দিল্লির দূষণ নিয়ে শুরু হয়েছে বিজেপি-আপ কাজিয়া

দূষণে ধোঁয়াচ্ছন্ন দিল্লি। ১৪ নভেম্বর
ছবি: এএনআই

প্রকৃতি সহায় ছিল। দূষণক্লিষ্ট দিল্লিসহ উত্তর ভারতে পশ্চিমা ঝড় ঝরিয়েছিল বৃষ্টি। বাতাসের গুণমান সূচক বা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে। দীপাবলির দিন ঝকঝকে আকাশ-বাতাস মানুষকে স্বস্তি দিয়েছিল। নেওয়া যাচ্ছিল নির্মল শ্বাস। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আতশবাজির ভয়ানক তাণ্ডব সেই স্বস্তি শুষে নিয়েছে। গতকাল সোমবার থেকে দিল্লি আবার ধোঁয়াচ্ছন্ন।

একিউআইয়ের মাত্রা আবার পৌঁছেছে বিপজ্জনক অবস্থায়। আজ মঙ্গলবারের হালও তথৈবচ। দিল্লি ঢাকা পড়েছে চেনা দূষণের চাদরে।

এ পরিস্থিতিতে দিল্লির শাসক দল আম আদমি পার্টির (আপ) সঙ্গে দেশের শাসক বিজেপির তীব্র কাজিয়া শুরু হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট নির্বাক। দেশের সর্বোচ্চ আদালতই রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় (এনসিআর) সব ধরনের আতশবাজি নিষিদ্ধ করেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন দিল্লি পুলিশ সেই নির্দেশ পালনে চূড়ান্ত ব্যর্থ। আদালতের নির্দেশের এমন অবমাননা অতীতে হয়নি। দিল্লিতে বাজি পুড়েছে অন্যবারের চেয়ে বেশি। দূষণের মাত্রাও হয়েছে লাগামছাড়া।

অথচ আগের দিন বৃষ্টির কারণে দীপাবলির দিন একিউআই সূচক ৯০-এর নিচে নেমে গিয়েছিল। গত সোমবার সকাল থেকে তা আবার ঘোরাফেরা করছে সাড়ে ৪০০-এর ওপর। এ অবস্থায় আবার শুরু হয়েছে চর্চা, কৃত্রিম বৃষ্টি রাজধানীকে বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে?

তবে ওই সব ছাপিয়ে এ মুহূর্তের বড় বিতর্ক—দিল্লি ও দেশের দুই শাসক দলের কাজিয়া।

দিল্লি বিজেপির সাবেক সভাপতি সংসদ সদস্য মনোজ তিওয়ারি দূষণের জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন আপ ও কংগ্রেসকে। তাঁর দাবি, দিল্লির জনগণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ‘গ্রিন ক্রেকার্স’ ফাটিয়েছেন।

এতে দূষণ হয় না। দূষণের কারণ অন্য। অথচ সনাতন ধর্মবিরোধী দলগুলো আতশবাজিকেই অপরাধী ঠাওরাচ্ছে। ওই দলগুলো (আপ ও কংগ্রেস) হিন্দুধর্মের চিরায়ত প্রথা (দীপাবলিতে বাজি পোড়ানো) বন্ধ করে দিতে চায়।

ঘটনা হলো, সুপ্রিম কোর্ট প্রথমে গ্রিন ক্রেকার্সের কথা বললেও পরে সব ধরনের আতশবাজির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। বিজেপি সনাতন ধর্মাচরণের প্রসঙ্গ তুলে এর বিরোধিতা করেছিল।

দীপাবলি কেটে গেলে দিল্লি বিজেপির সহসভাপতি কপিল মিশ্র বাজি পুড়িয়ে উৎসব পালনের জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, দিল্লিবাসীকে অভিনন্দন। কারণ তাঁরা অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক স্বৈরতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা মানেননি।

সুপ্রিম কোর্ট নির্বাক। সব আদালতে চলছে দীপাবলির ছুটি। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তাই এখনো কোনো বাক্য সর্বোচ্চ আদালত উচ্চারণ করেননি। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, কেন্দ্রের অধীন দিল্লি পুলিশের ‘ব্যর্থতা’ ঘিরে। আপ বলছে, দূষণ মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের ‘ব্যর্থতা’ প্রমাণে কেন্দ্র উদ্‌গ্রীব।

নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করতে পুলিশ তাই নির্বাক দর্শক থেকেছে।

এ পরিস্থিতিতে নতুন করে শুরু হয়েছে কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানো নিয়ে চর্চা।

গত সপ্তাহে দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী গোপাল রাই জানিয়েছিলেন, দূষণ কমাতে রাজ্য সরকার কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানোর কথা বিবেচনা করছে। বিষয়টি বাস্তবায়িত করতে সুপ্রিম কোর্টসহ কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। সেই অনুমোদন পেলে পরিকল্পনা, পরে বাস্তবায়ন করা যাবে দূষণ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে।

দীপাবলির আগের দিন পশ্চিমা ঝড় বৃষ্টি ঝরিয়ে স্বস্তি দেওয়ায় কৃত্রিম বৃষ্টির পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যায়।

যেমন স্থগিত হয় গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে জোড়-বিজোড় নম্বর প্রয়োগের বিষয়টিও।

কৃত্রিম মেঘ তৈরি করে বৃষ্টি ঝরানোর বিষয়টি জটিল ও খরচসাপেক্ষ। এ ছাড়া ওই বৃষ্টি দূষণ নিয়ন্ত্রণে কতটা সফল, সেই প্রশ্নও বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। পরিবেশের ওপর তার প্রভাব কতটা পড়ে, সে বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, এ পদ্ধতিতে কৃত্রিম উপায়ে বাতাসে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত করে বৃষ্টি ঝরানো হয়। সে জন্য সিলভার আয়োডাইড অথবা ক্লোরাইডের মতো ‘সল্ট’ বিমানের সাহায্যে মেঘে স্প্রে করা হয়। সেই সল্টের কণা মেঘের অভ্যন্তরে বরফকণায় পরিণত হয়। মেঘের ভেতর থাকা জলীয় বাষ্পের সংমিশ্রণের ফলে বৃষ্টি হয়।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত তুলে ধরে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, সব সময় এ পরীক্ষা সফলও হয় না।

পরিবেশবিশেষজ্ঞ পলাশ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, সে জন্য পরিবেশের পরিস্থিতি অনুকূল হওয়া জরুরি। মেঘের অভ্যন্তরের জলীয় বাষ্প ও আর্দ্রতা পরিমাণমতো থাকতে হবে, যাতে বরফকণা তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া বাতাসের গতিও এ ক্ষেত্রে জরুরি।

আরেক বিশেষজ্ঞ জে আর কুলকার্নির মতে, সল্টের কণা এক বিশেষ ধরনের মেঘের মধ্যে ছড়ানো দরকার, যে মেঘ লম্বালম্বি বৃদ্ধি পায়। আড়াআড়ি বা সমান্তরাল বিস্তৃত মেঘে সল্টকণা ছড়িয়ে লাভ নেই।

দিল্লি সরকার চেয়েছিল দিল্লির আকাশে ২০ ও ২১ নভেম্বর কৃত্রিম বৃষ্টির এ পরীক্ষা করতে। কারণ, ওই সময় পরিবেশ উপযুক্ত থাকবে বলে আবহাওয়াবিদেরা জানিয়েছিলেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল আইআইটি কানপুর। প্রথম পর্যায়ে ৩০০ বর্গকিলোমিটার আকাশে কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানোর পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু দীপাবলির আগের দিনের বৃষ্টি সেই উদ্যোগে পানি ফেলেছে। ছুটি শেষে সুপ্রিম কোর্ট খুলবে ২০ নভেম্বর। তার মধ্যে দিল্লির দূষণ পরিস্থিতির উন্নতি হলে এক কথা, না হলে অন্য। কৃত্রিম বৃষ্টির আনুমানিক খরচ হবে ১৩ কোটি রুপি।