ত্রিপুরার নির্বাচনে কোনো জোটে যাবে না তিপ্রা মথা, ঝামেলা বাড়ল বিজেপির

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরায় বিধানসভার নির্বাচনের আগে বড় ঘটনা ঘটল আজ শুক্রবার দুপুরে। ত্রিপুরা জাতিসত্তার দল তিপ্রা মথার প্রধান রাজা প্রদ্যুৎকিশোর মানিক্য দেববর্মন ঘোষণা করলেন, তাঁরা এককভাবে নির্বাচনে লড়বেন। কোনো দলের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতা করবেন না।

ত্রিপুরায় জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর। অতএব মোটামুটি রাজ্যের ৬০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২০টি সরাসরি জেতার বা প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে তিপ্রা মথা। ২০২১ সালের এপ্রিলে স্বশাসিত উপজাতি পরিষদের নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলেই জিতেছিল তিপ্রা মথা।

ত্রিপুরায় তিপ্রা মথা গত কয়েক বছরে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), কংগ্রেস ও সিপিআইএমের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া মার্ক্সিস্ট) পাশাপাশি অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। তাদের প্রধান দাবি বৃহত্তর তিপ্রাল্যান্ড বা উপজাতিদের নিজস্ব রাজ্য। এই ইস্যু সামনে রেখে প্রচার চালাচ্ছেন দেববর্মন।

আজ সকালে সামাজিক মাধ্যমে দেববর্মন বলেন, এই দাবি পূর্ণ করতে কোনো রাজনৈতিক দল রাজি হয়নি। অতএব তারা একাই নির্বাচনে লড়বেন। তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ আমাদের দাবি পূর্ণ না হচ্ছে এবং কোনো সাংবিধানিক সমাধান সূত্র দেওয়া না হচ্ছে, ততক্ষণ আমরা কোনো জোটে যাব না।’

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার সঙ্গে গত সপ্তাহে বৈঠক করেছিলেন দেববর্মন।

এরপর জল্পনা শুরু হয় তিপ্রা মথা বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নির্বাচনে লড়বে। পাশাপাশি, কংগ্রেস এবং সিপিআইএমের শীর্ষ নেতৃত্ব ইঙ্গিত দেন, দেববর্মনের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা চলছে। কিন্তু আজ দেববর্মন জানালেন তিপ্রা মথা কোনো জোটে যাচ্ছে না

তিনি বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমাদের দাবি নিয়ে কোনো আপস আমি করব না। আমরা দিল্লি গিয়ে ওনাদের (সব দল) কথাবার্তা শুনেছি, আলাপ-আলোচনা করেছি। ওনারা লিখিত কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। ফলে জোট হচ্ছে না। আমরা আজ প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করব।’

তিপ্রা মথা এককভাবে নির্বাচনে লড়লে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সব দলই। কারন উপজাতীয় অঞ্চলে সব দলেরই কমবেশি ভোট রয়েছে। তবে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিজেপি। এর কারণ ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৬০ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৩৬টি আসন। কিন্তু তাদের জোট সঙ্গী ইন্ডিজিনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা (আইপিএফটি) পেয়েছিল আটটি আসন। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসতে ৩০ আসনের প্রয়োজন। তা যদি এবারে বিজেপি না পায়, তবে আইপিএফটির সাহায্য দরকার হবে। কিন্তু আইপিএফটি কোনো আসন না–ও পেতে পারে, কারণ আইপিএফটির ভোট গত কয়েক বছরে টেনে নিয়েছে তিপ্রা মথা। সে ক্ষেত্রে বিজেপির সমস্যা বাড়বে।

তবে ত্রিপুরায় তিপ্রা মথার একা লড়ার এই আত্মবিশ্বাস প্রমাণ করছে আগামী দিনে প্রদ্যুৎ দেববর্মনের দল রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার বিশ্বাস রাখে। সে ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়বে এমন মানুষের, যাঁরা জনজাতিভুক্ত নন। ত্রিপুরায় যাঁরা জনজাতি সমাজের মানুষ নন, তাঁরা প্রধানত বাঙালি হিন্দু। এঁদের সমস্যা বাড়বে বলে পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন। এর কারণ গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড বা বৃহত্তর ত্রিপুরা তৈরি হলে রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ জনজাতি সমাজের মানুষ দুই-তৃতীয়াংশ জমির দখল নেবেন। অপর দিকে দুই-তৃতীয়াংশও অ-জনজাতি মানুষের (যাঁরা প্রধানত বাঙালি) দখলে থাকবে এক-তৃতীয়াংশ জমি। এর ফলে ত্রিপুরা রাজ্য ফের বড় সংঘাতের দিকে যেতে পারে, বক্তব্য পর্যবেক্ষকদের।  

দেববর্মন অবশ্য এই আশঙ্কাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘প্রচুর বাঙালি জনজাতি–অধ্যুষিত অঞ্চলে থাকেন। আমরা চাই তাঁরা শান্তিতে থাকুন। ত্রিপুরা যখন রাজার অধীন ছিল তখন বাঙালি এবং জনজাতির মানুষ শান্তিতেই থেকেছেন এবং আমরা সেই ঐতিহ্যই বজায় রাখতে চাই।’

সত্তরের দশকের গোড়ায় ত্রিপুরা পুরোপুরি স্থানীয় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরে তা বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। বর্তমানে ত্রিপুরারাই সেখানে সংখ্যালঘু। এই বিষয়টি নিয়ে ত্রিপুরায় অতীতে বড় ধরনের সশস্ত্র জঙ্গি আন্দোলন হয়েছে।

গত বুধবার আসন সমঝোতার লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা দেখা করেন প্রদ্যুৎ দেববর্মনের সঙ্গে। দেববর্মনের দাবি ছিল, উপজাতিদের জন্য গ্রেটার গ্রেটার তিপ্রল্যান্ডের প্রতিশ্রুতি লিখিতভাবে বিজেপিকে দিতে হবে। তা দিতে বিজেপির নেতৃত্ব রাজি না হওয়ার পরে আজ শুক্রবার এককভাবে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিলেন দেববর্মন।