মঙ্গলবার বিকেল চারটায় ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার শেষ হয়েছে। কোনো বড় অনুষ্ঠান না করে শেষ লগ্নের প্রচারে সব দলই এলাকাভিত্তিক প্রচার চালায়। শহরের কেন্দ্রে বিজেপি দলের রাজ্য সভাপতি এবং বনমালীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী রাজীব ভট্টাচার্য একটি দীর্ঘ মিছিল করেন। কড়া রোদের মধ্যে গেরুয়া রঙের ছাতা নিয়ে হাজারে হাজারে কর্মী–সমর্থক এই মিছিলে যোগ দেন।
রাজীব ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনে জয়ের বিষয়ে তাঁরা শতভাগ আশাবাদী। তিনি বলেন, বামফ্রন্ট-কংগ্রেস অনেক কুৎসা করেছে। কিন্তু এই শেষবেলায় তারা বুঝে গেছে যে জেতার কোনো সম্ভাবনাই তাদের আর নেই। হারের পর কংগ্রেস এবং সিপিআইএম, কে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবে, এখন তারই হিসাব শুরু হয়েছে।
এদিন ত্রিপুরায় সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক জিতেন্দ্র চৌধুরী আগরতলা প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি সেখানে আবারও কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিআইএমের কেন আসন সমঝোতা করার প্রয়োজন পড়ল, তার ব্যাখ্যা দেন। জিতেন্দ্র চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের মধ্যে অতীত বিভেদ ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু দেশের সংবিধান, গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং সংসদের মর্যাদা বজায় রাখতে আমাদের কাছাকাছি আসতে হয়েছে। এটা যে শুধু ত্রিপুরার স্বার্থে করা হয়েছে, তা–ই নয়, দেশের স্বার্থেও বামফ্রন্ট হাত মিলিয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে।’
তবে প্রচারের শেষ ঘণ্টায় আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটান ত্রিপুরার রাজা এবং অন্যতম প্রধান দল তিপ্রা মথার প্রধান প্রদ্যোৎ দেববর্মন। মঙ্গলবার হঠাৎ ঘোষণা করেন, নির্বাচনের পরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে তিনি সরে দাঁড়াবেন। পশ্চিম ত্রিপুরার সিপাহিজালা জেলার চড়িলাম বিধানসভা কেন্দ্রে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনী রাজনীতি অত্যন্ত অস্বচ্ছ হয়ে গেছে। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কোনো ইচ্ছা আর তাঁর নেই।
বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ প্রদ্যোৎ দেববর্মনের দল তিপ্রা মথা এবার ত্রিপুরা নির্বাচনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাজ্যের ৬০ বিধানসভা আসনের মধ্যে ৪২টিতে প্রার্থী দিয়েছে দলটি। মনে করা হচ্ছে, তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ২০টি আসনের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে জিতে সরকার গড়ায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে রাজার দল। এই অবস্থায় রাজা জানালেন যে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছেন।
প্রদ্যোৎ দেববর্মন বলেন, ‘এটা আমার শেষ রাজনৈতিক ভাষণ। আজকের পরে আর সক্রিয় রাজনীতিতে থাকব না। সারাক্ষণ যে কাদা–ছোড়াছুড়ি চলছে, তাতে আমি ক্লান্ত। এরপর আপনাদের রাজা আর কোনো দিন ভোট চাইতে আসবে না। এটাই শেষ লড়াই।’ পাশাপাশি তিনি তাঁর ভোটারদের এই শেষ যুদ্ধে তাঁকে জেতানোর জন্য আবেদনও জানান।
তিপ্রা মথার প্রধান বলেন, ‘সবাইকে অধিকার দেওয়ানোর এই লড়াই আমার চলবে। আমি এখান থেকে সরে গিয়ে এমন শক্তপোক্ত আইন আনব যে সবাই মনে রাখবে রাজা মানুষের জন্য লড়াই করেছেন।’
রাজা অতীতে বলেছেন, কোনো মূল স্রোতের রাজনৈতিক দল (বিজেপি, সিপিআইএম, কংগ্রেস) তিপ্রা মথার বৃহত্তর আদিবাসী রাজ্যের দাবি মেনে না নেওয়ার কারণে তাঁরা একাই নির্বাচনে লড়তে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনের দুই দিন আগে তিনি সক্রিয় রাজনীতি ছাড়ার কথা বলায় তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিস্মিত। বিজেপির স্থানীয় এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা রাজার একটা রণনীতি হতে পারে। এই নির্বাচনকে শেষ লড়াই বলে চিহ্নিত করে তিনি তাঁর ভোটারদের বলছেন এবারে অন্তত তাঁকে জিতিয়ে দিতে।’
এদিন কথা বলতে বলতে একটা পর্যায়ে রাজা প্রায় কেঁদে ফেলেন। রাজাকে কাঁদতে দেখে তাঁদেরও কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করেন।
অভূতপূর্ব নিরাপত্তা
বিধানসভা ভোটে সংঘাতের আশঙ্কায় ত্রিপুরায় অভূতপূর্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাজ্যে ৪০০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী এসে পৌঁছেছে। এক এক কোম্পানিতে মোটামুটি ১২৫ জন আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য থাকেন। সেই হিসাবে প্রতি ৫০ জন ভোটার পিছু একজন কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছেন। এই নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন অভূতপূর্ব বলে জানিয়েছেন রাজ্যের সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা। ত্রিপুরায় গত নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোটারের সংখ্যা ৮০ হাজার বেড়ে ২৮ লাখ ১৩ হাজারের কিছু বেশি হয়েছে।
রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক কিরণ গিত্যে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি রাজ্য পুলিশ এবং ত্রিপুরা স্টেট রাইফেলস নামে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য মিলিয়ে আরও ২০ হাজারের মতো সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকবেন। সোমবার রাত ১০টা থেকে ত্রিপুরায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। এতে পাঁচ বা ততোধিক লোক এক জায়গায় জমায়েত করতে পারবেন না।
তবে এসবের পরও বেশ কয়েক জায়গা থেকে গত দুই দিনে সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। সহিংসতার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে বলে জানা গেছে। ধর্মনগর বলে এক জায়গায় আক্রান্ত হয়েছেন রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রধান বর্ণালী গোস্বামী। তাঁকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে রাজ্য পুলিশ। ঠিক কী কারণে তিনি নিগৃহীত হয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। বর্ণালী গোস্বামী বলেছেন, তাঁর দলের লোকদের হাতেই অর্থাৎ বিজেপির কর্মীদের হাতেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি কর্মীদের অভিযোগ ছিল যে তিনি কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে নির্বাচনী প্রচার করছিলেন।
এই অভিযোগের জবাবে রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপারসন বলেন, ‘আমার অবাক লাগছে যে আমার নিজের দলের কর্মীরাই এই ধরনের অভিযোগ করছেন। আমি জানি না নির্বাচনের দুই দিন আগে তাঁরা কেন এই ধরনের গন্ডগোল পাকাতে চাইছেন। হয়তো তাঁরা চেয়েছিলেন যে আমি প্রার্থী হই, তা না হওয়াতেই হয়তো এই বিশৃঙ্খলা। কার কী উদ্দেশ্য আমি জানি না।’
অমিত শাহের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের অভিযোগ
এদিকে কংগ্রেস নেতা গৌরব গগৈ অভিযোগ করেছেন যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে এসে নির্বাচনী আধিকারিক ও জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করেছেন। বিষয়টি প্রচারমাধ্যমকে জানতে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেছেন, ‘এই ব্যাপারে আমরা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কথা বলব।’
গৌরব গগৈর অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে এই অভিযোগ খতিয়ে দেখে তদন্ত করার আবেদন জানিয়েছে সিপিআইএম। তবে তদন্ত শুরু করা বা তার রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার আগে অভিযুক্ত আধিকারিকদের নির্বাচনের দায়িত্ব থেকে সরানোর দাবি তুলে নির্বাচন কমিশনকে মঙ্গলবার বিকেলে চিঠি দিয়েছেন জিতেন্দ্র চৌধুরী।