মণিপুরের পরে উত্তপ্ত হচ্ছে নাগাল্যান্ড

উত্তর–পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের পরে এবার রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে নাগাল্যান্ডে। আগামীকাল শুক্রবার ‘জনসাধারণের জন্য জরুরি অবস্থা’র ডাক দিয়েছে ইস্টার্ন নাগাল্যান্ড পিপলস অর্গানাইজেশন (ইএনপিও) নামে পূর্ব নাগাল্যান্ডের একটি সংগঠন। একই সঙ্গে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণা এবং তা বর্জনের ঘোষণাও দিয়েছে তারা।

২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে পূর্ব নাগাল্যান্ডের ছয় জেলা নিয়ে পৃথক স্বশাসিত অঞ্চল গঠনের দাবি জানিয়েছিল ইএনপিও। কিন্তু এই দাবিকে কেন্দ্র সরকার মেনে নেয়নি। আর এই মেনে না নেওয়ার প্রতিবাদেই সংগঠনটি এই ঘোষণা দেয়। আগামীকাল পূর্ব নাগাল্যান্ডের ছয় জেলায় ধর্মঘট পালিত হবে। প্রধানত সাতটি নাগা গোষ্ঠী এই জেলাগুলোতে থাকে।

আগামীকালের ধর্মঘটের কথা মাথায় রেখে পূর্ব নাগাল্যান্ডসহ সীমান্ত অঞ্চলে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

নাগাল্যান্ডের নাগরিক সমাজের একাংশ অবশ্য মনে করছে, স্বশাসিত পৃথক অঞ্চলের দাবির আন্দোলন হলো বৃহত্তর নাগা ঐক্যকে দুর্বল করার লক্ষ্যে কেন্দ্র সরকারের একটি পরিকল্পনা।

২০১০ সাল থেকে ইএনপিও বর্তমানে নাগাল্যান্ডকে ভেঙে ফ্রন্টিয়ার নাগাল্যান্ড নামে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তাদের বক্তব্য পূর্ব নাগাল্যান্ডের ছয় জেলায় (মোন, লংলেং, থেনস্যাং, নকলেক, শামাটোর ও কিপিরে) নাগাল্যান্ডের সার্বিক উন্নয়ন পৌঁছায়নি। সেই কারণেই পৃথক স্বশাসিত অঞ্চল বা কার্যত রাজ্যেরই দাবি তোলে ইএনপিও। ২০২৩ সালে নাগাল্যান্ডে বিধানসভা নির্বাচনের আগেও এবারের মতোই নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়েছিল ইএনপিও।

সে সময় দুভাবে কেন্দ্র সরকার পরিস্থিতি সামাল দেয়। এক. কেন্দ্র সরকারের উত্তর-পূর্ব উপদেষ্টা এ কে মিশ্রর নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা একটি বিকল্প ব্যবস্থার জন্য আলোচনা করেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল অঞ্চলের জন্য স্বায়ত্তশাসন। দুই. বিজেপি সরকার পূর্ব নাগাল্যান্ডের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। সেই ইশতেহারে পূর্ব নাগাল্যান্ডের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজের ঘোষণাও করেন বিজেপির সভাপতি জে পি নাড্ডা। কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার ছয় মাসেও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কোনো উন্নয়নই হয়নি এবং প্রশাসনিক স্তরে তাঁরা কোনো সুবিধা পাননি বলে দাবি ইএনপিওর।

কেন্দ্র সরকারের নাগা ঐক্য ভাঙার পরিকল্পনা

এই আন্দোলনের বিরোধী হলো নাগাল্যান্ডের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এনএসসিএন-আইএম (ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড-আইজ্যাক মুইভা)। বৃহত্তর এনএসসিএনের নাগরিক সমাজের দুই প্রতিনিধি প্রথম আলোকে বৃহস্পতিবার বলেন, ইএনপিওর পৃথক রাজ্যের আন্দোলনের নানান দিক রয়েছে। তবে দুই বিশ্লেষকের কেউই নিজের নাম দিতে চাননি। তাঁদের বক্তব্য, পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তপ্ত এবং এই সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সাক্ষাৎকার দিয়ে তাঁরা বিপদে পড়তে চান না।

বিশ্লেষকদের একজন একটি ছাত্রসংগঠনের নেতা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইএনপিওর দাবির মধ্যে যৌক্তিকতা আছে অর্থাৎ ইতিহাসগতভাবে পূর্ব নাগাল্যান্ড গোটা রাজ্যের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ‘এটা এক দিনের বিষয় নয়, কয়েক শতকের ইস্যু এবং এটা অস্বীকারও করা যাবে না যে ওই অঞ্চল পিছিয়ে রয়েছে যেমন পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কলকাতার তুলনায় পাহাড় অর্থাৎ দার্জিলিং এবং সংলগ্ন অঞ্চল উন্নয়নের প্রশ্নে পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে প্রতি নির্বাচনের আগে পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন হবে এবং নির্বাচন বর্জনের ডাক দেওয়া হবে। যেটাকে আবার কাজে লাগাবে কেন্দ্র সরকার।’

কেন্দ্র সরকারের ভূমিকার দুটি নির্দিষ্ট দিক আছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তাঁর ভাষ্য, ‘এক. কেন্দ্র সরকার কোনো দিনই পূর্ব নাগাল্যান্ডকে পৃথক রাজ্য দেবে না বা খুব বেশি মাত্রায় ক্ষমতাও দেবে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতের আরও একাধিক জাতিগোষ্ঠীকে বাড়তি স্বশাসন অথবা পৃথক রাজ্য দিতে হবে, যেমন ত্রিপুরায় বৃহত্তর টিপরাল্যান্ড বা মণিপুরে আদিবাসীদের নিজস্ব রাজ্য বা মিজোরামে বৃহত্তর জো অঞ্চল।’

আর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে মনে করেন, এই আন্দোলন জিইয়ে রাখার পেছনে কেন্দ্র সরকারের অন্য উদ্দেশ্য আছে। ব্যাখ্যা হিসেবে বলেন, ‘এই আন্দোলন বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে কেন্দ্র সরকার দেখাতে চায় যে নাগারা যে বলেন তাদের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সমস্ত নাগা গোষ্ঠী একসঙ্গে রয়েছে এই বক্তব্য ভ্রান্ত, এটাই প্রমাণ করতে চায় কেন্দ্র সরকার। তারা এটা প্রমাণ করতে চায় কারণ, ক্ষমতায় আসার ১০ বছর পরেও বিজেপি এনএসসিএনের সঙ্গে চূড়ান্ত শান্তিচুক্তি করে উঠতে পারেনি। বিজেপি বুঝে গেছে যে এনএসসিএন এবং অন্যান্য নাগা সংগঠন তাদের সার্বভৌমত্বের এবং পৃথক সংবিধানের দাবি ছাড়বে না। এই চুক্তিও কোনো দিন সই হবে না। এই অবস্থায় নাগা ঐক্যকে ভাঙার লক্ষ্যেই পূর্ব নাগাল্যান্ডের আন্দোলনে হাওয়া দিচ্ছে বিজেপি। তবে তার অর্থ এই নয় যে পূর্ব নাগাল্যান্ড বৈষম্যের শিকার নয়।’