নীতীশ-নাইডুর ওপর কতটা ভরসা রাখতে পারবে বিজেপি

দিল্লিতে এনডিএ নেতাদের বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে চন্দ্রবাবু নাইডু (মধ্যে) ও নীতীশ কুমার বিজয় চিহ্ন দেখাচ্ছেন। আজ ৫ জুনছবি: এএনআই

ভারতে ২০১৪ সাল থেকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) মূলত একটি প্রতীকী জোট ছিল। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে স্বাচ্ছন্দ্যে সরকার গঠন ও পরিচালনা করেছে। জোট এতটাই গুরুত্বহীন ছিল যে বিজেপি-শিরোমণি আকালি পার্টি (২০২০), শিবসেনাসহ (২০১৯) তাদের অনেক পুরোনো মিত্রকে হারালেও কোনো আফসোস করতে হয়নি।

কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট গঠনের পর বিজেপিকে জোট নিয়ে নড়েচড়ে বসতে হয়। ২০২৩ সালের ১২ জুলাই এনডিএ একটি বৈঠক করে ঘোষণা দেয়, তাদের জোটে ২৮টি দল রয়েছে। ওই সময় ইন্ডিয়া জোটে ১৮টি দল ছিল। এর কয়েক মাস পরই এনডিএ জোট তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি), আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা নীতীশ কুমারের জনতা দল—ইউনাইটেড (জেডি-ইউ) ও টিপরা মোথার মতো দলকে দলে ভেড়ায়। তবে একই সময়ে তারা এআইএডিএমকের মতো মিত্রকেও হারায়।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর এনডিএ জোটে শরিকদের আসা-যাওয়ার বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। এনডিএ জোট ইতিমধ্যে সরকার গঠনের মতো প্রয়োজনীয় ২৭২ আসনের চেয়ে ঢের বেশি—২৯৩ আসনে জয় পেয়েছে। কিন্তু বিজেপি এককভাবে ২৪০ আসন পেয়েছে, যা প্রয়োজনীয় ২৭২ আসনের চেয়ে ৩২টি কম। আর এই কারণে এক দশকের মধ্যে বিজেপিকে প্রথমবারের মতো সরকার গড়তে মিত্রদের ওপর, বিশেষ করে টিডিপি ও জেডি-ইউর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

খবর পাওয়া যাচ্ছে, ইন্ডিয়া জোট থেকে নাইডুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। টিডিপির প্রধান জোট সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখার বিনিময়ে বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের দাবি জানাতে পারেন।

এখন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, এই মিত্রদের প্রত্যেকে এখন বিজেপির কাছে কী দাবি করতে পারে? কারণ, বিজেপি এসব দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠনের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে।

তেলেগু দেশম পার্টি

টিডিপি প্রথম ১৯৯৬ সালে এনডিএ জোটে যোগ দিয়েছিল। তখন চন্দ্রবাবু নাইডু বেশ তরুণ নেতা ছিলেন। তখন তাঁর সরকার আইটি সরকারের প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত পেয়েছিল। ২০১৮ সালে দলটি এনডিএ জোট ত্যাগের পর বেশ বড় ধাক্কা খায়। ২০১৮ সালে তেলেঙ্গানা বিধানসভায় দলটি মাত্র ২ আসনে জয়ী হয়। আবার ২০১৯ সালে অন্ধ্র প্রদেশ বিধানসভায় পায় মাত্র ২৩ আসন।

২০১৯ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ইউপিএ জোটে যোগ দিয়েছিল টিডিপি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দলটি আবার বিজেপি জোটে যোগ দেয় এবং এবার বিজেপি নির্বাচনে বেশ ক্ষতির শিকার হয়। আর টিডিপি বিস্ময়কর এক জয় পেয়েছে। দলটি অন্ধ্র প্রদেশ বিধানসভার ১৭৫ আসনের মধ্যে ১৩৪ আসনে জয় পেয়েছে। একইভাবে এবার লোকসভার ১৬ আসনে জয় পেয়েছে। দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো এবার ‘কিংমেকার’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন নাইডু।

খবর পাওয়া যাচ্ছে, ইন্ডিয়া জোট থেকে নাইডুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। টিডিপির প্রধান জোট সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখার বিনিময়ে বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের দাবি জানাতে পারেন। কমপক্ষে এমন দুটি জোরালো কারণ রয়েছে, যাতে তিনি এনডিএ জোটে থেকে যেতে পারেন।

প্রথমত, রাজ্য ভাগ হওয়ার পর কংগ্রেস এখনো অন্ধ্র প্রদেশে তার হারানো জনপ্রিয়তা পুরোপুরি ফিরে পায়নি। ওয়াই এস রেড্ডির মৃত্যুর পর দলের বিভাজন এখনো রয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, এই রাজ্যে নাইডুর দলের পক্ষে প্রচারে মোদি এসেছেন এবং বিজেপির সঙ্গে তাঁর দলের জোট রয়েছে। এ কারণে এখানকার ভোটাররা তাঁদের রায় দিয়েছেন। কিন্তু জোট ছেড়ে গেলে ভবিষ্যতে রাজ্যে ও জাতীয় রাজনীতিতে তাঁদের এর মূল্য দিতে হতে পারে।

জনতা দল-ইউনাইটেড

নীতীশ কুমার বারবার জোট পরিবর্তনের কারণে বিশ্লেষকেরা তাঁর রাজনীতি নিয়ে নানা রসাত্মক কথাবার্তা বলে থাকেন। একসময় সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ছিলেন নীতীশ। কিন্তু বারবার ডিগবাজি দিয়ে তিনি নিজের ক্ষতিটা করেছেন। অটল বিহারি বাজপেয়ীর সময় তিনি এনডিএ জোটের বেশ প্রভাবশালী মিত্র ছিলেন। তখন তিনি কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিজেপির সঙ্গে নীতীশের তিক্ততা বাড়তে শুরু করে। নরেন্দ্র মোদির ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিতে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে, এমন কথা তুলে তিনি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সামনে আনার তীব্র বিরোধিতা করেন। ২০১৩ সালে তিনি এনডিএ জোট থেকে বেরিয়ে যান। বিহারে তাঁর ভাবমূর্তিটা ‘সুশান বাবু’ হিসেবে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তখন তাঁকে অনেকে বিরোধীদের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে মনে করতেন।

২০১৫ সালের বিহারে বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস, আরজেডি, জেডি-ইউ ও বাম দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত মহাগটবন্ধন (মহাজোট) বিজেপিকে ধসিয়ে দেওয়ার পর নীতীশের বিরোধীদলীয় প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হওয়ার ধারণা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। দুর্ভাগ্যবশত, সেটাই নীতীশের শেষ ডিগবাজি ছিল না। লালু প্রসাদ যাদবের দলের সঙ্গে তিনি কাজ করতে পারছেন না, এমন একটা ছুতো দিয়ে ২০১৭ সালে নীতীশ জোট থেকে বেরিয়ে যান। পরে আবার ২০২২ সালে তিনি মহাগটবন্ধনে ফিরে আসেন। আবার ২০২৪ সালে তিনি বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটে যোগ দেন।

নীতীশ কুমার বারবার জোট পরিবর্তনের কারণে বিশ্লেষকেরা তাঁর রাজনীতি নিয়ে নানা রসাত্মক কথাবার্তা বলে থাকেন। একসময় সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ছিলেন নীতীশ। কিন্তু বারবার ডিগবাজি দিয়ে তিনি নিজের ক্ষতিটা করেছেন।

এভাবে একের পর এক ডিগবাজির কারণে নীতীশ তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু এবার বিহারে লোকসভা ১২ আসনে জয়ী হয়ে তিনি সম্ভবত ‘কিংমেকার’ হয়ে উঠতে পারেন। কে জানে, তিনি নিজেও ‘কিং’ হয়ে যান কি না। বিজেপিকে সরকার গঠন করতে এনডিএ জোটের তৃতীয় সর্বোচ্চ আসনজয়ী জেডি-ইউর সহায়তা লাগবে। কিন্তু নীতীশের অতীত রেকর্ড বলে দিচ্ছে, কেন্দ্রে তাঁর সমর্থনে স্থিতিশীল সরকার হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আপাতদৃষ্টিতে তিনি এখন এনডিএকে সমর্থন দিলেও আবার কখন নিজের স্বার্থ আদায়ে ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে মাখামাখি শুরু করেন, বলা যায় না।

লোকজনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস)

এলজিপির প্রতিষ্ঠাতা রাম বিলাস পাসওয়ান ভারতের রাজনীতিতে খুবই চতুর রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। প্রায়ই দেখা যায়, নির্বাচনের আগে তিনি কোনো একটি জোটে যোগ দেন আর শেষে বিজয়ী জোটের সঙ্গে ভিড়ে যান।

বাজপেয়ীর যুগে রাম বিলাস এনডিএ জোটে ছিলেন। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আগে আবার তিনি এনডিএ জোটে ফিরে আসেন। তখন তিনি বিজেপি সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তিনি জোটে থেকে নিজের দলের জন্য সর্বোচ্চটা আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এখন দেখার বিষয়, তাঁর ছেলে চিরাগ পাসওয়ান কীভাবে বাবার সেই ঐতিহ্য ধরে রাখেন।

বিহার থেকে চিরাগ পাসওয়ানের দল পাঁচটি আসনে জয়ী হয়েছে। এই দলের নেতা তাঁর বাবার মতো কীভাবে বিহারের দলিত সম্প্রদায়ের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন, এখন সেটাই দেখার বিষয়। এখন পর্যন্ত তিনি এনডিএর প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে যাচ্ছেন। যদি ইন্ডিয়া জোট সরকার গঠন করতে গিয়ে পাঁচ আসনের ঘাটতিতে পড়ে যায়, তখন তিনি এই সরকারে মন্ত্রিত্ব বাগিয়ে নিতে পারেন। মোদি সরকার যতই চাইবে, তাঁকে ধরে রাখা কঠিন হবে।

শিবসেনা (সিন্ধে)

হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা দীর্ঘদিন বিজেপির মিত্র ছিল। ১৯৮৪ সালে তাদের রাজনৈতিক মিত্র হয়েছিল শিবসেনা। মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনের পর ২০১৯ সালে এই জোট ভেঙে যায়। ২০২২ সালের মাঝামাঝি মহারাষ্ট্রের আরেক দল শারদ পাওয়ারের এনসিপিতে ভাঙন ধরে। শিবসেনা ভেঙে গেলে বিজেপির ঘনিষ্ঠ একনাথ সিন্ধেকে দলের নাম ও প্রতীক দিয়ে দেওয়া হয়।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে শিবসেনার একনাথ সিন্ধের অংশ সাত আসনে জয়ী হয়েছে। উদ্ধব ঠাকরের অংশ জয়ী হয়েছে ৯ আসনে। সিন্ধের অংশ বিজেপির সঙ্গে থাকবে। তবে বর্তমান পটভূমিতে এই অংশের অনেক সদস্য উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে চলে যেতে পারেন। আর যদি তা-ই হয়, তাহলে তাঁরা ইন্ডিয়া জোটেও ঢুকে যাবেন।

আরএলডি ও জেডিএস

উত্তর ও দক্ষিণের দুই বিরোধী দল বিজেপির সঙ্গে থাকাটাকেই বেছে নিয়েছিল। উত্তর প্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি) ও কর্ণাটকের জনতা দল (সেক্যুলার) এবার দুটি করে আসনে জয়ী হয়েছে। তবে এবার বিজেপির সঙ্গে থাকার জন্য তাদের অনুশোচনা করা লাগতে পারে।

আরএলডির প্রতিষ্ঠাতা চরণ সিংকে ভারতরত্ন দেওয়ায় আর বিজেপির মিষ্টি কথার ফাঁদে পড়ে জেডিএস কংগ্রেস জোট ছেড়ে এনডিএ জোটে যোগ দিয়েছে। এখন এই জোটে নিজেদের রেখে যতটা সম্ভব আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা থাকবে তাদের। কিন্তু হায়! জোটে তাদের প্রভাব যে ততটা নেই। ফলে তারা জোট ছেড়েও খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। এখন অবস্থাটা এমন, যেদিকে বাতাস, সেদিকে তারা চলে যেতে পারে।

অনুবাদ: শাহজাহান সিরাজী