শেষবার যখন অনিরুদ্ধর ভিডিও নেওয়া হয়, তখন সে আনমনা হাসপাতালের বিছানায় শুয়েছিল, তার হাতের বিভিন্ন জায়গায় নল লাগানো। তার মা মরিয়া হয়ে তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলেন। তাকে বলছিলেন, সেরে উঠলে প্রিয় খেলাগুলো সে খেলতে পারবে।
ওই ভিডিও ধারণের তিন দিন পর ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি শিশুটি হাসপাতালে মারা যায়।
মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগে অনিরুদ্ধের ডায়রিয়া ও বমি হয়েছিল। সে প্রস্রাব করতে পারছিল না। তার মা-বাবা বলেন, কাশির সিরাপ খাওয়ার পর তার এসব উপসর্গ শুরু হয়। রামনগরের স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে তাঁরা এ ওষুধ কিনেছিলেন। রামনগর হলো ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় জম্মুর ছোট একটি শহর। অনিরুদ্ধর জ্বর ও ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর তার মা–বাবা ওই কাশির সিরাপ কিনেছিলেন। তাঁরা রামনগরেরই বাসিন্দা।
হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেন, অনিরুদ্ধের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা অনেক বেশি ছিল। মা-বাবার অভিযোগ, কাশির সিরাপ খেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পাওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্থানীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলেন, ওই সিরাপে উচ্চ মাত্রায় ডাইইথাইলিন গ্লাইকলের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ডাইইথাইলিন গ্লাইকল হলো বিষাক্ত যৌগ, যা শরীরে গেলে কিডনি অকার্যকর হতে পারে এবং রোগী মারা যেতে পারে।
বিবিসিকে অনিরুদ্ধর মা বীণা কুমারী বলেন, ‘বাচ্চাটা অনেক ভুগল। ওর খাবার খেতে কষ্ট হতো, চোখ খুলতে পারত না। তার মুখ ও গাল ফুলে গিয়েছিল।’
ভারতের রামনগরে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত কাশির সিরাপ খেয়ে কমপক্ষে ১২ শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। তারা সবাই পাঁচ বছরের কম বয়সী ছিল। মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
কাশির সিরাপটি ডিজিটাল ভিশন নামের ওষুধ কোম্পানির তৈরি। প্রতিষ্ঠানটির মালিক পারশোত্তাম গয়াল। তাঁদের কোম্পানির তৈরি করা ওষুধ খেয়ে কারও মৃত্যু হওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি।
বিবিসিকে পারশোত্তাম বলেন, ‘আমরা কেন কারও সন্তানকে মেরে ফেলব? আমাদের বাড়িতেও বাচ্চা আছে। আমরা ওষুধ বানাই, বিষ নয়।’
গাম্বিয়া ও উজবেকিস্তানে ভারতের তৈরি কাশির সিরাপ খেয়ে শিশু মৃত্যুর পর রামনগরের ঘটনাটি আবারও আলোচনায় এসেছে। রামনগরের ঘটনায় ভুক্তভোগী মা-বাবারাও তাঁদের সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় ন্যায়বিচারের দাবি জানানোর সুযোগ পেয়েছেন।
এসব মা-বাবার অনেকে বলছেন, গাম্বিয়া ও উজবেকিস্তানে কাশির ওষুধ খেয়ে মৃত্যু হওয়া শিশুদের মৃত্যুর আগে যেসব লক্ষণ দেখা গেছে, সেগুলো তাঁদের সন্তানদের মধ্যেও ছিল।
বিশ্বে জেনেরিক ওষুধের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ ভারত। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভারত বিপুল পরিমাণ ওষুধ রপ্তানি করে। গাম্বিয়া ও উজবেকিস্তানে কাশির সিরাপ খেয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশের পর ভারতীয় ওষুধ কোম্পানির গুণমান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিচার কাজে দেরি
রামনগরের ঘটনায় পাঁচ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পুলিশের দুই বছর সময় লেগেছিল। ওই পাঁচ ব্যক্তির মধ্যে একজন রসায়নবিদ এবং ডিজিটাল ভিশনের তিন কর্মকর্তা রয়েছেন। স্থানীয় আদালতে এই মামলার শুনানি চলছে। এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে জেলা পুলিশের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বিবিসি। তবে তিনি সাড়া দেননি।
২০২০ সালে রামনগরে ডিজিটাল ভিশনের ওষুধ উৎপাদনকেন্দ্রটি ছয় মাসের জন্য বন্ধ ছিল। পরে আদালতের আদেশে তা আবার চালু হয়।
রামনগরে কাশির ওষুধ খেয়ে মৃত্যু হওয়া শিশুদের মা-বাবারা দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করেছেন। তেমনই একজন মুরফা বিবি। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই। আমরা চাই হত্যাকারীদের সাজা হোক।’
কাশির ওষুধ খাওয়ার ১০ দিন পর মুরফা বিবির তিন বছর বয়সী ছেলে ইরফানের মৃত্যু হয়।
সন্তানের মৃত্যুর জন্য ন্যায়বিচার চেয়ে লড়াইয়ে নামা এই মা-বাবাদের সহযোগিতা করছেন জম্মুর অধিকারকর্মী সুকেশ খাজুরা। তিনি বলেন, ‘ওই শিশুদের অকারণে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ওষুধ প্রস্তুতকারী ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তারা তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।’
সুকেশ আরও বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা যদি তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতেন, তাহলে গাম্বিয়ায় কারও মৃত্যু হতো না।
তবে ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মকর্তাদের দাবি, রামনগরের ঘটনায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
জম্মু-কাশ্মীরের ওষুধ নিয়ন্ত্রক লতিকা খাজুরিয়া বিবিসিকে বলেন, রামনগর থেকে কাশির সিরাপের নমুনা সংগ্রহ করে তা চণ্ডীগড়ের পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছিল। নমুনা পরীক্ষায় ৩৪ শতাংশের বেশি ডাইইথাইলিন গ্লাইকল পাওয়া গেছে। নমুনা পরীক্ষার এ ফলাফল কলকাতাভিত্তিক আরেক পরীক্ষাগারের মাধ্যমেও নিশ্চিত করা হয়েছে।
শিশুবিষয়ক ভবনীত ভারতীর নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল রামনগরে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত করেছিল। তারাও একই রকমের মত দিয়েছে।
কাশির সিরাপ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেও প্রাণে বেঁচে গেছে পবন কুমার। ওষুধ খাওয়ার সময় তার বয়স ছিল ১৫ মাস। তাকে তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। পরে তাকে বাড়িতে নেওয়া হয়। এখনো তার চিকিৎসা চলছে।
পবনের বাবা শম্ভুরাম বলেন, তাঁর ছেলের দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে, শ্রবণ ক্ষমতাও কমে গেছে এবং তার রক্ত চাপ বেড়ে গেছে।
অসুস্থ হয়ে পড়া শিশুদের পরিবারের দাবি, সরকার যেন তাদের সন্তানদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়।