কাশ্মীরের তরুণেরা কেন ‘স্বাধীনতা’ আর ‘অস্ত্রের’ ট্যাটু মুছে ফেলছেন

পুলিশের হয়রানির ভয়ে কাশ্মীরের হাজার হাজার মানুষ ‘প্রতিবাদী ট্যাটু’ মুছে ফেলছেনছবি: এএফপি

ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে শান্ত–নীরব একটি লেজার ক্লিনিকে সামির ওয়ানি তাঁর হাতটা বাড়িয়ে বসে আছেন। তাঁর চোখ তাকিয়ে আছে ত্বকে মুছে যাওয়া কালির দিকে।

সামিরের হাতে লেখা ছিল ‘আজাদি’ (উর্দু ভাষায় স্বাধীনতা) লেখা ট্যাটু। একসময় ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক ছিল এই শব্দটি। এখন সেটা লেজারের আঘাতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। যা ছিল একসময় সাহসী প্রতিবাদের চিহ্ন, এখন তা এমন এক বোঝা হয়ে উঠেছে, যা তিনি আর বইতে চান না।

২৮ বছর বয়সী সামির সেই দৃশ্যটা মনে করেন, যা তিনি কোনো দিন ভুলতে পারবেন না। তিনি তাঁর বন্ধুর সঙ্গে মোটরবাইকে চড়ে যাচ্ছিলেন। পথে একটি তল্লাশিচৌকিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের মোটরসাইকেল থামান।

তল্লাশির সময় এক সেনা কর্মকর্তা সামিরের হাতে থাকা ট্যাটু দেখে জিজ্ঞেস করেন, এটা কী?’

ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার প্রশ্ন শুনে সামিরের বুক ধড়ফড় করতে থাকে। তিনি বলছিলেন, ‘ভাগ্যিস, ওই কর্মকর্তা উর্দু পড়তে পারেন না। আরেকটু হলেই বিপদে পড়ে যেতাম। তখনই বুঝেছিলাম, এই ট্যাটুর জন্য আমি বড় বিপদে পড়তে পারি।’

সামির বলেন, ‘যখন তিনি তরুণ ছিলেন, তখন এটা ছিল শক্তির প্রতীক, যেন কিছু একটা বোঝাতে চাইছি। কিন্তু এখন এটি ভুল হিসেবে দেখি। এটা এখন আর আমার প্রতিনিধিত্ব করে না। এই ঝুঁকি নেওয়ার মতো আর কিছুই এতে নেই। বরং এটা আমার ভবিষ্যতের পথে বাধা।’

ট্যাটু এখন আর গর্ব নয়, বরং ভয়। সামির কেবল একা নন। তাঁর মতো অনেক কাশ্মীরি তরুণই এখন ট্যাটু মুছে দিচ্ছেন। এগুলো একসময় তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ, আবেগ বা পরিচয়ের প্রতিচ্ছবি ছিল। আগে যেসব ট্যাটু ছিল গর্বের বিষয়, এখন সেগুলো নীরবে, চুপচাপ মুছে ফেলা হচ্ছে।

ভারত ও পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার মধ্যে এই প্রবণতা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগাম শহরে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই পর্যটক। এরপর দুই দেশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়।

১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া কাশ্মীরের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে পাকিস্তান সমর্থন দেয় বলে ভারত অভিযোগ করে থাকে। তবে পাকিস্তান বরাবরই তা অস্বীকার করে আসছে। তারা বলছে, এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে তারা কেবল নৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে সমর্থন দেয়।

পেহেলগামে হামলার ঘটনার দুই সপ্তাহ পর ৭ মে ভোরে ভারত পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে ‘সন্ত্রাসী আস্তানা’ ধ্বংস করার দাবি করে। ১৯৭১ সালের পর ভারত এই প্রথম পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালাল। এরপর তিন দিন পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা দেখেছে বিশ্ব। পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কায় ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হস্তক্ষেপ করে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন।

তবে ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে শান্তি এখনো ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। কাশ্মীরের মানুষের ভয় কাটেনি। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দমনপীড়ন চলছে। সন্দেহভাজন বিদ্রোহীদের অনেকের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে, অনেকের বাড়িতে তল্লাশি চলছে। পেহেলগাম হামলার পর কাশ্মীরে ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কাশ্মীরে লেজারের মাধ্যমে এক তরুণের শরীর থেকে নয়াদিল্লিবিরোধী রাজনৈতিক বার্তা–সংবলিত ট্যাটু মুছে ফেলা হচ্ছে
ছবি: এএফপি

আমরা গায়ে তা অনুভব করি

অনেক কাশ্মীরি তরুণ বলছেন, এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিও যেন এখন নজরদারির আওতায় রয়েছে।

২৬ বছর বয়সী রইস ওয়ানি বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কিছু ঘটলেই আমরা সেটা গায়ে অনুভব করি। আক্ষরিক অর্থেই তা–ই।’

রইস বলেন, তাঁর বাহুতে হুররিয়তের নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানির নামের ট্যাটু ছিল। তিনি বলেন, ‘পেহেলগামের হামলার ঘটনার পর, তল্লাশিচৌকিতে সবাই আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে।’ সৈয়দ আলী শাহ গিলানি ২০২১ সালে ৯১ বছর বয়সে মারা যান।

রইস বলেন, ‘এমনকি আমার বন্ধুরাও জিজ্ঞাসা করে, ট্যাটুটা কেন করেছি? পুলিশ, গণমাধ্যম এমনকি প্রতিবেশীরাও আমার দিকে ভিন্নভাবে তাকাতে শুরু করেছে।’

রইস আরও বলেন, ‘আমি যদি মানুষকে বোঝাতে পারতাম যে একটি ট্যাটুই কেবল কোনো ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য বোঝায় না বা এটিই তার চরিত্রকে তুলে ধরে না। আমরা কেবল এমনভাবে বাঁচার চেষ্টা করছি, যেখানে প্রতিদিন এসব বিষয় ব্যাখ্যা করতে হবে না। আমি যত দ্রুত সম্ভব এই ট্যাটু মুছে ফেলতে চাই।’

পুলওয়ামার ১৯ বছর বয়সী আরসালান ট্যাটু মুছে ফেলতে স্টুডিওতে সময় বুক করেছেন। তিনি কর্তৃপক্ষের ভয়ে তাঁর নামের শেষাংশ বলতে চান না। ইরফান, আনাস ও তালিবের মতো আরও অনেক কাশ্মীরি তরুণ ট্যাটু মুছে ফেলতে চাইছেন।

আরসালান বলেন, যাঁদের ট্যাটু খোলামেলা দেখা যায়, বিশেষ করে যেগুলোতে অতীতের রাজনৈতিক সংযুক্তির ইঙ্গিত থাকে, তাঁরা হঠাৎ করেই ভয় পাচ্ছেন, তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হতে পারে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে, এমনকি তার চেয়েও খারাপ কিছু হতে পারে।

তবে কাশ্মীরে ট্যাটুর প্রবণতা একেবারে কমে যায়নি। ২২ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে এখনো ট্যাটুর চাহিদা আছে। শুধু ধরন বদলেছে—রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিষয় বাদ দিয়ে এখন মানুষ সহজ, প্রকৃতি-অনুপ্রাণিত ডিজাইন, নাম কিংবা অর্থপূর্ণ কোনো বক্তব্য পছন্দ করছে।

ট্যাটু মুছে ফেলার চেষ্টা করছেন এমন কিছু কাশ্মীরি বলছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত পরিবর্তন ও মানসিক পরিপক্বতার অংশ হিসেবে তাঁরা ট্যাটু মুছে ফেলছেন।

বারামুল্লার বাসিন্দা ইরফান ইয়াকুব আল–জাজিরাকে বলেন, কিশোর বয়সে একজন নিহত বিদ্রোহীর নামের ট্যাটু করিয়েছিলেন। তখন তাঁর জন্য এটি ছিল বিরাট সাহসের বিষয়। এখন ৩৬ বছরে এসে সেটি মুছে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এটা লজ্জার নয়, বরং আমার বেড়ে ওঠার প্রমাণ।’

শ্রীনগরের বাসিন্দা আনাস মীরের হাতে ছিল ‘আজাদি’ লেখা একটি তলোয়ারের ট্যাটু। পরিবারের চাপে তিনি সেটি মুছে দিয়েছেন।

তালিবের হাতে ছিল পবিত্র কোরআন শরিফের আয়াতের মতো করে একে-৪৭ বন্দুকের ট্যাটু। তিনি সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন, তখন এক পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে সতর্ক করেন। তিনি এখন সেই ট্যাটু মুছে ফেলছেন।

ট্যাটু মুছে ফেলার নানা কারণ

শুধু নিরাপত্তা বাহিনীর ভয় নয়, অনেক কাশ্মীরি তরুণের ট্যাটু মুছে ফেলার পেছনে আরও নানা কারণ আছে।

কেউ কেউ বলছেন, এসব ট্যাটু তাদের কষ্টকর অতীতের স্মৃতি হয়ে গেছে। কেউ আবার বলছেন, এগুলো তাঁদের পেশাগত জীবনে সমস্যা তৈরি করেছে কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে আর মানিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না।

যেমনটা বলছিলেন শ্রীনগরের আনাস মীর। তিনি বলেন, তিনি শুধু পারিবারিক চাপে তাঁর ‘আজাদি’ লেখা তরবারির ট্যাটু কয়েক সপ্তাহ আগে মুছে ফেলেছেন। তাঁর মতে, কার কী ট্যাটু থাকবে, সেটা তাঁর নিজস্ব পছন্দ হওয়া উচিত।

২৫ বছর বয়সী আনাস বলেন, ‘মানুষ পরিষ্কারভাবে বলছে না, কেন তাঁরা ট্যাটু মুছে ফেলছেন। আমি কেবল আমার পরিবারের চাপে ট্যাটু মুছে ফেলেছি।’

আনাস বলেন, ‘আমি কেমন ট্যাটু চাই, সেটা আমার পছন্দের বিষয়। এ নিয়ে কেউ আমাকে বিচার–বিশ্লেষণ করা ঠিক নয়। কারও যদি একে–৪৭ বা রাজনৈতিক কোনো ট্যাটু থাকে, সেটা তাদের পছন্দের ব্যাপার। কর্তৃপক্ষ বা সরকারের এতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। এবং এটাও ঠিক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্যাটুর ধরনও পরিবর্তন হচ্ছে।’

অনেকেই বলছেন, ট্যাটু মুছে ফেলার আরেকটি প্রধান কারণ ধর্মীয়। সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম অঞ্চলে শরীরে ট্যাটু করা ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

লেজারের মাধ্যমে একটি ক্লিনিকে ধর্মীয় প্রতীক–সংবলিত ট্যাটু মুছে ফেলা হচ্ছে
ছবি: এএফপি

২৪ বছর বয়সী ফাহিম বলছেন, তিনি ১৭ বছর বয়সে পবিত্র কোরআনের আয়াতের ট্যাটু করিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘তখন মনে করতাম, এটি ইমানের চিহ্ন। পরে বুঝি, শরীরে পবিত্র আয়াত লেখা ইসলাম সমর্থন করে না। প্রতিবার নামাজ পড়তে গিয়ে অপরাধবোধ হতো।’

শ্রীনগরের একজন আলেম বলেন, ‘ভুল করলে ঠিক আছে। কিন্তু এখন কেউ নিজেকে সংশোধন করছে, এটাই বড় কথা।’

কাশ্মীরিদের ট্যাটু মুছে ফেলার আরেকটি বড় কারণ চাকরির নিরাপত্তা। সেখানে সরকারি চাকরি খুব মর্যাদার বলে ধরা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক বার্তা-সংবলিত ট্যাটু থাকলে তা চাকরির নিয়োগ বা তদন্তে বাধা হতে পারে।

তালিব নামে এক তরুণ বলেন, তাঁর হাতে একে-৪৭ রাইফেলের আকারে পবিত্র কোরআনের আয়াত ট্যাটু করা ছিল। এ জন্য তাঁকে বারবার চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। তিনি যখন সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করেন, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কর্মরত তাঁদের এক পারিবারিক বন্ধু তাঁকে সতর্ক করেছিলেন।

২৫ বছর বয়সী এই কাশ্মীরি তরুণ বলেন, ‘তিনি সরাসরি এটি বলতে পারেননি। তবে আমি বলতে পারি, তিনি চিন্তিত হয়েছিলেন। তখন থেকে আমি হাফ হাতার জামা পরা এড়িয়ে চলতাম। আমি অনেক সময় চাকরির পরীক্ষায় প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। কিন্তু কেউ আমাকে এর পরিষ্কার কারণ জানায়নি। পরে আমি জানতে পারলাম, ট্যাটু হচ্ছে বড় সমস্যা। আমি উপলব্ধি করলাম, আমি ও আমার ভবিষ্যতের মধ্যে এটি একটি দেয়াল।’

এ কারণে এখন শ্রীনগরের লেজার ক্লিনিকগুলোতে ট্যাটু মুছে ফেলার চাহিদা বেড়েছে। এটি ব্যয়বহুল ও ব্যথাদায়ক হলেও অনেকেই এটিকে ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন মনে করছেন।

ট্যাটু সংস্কৃতি আছে, কিন্তু পাল্টাচ্ছে ধরন

ট্যাটু স্টুডিওগুলো এখনো বেশ ব্যস্ত। তবে এখন মানুষ রাজনৈতিক নয়, বরং প্রাকৃতিক বা ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণামূলক ডিজাইন বেশি পছন্দ করছে।

ট্যাটু আর্টিস্ট মুবাশশির বশির বলেন, ২০২২ সালে পাঞ্জাবি গায়ক সিদ্ধু মুসেওয়ালার মৃত্যুর পর একে-৪৭ ট্যাটু জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন, বিশেষ করে পেহেলগামের ঘটনার পর, মানুষ ভয়ে সেগুলো মুছে দিচ্ছে।

মুবাশশির বলেন, ২০১৯ সালে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর থেকে হাজার হাজার মানুষ ট্যাটু মুছে ফেলেছেন।

শেষ কথায় সামির বলেন, তাঁর ‘আজাদি’ ট্যাটুটি প্রায় মুছে গেছে। তিনি বলেন, ‘যখন করিয়েছিলাম, কাঁদিনি। কিন্তু যখন মুছতে শুরু করলাম, তখন কেঁদেছিলাম।’

সামির বলেন, ‘আমি আমার অতীতকে সম্মান করি, কিন্তু আমি এগোতে চাই। এমন জীবন চাই, যেন আমাকে পেছনে তাকাতে না হয়।’

হাতা নামিয়ে রেখে সামির বলেন, ‘আমি কখনো ভুলব না, ১৮ বছর বয়সে এই ট্যাটুর অর্থ কী ছিল। কিন্তু এখন আমি নতুন মানুষ হতে চাই, এমন জীবন চাই, যেখানে আমাকে আর পুরোনো ছায়া নিয়ে ঘুরতে না হয়।’