ট্রাম্পের শুল্কের চাপে যুক্তরাষ্ট্রের হীরার বাজারে ভারতের রাজত্ব কি ধসে পড়বে
আলোর উৎসব দীপাবলির দিনে ভারতীয় ব্যবসায়ী কালপেশ প্যাটেলকে হয়তো তাঁর আট বছরের হীরা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার বাতি চিরতরে নিভিয়ে দিতে হবে।
৩৫ বছর বয়সী কালপেশ গুজরাটের সুরাট শহরে ছোট একটি হীরা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা চালান। সেখানে প্রাকৃতিক অমসৃণ হীরা কেটে এবং পালিশ ও মসৃণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। প্রায় ৪০ জন কর্মী ওই কারখানায় কাজ করেন।
গত কয়েক বছরে নানা সমস্যার মধ্যেও কালপেশ তাঁর ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। তবে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় পণ্য আমদানিতে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। কালপেশের আশঙ্কা, এ শুল্ক হয়তো তাঁর কারখানার জন্য কফিনের শেষ পেরেক হয়ে উঠবে। কারণ, প্রাকৃতিক হীরাশিল্প খাত আগে থেকেই নানা সমস্যার মধ্যে আছে।
কালপেশ আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের এখনো দীপাবলির জন্য কিছু অর্ডার আছে, সেগুলো শেষ করার চেষ্টা করব।’
চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে দীপাবলি উৎসব হবে। ভারতীয় হিন্দুদের জন্য এটি একটি বড় উৎসব। এই সময় সাধারণত দেশের ভেতর বেশির ভাগ পণ্যের বিক্রি বেড়ে যায়।
তবে কালপেশের আশঙ্কা, হয়তো উৎসবের আগেই তাঁদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ শুল্ক আরোপ করায় রপ্তানিকারকেরা অর্ডার বাতিল করতে পারেন।
কালপেশ বলেন, ‘অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে বেতন দেওয়া এবং অন্যান্য খরচ চালানো ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।
সুরাটের প্রায় ২০ হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীর একজন কালপেশ। সুরাটকে ‘ভারতের হীরা নগরী’ বলে ডাকা হয়। বিশ্বে উত্তোলিত প্রতি ১৫টি প্রাকৃতিক হীরার মধ্যে ১৪টিরই কাটা ও পালিশের কাজ এখানে হয়।
ভারতে হীরাশিল্প খাতের শীর্ষ সংস্থা জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের (জিজেইপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (মার্চ পর্যন্ত) দেশটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮০ কোটি ডলার মূল্যের প্রক্রিয়াজাত হীরা রপ্তানি করেছে। এটি ভারতের মোট প্রক্রিয়াজাত হীরা রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্র তাদের একক বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। ভারতে হীরাশিল্প খাতের শীর্ষ সংস্থা জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের (জিজেইপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (মার্চ পর্যন্ত) দেশটি শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ৪৮০ কোটি ডলার মূল্যের প্রক্রিয়াজাত হীরা রপ্তানি করেছে। এটি ভারতের মোট প্রক্রিয়াজাত হীরা রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (মার্চ পর্যন্ত) বিশ্বে মোট ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলার মূল্যের প্রক্রিয়াজাত হীরা রপ্তানি করেছে ভারত।
কলকাতা থেকে হীরা রপ্তানি করেন ডিম্পল শাহ। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ক্রয়াদেশগুলো ইতিমধ্যেই বাতিল হতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বেশি শুল্কের কথা বলে জাহাজ থেকে চালানের পণ্য নামাতে চাইছে না। এটা হীরাশিল্পে আমার দুই দশকের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন সময়।’
ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল ভারতীয় পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন। আলোচনার পরও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি না হওয়ায় এই শুল্ক আরোপ করা হয়। এ ঘোষণা গত ৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হয়েছে। বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে দুই দেশের আলোচনা এখনো চলছে।
তা ছাড়া গত ৬ আগস্ট ট্রাম্প অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এতে মোট শুল্কের পরিমাণ ৫০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই অতিরিক্ত শুল্ক ২৭ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
ভারতীয় রত্নশিল্প আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ২ দশমিক ১ শতাংশ শুল্কের আওতায় ছিল। আর এখন মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ১ শতাংশে।
ট্রাম্প এ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপকে ভারতের জন্য অর্থদণ্ড বলে উল্লেখ করেছেন। ট্রাম্পের অভিযোগ, তিনি যখন ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে রাশিয়াকে চাপ দিচ্ছেন, তখন ভারত অনবরত মস্কোর কাছ থেকে তেল কিনে যাচ্ছে।
ভারতীয় রত্ন শিল্প আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ২ দশমিক ১ শতাংশ শুল্কের আওতায় ছিল। আর এখন মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫২ দশমিক ১ শতাংশে।
বাণিজ্যবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল রিসার্চ ট্রেড ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কথা না শোনায় এবং কৃষি ও দুগ্ধ খাতে প্রবেশাধিকার না দেওয়ায় ভারতের ওপর চটেছেন ট্রাম্প। আর সে ক্ষোভ থেকেই ভারতের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়েছেন তিনি। শ্রীবাস্তব ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্য আলোচনা এবং সেখানে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতে ওয়াশিংটনের বেশি প্রবেশাধিকার চাওয়া নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধকে ইঙ্গিত করেছেন।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের কারণ যা–ই হোক না কেন, ভারতে আগে থেকেই জর্জরিত হীরাশিল্প খাতের ওপর এর বাজে প্রভাব পড়ছে।
গুজরাটের সুরাট, আহমেদাবাদ ও রাজকোট শহরে হীরার কাটিং ও পালিশের কারখানাগুলোয় ২০ লাখের বেশি মানুষ কাজ করেন। কোভিড-১৯ মহামারি এবং পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে অনেকেই বেতন কমে যাওয়ার সমস্যার মধ্যে পড়েছেন।
গুজরাটের ডায়মন্ড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি রমেশ জিলরিয়া আল–জাজিরাকে বলেন, মহামারির কারণে অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে পড়ায় হংকং ও চীনের আন্তর্জাতিক বাজারগুলোয় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া থেকে অমসৃণ হীরা আমদানিতে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার ওপর জি–সেভেনের নিষেধাজ্ঞার কারণেও ব্যবসার ওপর প্রভাব পড়ছে।
রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবেই অপ্রক্রিয়াজাত হীরার একটি বড় উৎস।
জিলরিয়া বলেছেন, অর্থনৈতিক সংকটের কারণে গত দুই বছরে ৮০ জন হীরাশ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন।
জিলরিয়া আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির কারণে শ্রমিকদের মাসিক বেতন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাঁদের মাসিক বেতন এখন ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার রুপির মধ্যে। এই ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করে টিকে থাকাটা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। জিলরিয়ার আশঙ্কা, ট্রাম্পের শুল্ক পুরোপুরি কার্যকর হলে গুজরাটে প্রায় ২ লাখ মানুষ তাঁদের জীবিকা হারাতে পারেন।
ইতিমধ্যে, ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি সাবেক হীরাশ্রমিক সুবিধা ভাতার জন্য আবেদন করেছেন। গত মে মাসে রাজ্য সরকার তাঁদের পরিবারকে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বলা হয়েছে, যাঁরা গত কয়েক বছরে এই খাতে চাকরি হারিয়েছেন, তাঁরা প্রতি সন্তানের জন্য মাসে ১৩ হাজার ৫০০ রুপি ভাতা দেওয়া হবে।
তবে সংকটের একমাত্র কারণ শুল্ক, মহামারি বা যুদ্ধ নয়। ল্যাব-উৎপাদিত হীরাও ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক হীরার বাজার কমিয়ে দিচ্ছে।
সুরাট জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সেলিম দাগিনাওয়ালা বলেন, ‘প্রাকৃতিক হীরার মতো ল্যাব-উৎপাদিত হীরা খনি থেকে আসে না, বরং বিশেষ ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়। এর দাম প্রাকৃতিক হীরার মাত্র ১০ শতাংশ। অভিজ্ঞ গয়না প্রস্তুতকারকের জন্যও খালি চোখে প্রাকৃতিক ও ল্যাব-উৎপাদিত হীরার পার্থক্য বোঝা কঠিন। দামে সস্তা হওয়ায় গ্রাহকেরা এখন ল্যাব-উৎপাদিত হীরার দিকে ঝুঁকছেন।’
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ১ হাজার ৮০ কোটি ডলার মূল্যের অমসৃণ বা অপ্রক্রিয়াজাত প্রাকৃতিক হীরা আমদানি করেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানির তুলনায় ২৪ দশমিক ২৭ শতাংশ কম। ২০২৩-২৪ সালে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার মূল্যের হীরা আমদানি করা হয়েছিল।
একই সময়ে কাটা ও পালিশ করা অর্থাৎ প্রক্রিয়াজাত প্রাকৃতিক হীরা রপ্তানির পরিমাণও কমেছে। জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের (জিজেইপিসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রক্রিয়াজাত প্রাকৃতিক হীরার রপ্তানির পরিমাণ ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমে ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলার হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।
জিজেইপিসির চেয়ারম্যান কিরিট বানসালি বলেন, ‘এই পদক্ষেপ (শুল্ক আরোপ) ভারতের অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এতে গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হতে পারে, রপ্তানি থমকে যেতে পারে এবং হাজারো মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়তে পারে। আমরা আশা করি, শুল্ক কমিয়ে আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসা হবে। না হলে টিকে থাকাটা কঠিন হবে।’
অল ইন্ডিয়া জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি ডোমেস্টিক কাউন্সিলের (জিজেসি) চেয়ারম্যান রাজেশ রোকদে সতর্ক করেছেন, এই শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের গয়নার ব্যবসার ওপরও প্রভাব পড়তে পারে।
রাজেশ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে এমন প্রায় ৭০ হাজার গয়নার দোকান আছে, যারা হীরার দাম বেড়ে গেলে সমস্যায় পড়বে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো দেশীয় বাজারে হীরার চাহিদা বাড়ানো এবং নতুন বাজারে প্রবেশ করা।
বানসালি বলেন, দেশের ভেতরে রত্ন ও গয়নার বাজার বাড়ছে এবং বর্তমানে ৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলার থেকে আগামী দুই বছরের মধ্যে তা ১৩ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছানোর আশা করা হচ্ছে। শিল্পটি লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ নতুন বাজার খুঁজছে।
উত্তর প্রদেশের বারানসির নারায়ণ দাস সরাফ জুয়েলার্সের পরিচালক রাধা কৃষ্ণ আগারওয়াল বলেন, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ বাজার শুধু স্থানীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে না, বরং কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি করবে।
নারায়ণ আরও বলেন, এই শুল্ক যদি ভারতের রত্নশিল্পের ‘বিদেশ নির্ভরতা’ কমিয়ে দেয়, তবে তা ‘গোপনে আশীর্বাদ’ হিসেবেও কাজ করতে পারে।
সুরাট জুয়েলারি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অমিত কোরাট বলেন, সোনার দেশীয় বাজার শক্তিশালী হওয়ার কারণে এ খাতে রপ্তানিতে ধাক্কা লাগলেও তার প্রভাব অনেকটা কমিয়ে আনা যায়।
তবে আপাতত ভারতের হীরা খাতে তেমন কোনো সুরক্ষাবলয় নেই।
সুরাটের ব্যবসায়ী কালপেশ প্যাটেল মনে করেন, এ খাতকে দ্রুত রক্ষা করা জরুরি। সহায়তা ছাড়া, এই ব্যবসার জৌলুশ চিরতরে হারিয়ে যাবে।