অবশেষে শুরু হতে চলেছে অতি বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) মামলার শুনানি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের তৈরি এ আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যত জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল, একযোগে সেগুলোর শুনানি শুরু হবে সোমবার। শুনানি হবে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত ও বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভাটের এজলাসে।
সুপ্রিম কোর্টের ৪৯তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর উদয় উমেশ ললিত বিচারের আশায় ঝুলে থাকা জনস্বার্থ মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তিতে মনোযোগী হয়েছেন। সোমবার তাঁর এজলাসসহ সুপ্রিম কোর্টের ১৫টি বেঞ্চে মোট ২২৮টি জনস্বার্থ মামলার শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতির এজলাসেই হবে ২০৫টির শুনানি, যার মধ্যে ১৮৯টি মামলা সিএএর সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মামলা করা হয়েছিল। সব মামলার শুনানি হবে একযোগে। শুনানি শেষে ঠিক হবে মামলাটি বৃহত্তর সাংবিধানিক বেঞ্চে পাঠানো হবে কি না।
নরেন্দ্র মোদির শাসনকালের অন্যতম প্রধান বিতর্কিত আইন সিএএ নথিবদ্ধ হয়েছিল ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর। ২০২০ সালে ১০ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশোধিত ওই আইনের নিয়মবিধি তৈরি করে উঠতে পারেনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সর্বশেষ মন্তব্যে বলেছিলেন, কোভিড পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলেই নিয়মবিধি তৈরি করে ফেলা হবে।
সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যাদের মধ্যে রয়েছে হিন্দু, শিখ, জৈন, পারসি, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান, তারা যদি ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে ভারতের নাগরিকত্ব চায়, তাহলে তাদের তা দেওয়া হবে। আইনের ‘কাট অব পিরিয়ড’ ছিল ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
নাগরিকত্ব সংশোধন আইন সেই সময় আনা হয়, বিজেপি সরকার যখন আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরিতে ব্যস্ত এবং সারা দেশে এনআরসি তৈরির কথা ঘোষণা করেছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে বলেছেন, ‘ক্রোনোলজিটা বুঝুন। প্রথমে নাগরিকত্ব আইন, তারপর সারা দেশের জন্য এনআরসি তৈরি হবে।’
সিএএ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে আবুধাবিতে বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারত সরকার এ আইন কেন করল বুঝি না, এর কোনো প্রয়োজনই ছিল না।’
এ আইন সংবিধানপরিপন্থী দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক মামলা হয়। জনস্বার্থ-সম্পর্কিত ওই মামলার বহর আপাতত ১৮৯। আবেদনকারীদের দাবি, ওই আইন ধর্মের আধারে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করবে, যা ভারতের সংবিধানবিরোধী। সিএএর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। দিল্লিতে শাহিনবাগ এলাকায় অবরোধ সৃষ্টি হয়। প্রবল ঠান্ডা উপেক্ষা করে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে হাজার হাজার স্থানীয় লোক অবরোধে শামিল হন। কোভিড পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠায় অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে দাঙ্গাও বাধে। শ শ আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয়।
জনস্বার্থ মামলা হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেই সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শরদ এ বোবদে, বিচারপতি বি আর গাবাই ও বিচারপতি সূর্যকান্ত কেন্দ্রীয় সরকারকে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আবেদনকারীদের দাবি মেনে আইন স্থগিতাদেশে সায় দেওয়া হয়নি। নোটিশের জবাবে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছিল, এ আইনে দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করা হয়নি। কোনো ভারতীয় নাগরিকের সংবিধান-স্বীকৃত কোনো অধিকারও খর্ব করা হচ্ছে না।
প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২৮ আগস্ট। তাঁর মেয়াদ মাত্র ৭৪ দিনের। চলতি বছরের ৮ নভেম্বর তিনি অবসর নেবেন। পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হওয়ার কথা ধনঞ্জয় যশবন্ত (ডি ওয়াই) চন্দ্রচূড়ের। ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করবেন। প্রধান বিচারপতি ললিত ও বিচারপতি চন্দ্রচূড় দুজনেই বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেছেন। দুজনেই জমে থাকা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে আগ্রহী। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে ৫ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর ১৫২টি জনস্বার্থ মামলার শুনানি হয়। সুপ্রিম কোর্টের রেকর্ড অনুযায়ী, সেগুলোর মধ্যে ৫১টির শুনানি হয় প্রধান বিচারপতির এজলাসে।
বকেয়া মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ও সমান আগ্রহী। গত শুক্রবার এক মামলায় এক পক্ষের আবেদনকারী শুনানি মুলতবি রাখার আবেদন জানালে বিচারপতি চন্দ্রচূড় তা নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘আমরা সুপ্রিম কোর্টকে “তারিখ পে তারিখ” কোর্ট করে তুলতে চাই না। আমরা এ ধারণা বদলাতে চাই।’
‘তারিখ পে তারিখ’ জনপ্রিয় ভারতীয় হিন্দি সিনেমা দামিনীর একটি সংলাপ। ১৯৯৩ সালে তৈরি ওই সিনেমার এক দৃশ্যে নায়ক সানি দেওলকে আদালতে দাঁড়িয়ে বলতে শোনা যায়, ‘তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ, একটার পর একটা তারিখ শুধু জুটছে ধর্মাবতার, বিচার মিলছে না।’
সিএএ নিয়ে শুনানির দিন ধার্য হলেও জম্মু-কাশ্মীর দ্বিখণ্ডীকরণ ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজের বিরুদ্ধে আনা মামলার শুনানি আজও শুরু হয়নি। ওই সিদ্ধান্তের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বহু মামলা সেই ২০১৯ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টে পড়ে আছে।