তদানের আয়োজন করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নামও লিখিয়েছে তাঁর ডেরা।

আরও পড়ুন

রাম রহিমকে নিয়ে যেসব বিতর্ক

খ্যাতি আর ভক্তের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি বিতর্কও পিছু ধাওয়া করতে শুরু করে রাম রহিমের। ২০০২ সাল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণ, হত্যাসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ আসতে শুরু করে। তবে ডেরারই এক সাধ্বীর বেনামি চিঠিতেই পতনের সূচনা রাম রহিমের। রাম রহিমের এই কুকীর্তির কাহিনি ফাঁস করেছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক রামচন্দ্র ছত্রপতি। তাঁকে খবর দিতেন ডেরারই সাবেক সাধু রঞ্জিত। অভিযোগ, এই দুজনকেই স্বঘোষিত ধর্মগুরু খুন করান।

রাম রহিমের নিজের সন্তান জসমিত সিং ইনসান। ২০০৭ সালে তাঁকে ডেরার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করা হয়। কিন্তু হানিপ্রীতের কথায় শেষে মন পরিবর্তন করেন রাম রহিম।

রাম রহিমের বিরুদ্ধে করা মামলায় তদন্ত সংস্থা সিবিআইয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন গুরুদাস সিং তুর। তিনি ডেরার একজন সাবেক অনুসারী। গুরুদাস সিং তুর ২০১৭ সালে বলেছিলেন, হানিপ্রীত ও রাম রহিম সন্তান চেয়েছিলেন। তবে কার ঔরসে সেই সন্তানের জন্ম, তা গোপন রাখার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। মূলত ডেরার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী নির্বাচন করতেই হানিপ্রীত সন্তান চেয়েছিলেন।

গুরমিত সিং তুর বলেছিলেন, ‘জসমিত সিং ইনসানের বিপক্ষে ছিলেন রাম রহিম। তিনি জসমিতকে ডেরাপ্রধান বানাতে আগ্রহী ছিলেন না। ডেরার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন হানিপ্রীত। তিনি রাম রহিমের ঔরসে সন্তান ধারণ করতে চেয়েছিলেন। হানিপ্রীত ও রাম রহিম—দুজনই অনাগত সন্তানকে ডেরার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী বানাতে চেয়েছিলেন। তাঁদের পরিকল্পনা এমনই ছিল।’

গুরুদাসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, হানিপ্রীতের সাবেক স্বামী বিশ্বাস গুপ্তকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনাগত সন্তানের বাবা হিসেবে দেখানোর পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের আগেই তা ভেস্তে যায়। কারণ, হানিপ্রীতের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান বিশ্বাস গুপ্ত।

গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের সঙ্গে হানিপ্রীত
ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া সেকশন
আরও পড়ুন

এর আগে ডেরায় থাকা কমপক্ষে দুই হাজার নারীকে রাম রহিম ধর্ষণ করেছেন বলে জানিয়েছিলেন এক সাধ্বী। রাম রহিম কারাগারে যাওয়ার পর থেকে হরিয়ানায় সিরসার ডেরায় নিয়মিত অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে অভিযানের শুরুর দিকে বিপুল পরিমাণ কনডম ও জন্মনিরোধক ওষুধ জব্দ করা হয়। ডেরার ভেতর সাধ্বী হোস্টেলে রাম রহিমের সরাসরি যাতায়াত ছিল। ওই যাতায়াতের জন্যই দুটি গোপন সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল। এ ছাড়া ডেরায় পানির নিচে গোপন ‘সেক্সকেভ’ বা ‘যৌনগুহা’র সন্ধান পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ডেরার প্রাসাদ চত্বরে যে সুইমিংপুল রয়েছে, তার নিচেই ওই ‘যৌনগুহা’ গড়ে তুলেছিলেন ডেরাপ্রধান রাম রহিম। গোপন গুহায় নারীদের নিয়ে অনৈতিক কার্যকলাপ চালাতেন তিনি।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দুই নারী ভক্তকে ধর্ষণের অভিযোগে করা দুটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয় রাম রহিমকে। পরে একই বছরের ২৮ আগস্ট রাম রহিমকে দুটি মামলায় ১০ বছর করে ২০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেন সিবিআই আদালত।

আরও পড়ুন