ধর্ষণের শিকার মাকে ন্যায়বিচার দিতে এগিয়ে এলেন ছেলে

ধর্ষণ
প্রতীকী ছবি

ভারতের উত্তর প্রদেশে ২৮ বছর আগে ১২ বছরের একটি মেয়ে কয়েকমাস ধরে ধর্ষণের শিকার হয়। অভিযোগ প্রতিবেশী দুই পুরুষের বিরুদ্ধে। সম্পর্কে তাঁরা ছিলেন দুই ভাই। মেয়েটি একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হন। তাঁর সদ্যোজাত ছেলেশিশুকে অন্য পরিবারের কাছে দত্তক দেওয়া হয়।

বড় হয়ে ছেলেটি জানতে পারেন, মায়ের ওপর এই নির্যাতনের কথা। ২৮ বছর পর মাকে ন্যায়বিচার দিতে আইনি লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। আইনি লড়াই করছেন মা–ও।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত বুধবার পুলিশ এ ঘটনায় অভিযুক্ত দুই প্রতিবেশীর একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আরেকজনকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ।

ধর্ষণের শিকার নারী বলেন, ‘ঘটনাটি অনেক পুরোনো। কিন্তু ক্ষতটা এখনো শুকায়নি। ওই ঘটনার কারণে আমার জীবন থমকে গিয়েছিল। সেই মুহূর্তগুলো আমার মনের মধ্যে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে।’

ভারতে প্রতিবছর হাজার হাজার শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী ভারতের শিশু সুরক্ষা আইনে ২০২০ সালে এ–সংক্রান্ত ৪৭ হাজার মামলা নথিভুক্ত করা হয়। তবে অধিকারকর্মীদের ধারণা, এর বেশি ঘটনা ভারতজুড়ে প্রতিবছর ঘটে। বেশির ভাগই প্রকাশ পায় না। এর একটি কারণ নির্যাতনের শিকার শিশু ওর সঙ্গে কী ঘটেছে, সে সেটা বুঝতেই পারে না। আরেকটি কারণ, শিশুরা নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর এতটাই ভয়ে থাকে যে তারা এ ঘটনা কাউকে বলে না। পরিবারগুলোও প্রায়ই সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার কারণে এসব ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেয় না।

ধর্ষণের শিকার ওই নারী বলেন, উত্তর প্রদেশের শাহজাহানপুর শহরে ১৯৯৪ সালে ধর্ষণের ঘটনাটি ঘটেছিল। অভিযুক্ত মোহাম্মদ রাজি ও তাঁর ভাই নাকি হাসান ছিলেন তাঁর প্রতিবেশী। ওই নারী জানান, তিনি বাড়িতে একা থাকলেই দুই ভাই সীমানাপ্রাচীর টপকে তাঁর বাড়িতে আসতেন এবং তাঁকে ধর্ষণ করতেন।

ওই নারী আরও বলেন, একপর্যায়ে শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে তাঁর বোন তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক তাঁর দুর্বল স্বাস্থ্য এবং অল্প বয়সের কারণে গর্ভপাতে রাজি হননি।

ধর্ষণের শিকার নারী বলেন, ‘সন্তানকে জন্ম দিতে অনেক কষ্ট করেছি। কিন্তু জন্মের পর ওর মুখ দেখার সুযোগও পাইনি।’ মাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, ‘তুমি বেঁচে থাকার জন্য দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়েছ।’

যৌন নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

ওই নারী বা তাঁর পরিবার ওই সময় পুলিশের কাছে অভিযোগ করেনি। এর কারণ হিসেবে ওই নারী বলেন, ‘ধর্ষণের কথা কাউকে জানালে তাঁরা আমার পরিবারের লোকজনকে হত্যা এবং আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন। আমি স্বপ্ন দেখতাম, বড় হয়ে পুলিশে যোগ দেব। কিন্তু ওই দুই পুরুষের কারণে আমার সব স্বপ্নের ইতি ঘটে। আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশোনা করতে পারিনি।’

দুর্বিষহ ওই ঘটনার স্মৃতি থেকে বাঁচতে একসময় পরিবারের সঙ্গে ওই নারী রামপুর জেলায় চলে যান। ২০০০ সালে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর একটি ছেলে হয়। তিনি বলেন, জীবনের নতুন এ অধ্যায় তাঁকে অতীত ভুলে যেতে সাহায্য করবে বলে তিনি মনে করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের ছয় বছরের মাথায় তাঁর স্বামী ধর্ষণের ঘটনাটি জানতে পারেন। এর জন্য তাঁকেই দায়ী করেন স্বামী। তখন এ সংসার থেকেও তাঁকে সন্তানসহ বের হয়ে যেতে হয়। তিনি গিয়ে ওঠেন তাঁর বোনের বাসায়। এরপর পরিবার ও বোনের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন তিনি।

মায়ের জন্য ছেলের লড়াই

ধর্ষণের পর জন্ম নেওয়া ওই নারীর ছেলেটিকে সামাজিকভাবে হেয় করা হতো। শিশুটিকে দত্তক নেওয়া মা বলেন, ‘প্রতিবেশীরা শিশুটিকে বলতে থাকেন, সে তাঁদের সন্তান নয়। এ কথা শুনতে শুনতেই সে বড় হতে থাকে।’ নানা কারণে দত্তক নেওয়ার ১৩ বছর পর মা–বাবা ছেলেটিকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন। মায়ের কাছে এসে ছেলেটি তাঁর বাবা কে, তা জানতে চান।

প্রথমে ধর্ষণের শিকার মা ছেলেকে বাবার নাম বলেননি। এভাবে কেটে যায় বেশ কিছুদিন। ধর্ষণের শিকার ওই নারী বলেন, একপর্যায়ে তাঁর ছেলে বাবার নাম না বললে আত্মহত্যা করবে বলে হুমকি দেন। পরে মা ছেলেকে পুরো ঘটনা খুলে বলতে বাধ্য হন।
সব কথা জানার পর ছেলে মায়ের পাশে দাঁড়ান। ছেলে মাকে অপরাধীদের শাস্তি দিতে বলেন। মাকে বোঝান, অপরাধীরা শাস্তি পেলে মানুষ বুঝবে যে অপরাধ করলে শাস্তি পেতেই হবে।

২০২০ সালে শাহজাহানপুরে ফিরে যান ধর্ষণের শিকার ওই নারী। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ঘটনাটি অনেক পুরোনো হওয়ায় পুলিশ এ মামলা নিতে রাজি হয়নি। তখন তিনি একজন আইনজীবীর কাছে যান। আইনজীবীও শুরুতে এই মামলা লড়তে রাজি হননি। বলেছিলেন, প্রায় তিন দশকের পুরোনো মামলা লড়া কঠিন হবে। ছোটবেলায় ওই নারী যে এলাকায় থাকতেন, সেটিও পাল্টে গিয়েছে। এমনকি ওই নারীর পুরোনো বাড়িটি এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

আইনজীবী ওই নারীকে বলেন, ‘আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন যে আপনি তিন দশক আগে যেখানে থাকতেন এবং সেখানেই আপনাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল?’ জবাবে ওই নারী আইনজীবীকে বলেছিলেন, ‘আপনি আমাদের মামলাটি লড়েন। আমরা আপনাকে প্রমাণ সংগ্রহ করে দেব।’ তখন আইনজীবী আদালতে একটি আপিল করেন এবং শাহজাহানপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ২০২১ সালের মার্চে দুই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়।

ওই নারী বলেন, পুলিশ তাঁকে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে বলেছে। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁদের খুঁজে পেয়েছি এবং ফোনে তাঁদের সঙ্গে কথাও বলেছি। তাঁরা আমাকে চিনতে পেরে বলেছে, আমি কেন এখনো মরে যাইনি। আমি তাঁদের বলেছি, এখন তোমাদের মরণের সময় হয়েছে।’

প্রমাণ সংগ্রহ ও গ্রেপ্তার

পুলিশ বলছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা গেলেও অপরাধের সঙ্গে তাঁদের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত গত ফেব্রুয়ারিতে করা ডিএনএ পরীক্ষা থেকে প্রমাণ মিলেছে।

শাহজাহানপুরের জ্যেষ্ঠ পুলিশ সুপার (এসএসপি) এস আনন্দ বলেন, ‘মামলাটি ছিল একেবারেই বিরল। ওই নারী যখন মামলা করলেন, আমরা বেশ অবাক হয়েছি। কিন্তু আমরা একটা সুযোগ নিয়েছি। তাঁর ছেলের (ধর্ষণের পর জন্ম নেওয়া) ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করি।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধর্মেন্দ্র কুমার গুপ্ত বলেন, ‘এরপর আমরা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করি এবং তা পরীক্ষা করি। তাঁদের মধ্যে একজনের ডিএনএ ওই ছেলের ডিএনএর সঙ্গে মিলেছে।’

গত ৩১ জুলাই তাঁদের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, আরও একজন তাঁদের হেফাজতে রয়েছেন। তবে এ বিষয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।

ধর্ষণের শিকার ওই নারী বলেন, তিনি চান তাঁর গল্প জেনে অন্যরা যেন অপরাধীদের শাস্তি দিতে এগিয়ে আসেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবশ্যই সবাইকে লড়াই করতে হবে। অপরাধী ধরা পড়ায় ছেলেটিও এখন খুশি বলে জানিয়েছেন।