সৌরবিদ্যুতে কতটা সুফল পাবে ভারতবাসী
ভারতের রাজস্থান রাজ্যের নবায়নযোগ্য জ্বালানি কোম্পানি সৌর উর্যা। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কেশভ প্রসাদ বলেছেন, রাজ্যের ভাদলা এলাকা প্রায় বসবাসের অযোগ্য। থর মরুভূমির একাংশে এই ভাদলা এলাকার অবস্থান।
প্রসাদের এই কথার সত্যতাও রয়েছে। বিবিসির খবরে জানা যায়, ভাদলার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রায়ই বালুঝড় বয়ে যায়। বৈরী এই আবহাওয়া ও সূর্যের প্রখর তাপের কারণেই ভাদলায় বসবাস কষ্টকর। আবার এটাও ঠিক যে এই সৌরতাপকেই কাজে লাগিয়ে এখানে উৎপাদন করা যায় সৌরবিদ্যুৎ। অর্থাৎ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাদলাকে বলা যায় আদর্শ এলাকা।
সূর্যের বিপুল তাপ যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছে ভারত। আর তাই বিশ্বের বৃহত্তম সৌরবিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র হলো ভাদলা। এর একটি অংশ পরিচালনা করে প্রসাদের সৌর উর্যা।
ভাদলায় এক কোটি সৌর প্যানেল রয়েছে। সৌরশক্তির মাধ্যমে এসব প্যানেলের ২ হাজার ২৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এতে ৪৫ লাখ পরিবারকে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়া সম্ভব।
প্রসাদ বলছেন, বালু ও ধুলাময় পরিবেশে সোলার প্যানেলগুলো পরিষ্কার রাখার কাজটি চ্যালেঞ্জের। তবে অন্য যেকোনো ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার তুলনায় বড় হলেও এই সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করা সহজ। তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে খুব বেশি সরঞ্জামের প্রয়োজন নেই। একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করতে সৌর প্যানেল, তার, ইনভার্টার ও ট্রান্সফরমার প্রয়োজন।
২০১৮ সালে ভাদলায় সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শেষ হয়। এর ফলে ভারতের প্রত্যন্ত এই অঞ্চলে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কী বলছেন বাসিন্দারা
ভাদলার বাসিন্দা ১৮ বছর বয়সী মুখতিয়ার আলী বলেছেন, ‘আমার গ্রামের বেশির ভাগ ছেলে খুব বেশি পড়াশোনা করত না। তাদের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। গ্রামের মধ্যেই আমাদের জীবন ছিল সীমাবদ্ধ। আমাদের মা-বাবা কৃষক ছিলেন অথবা গবাদিপশু লালনপালন করতেন। তবে যখন থেকে সৌর পার্কের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে, আমি বুঝতে পেরেছি, পৃথিবীটা আমার গ্রামের চেয়ে অনেক বড়।’
আলী আরও বলেন, ‘ভাদলা সৌর পার্কের কারণে অনেক প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও শিক্ষিত ব্যক্তি আমাদের গ্রামগুলোয় সফর করেছেন। এসব ঘটনা জীবন সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি সোলার পার্কের একজন কর্মকর্তা হতে চাই। কারণ, এই কর্মকর্তার হাতে ক্ষমতা রয়েছে। তিনি সম্মানীয়। এই পার্কের কর্মকর্তারা মানুষের জীবনে বদল আনতে পারেন।’
আমাদের সবচেয়ে বড় সৌর পার্ক রয়েছে। তাই এই পার্কের মাধ্যমে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসা উচিতভাদলা গ্রামপ্রধান সদর খান
তবে বিরাট এই সৌর পার্ক নির্মাণে আলীর মতো সব গ্রামবাসী রোমাঞ্চিত নন। পার্কের ১৪ হাজার একর জমির বেশির ভাগই রাষ্ট্রমালিকানাধীন। তবে স্থানীয় কৃষকেরা এসব জমিতে গবাদিপশু চরাতেন।
ভাদলা গ্রামপ্রধান সদর খান বলেছেন, ‘গ্রামবাসীদের বেশির ভাগেরই জীবিকা হলো গবাদিপশু লালনপালন করা। তিনি বলেন, সব সরকারি জমি ফেরত নেওয়া হয়েছে। আমাদের গবাদিপশু চরানোর মতো পর্যাপ্ত জমি নেই। আমরা অল্প কিছু গবাদিপশু লালনপালন করতে পারছি।’
সৌর পার্কের কারণে গ্রামবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির বিষয়টি মেনে নেন গ্রামপ্রধান সদর খান। তবে তিনি বলছেন, সৌর পার্কে যাঁরা চাকরি করছেন, তাঁদের বেতন খুব কম। এ ছাড়া স্থানীয় লোকজনের জন্য সৌর পার্কে খুব বেশি চাকরি নেই। গ্রামবাসীদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত হওয়ায় শুধু দিনমজুর হিসেবেই তাঁদের কাজে নেওয়া হয়। স্থানীয় মানুষদের অনেকেই এখনো বিদ্যুৎ–সংযোগ পাননি বলেও অভিযোগ করেন খান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সৌর পার্ক রয়েছে। তাই এই পার্কের মাধ্যমে আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসা উচিত।’
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
রাজস্থানের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অনিল ঢাকা গ্রামপ্রধান সদর খানের অভিযোগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এই সংস্থা রাজস্থানের নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের তত্ত্বাবধান করে।
অনিল ঢাকা বলেন, ভাদলার মতো বড় প্রকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে খরচ কমিয়ে এনেছে। ভাদলা পার্কের জমি সরকারি বলে মন্তব্য করেন তিনি। জমির ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাননি বলেও জানান। রাজস্থানের পশ্চিমাঞ্চলে সৌর প্রকল্পে বিনিয়োগের ফলে জমির দাম ও ভাড়া বেড়েছে। আর এতে প্রান্তিক মালিকেরা লাভবান হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বিদ্যুৎ–সংযোগ না থাকার কারণ জানান অনিল ঢাকা। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ–সংযোগের বিষয়টি সহজ নয়। ভাদলা সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তা উচ্চ ভোল্টেজের। ফলে সরাসরি স্থানীয় গ্রামে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় না। তবে তিনি বলেন, ভাদলার মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়েছে।
জমি লাগবে অনেক
ভারতের বিদ্যুতের ৭৫ শতাংশ উৎপাদন করা হয় কয়লা পুড়িয়ে। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটির সরকার নবায়নযোগ্য উৎস যেমন সৌরশক্তির মাধ্যমে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। আর এ জন্য অনেক বেশি জমির প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ–সংযোগ না থাকার কারণ জানান অনিল ঢাকা। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ–সংযোগের বিষয়টি সহজ নয়। ভাদলা সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, তা উচ্চ ভোল্টেজের। ফলে সরাসরি স্থানীয় গ্রামে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায় না। তবে তিনি বলেন, ভাদলার মতো বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইইইএফএ) গত বছরের জরিপ বলছে, ভারত যদি এই শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ শূন্য নিঃসরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করে, তাহলে দেশের মোট জমির ১ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশে সৌর প্যানেল স্থাপন করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে এখন ৩৪টি বড় সৌর প্রকল্প উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। এসব প্রকল্পের জন্য জমি পেতে বিতর্কের মুখে পড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
কৃষকদের নিয়ে আশঙ্কা
এনভায়রনমেন্টাল সাপোর্ট গ্রুপের জ্যেষ্ঠ ফেলো ভারগাভি এস রাও বলেন, পুনর্নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ পেতে প্রচুর সম্পদের প্রয়োজন। আর এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জমি। ব্যবহারের জন্য কৃষিজমিগুলো শুষ্ক, পরিত্যক্ত ও অনুৎপাদনশীল জমি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের জন্য এসব জমি গ্রাস করা হচ্ছে।
রাও আরও বলছেন, মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কৃষকেরা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। কিছু এলাকায় জ্বালানি উন্নয়নকারী ও আবাসন ব্যবসায়ীরা অনেককে জমি ইজারা দিতে ও বিক্রি করতে বাধ্য করছেন।
সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে রাও বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষকেরা চাষযোগ্য জমি নিয়ে বড় ধরনের চাপে পড়বেন। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য এটি সমস্যাশঙ্কুল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
ব্যবহারের জন্য কৃষিজমিগুলো শুষ্ক, পরিত্যক্ত ও অনুৎপাদনশীল জমি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
রাওর এসব অভিযোগ নিয়ে বিবিসি সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। তবে অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি সরকারি কর্তৃপক্ষ।
ফেরা যাক ভাদলায়। রাজস্থানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের প্রধান নির্বাহী প্রসাদ বলেন, সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য কল্যাণকর হবে। তিনি বলেন, সৌর পার্কের আশপাশের প্রায় ৬০টি গ্রাম লাভবান হয়েছে। চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্কুল নির্মাণ করা হয়েছে। ভাদলায় কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল না। কিন্তু এখন ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসক দল গ্রামে আসে। তাই এটা কেবল সবুজ জ্বালানির বিষয় নয়। বরং গ্রামবাসীর উন্নয়নের বিষয়। বিবিসি অবলম্বনে