স্বচ্ছতার স্বার্থে মুখবদ্ধ খাম নয়: ভারতের সুপ্রিম কোর্ট

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট
ছবি: এএফপি

ভারতের শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনে কেন্দ্রীয় সরকারের শর্ত খারিজ করে দিলেন সুপ্রিম কোর্ট। আজ শুক্রবার প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় সাফ জানিয়ে দিলেন, মুখবদ্ধ খামে সরকারের পরামর্শ তাঁরা গ্রহণ করবেন না। তেমন করলে মনে হবে ওটা সরকারের তৈরি করে দেওয়া কমিটি। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বচ্ছতা চাই।’

প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বিচারপতি পি এস নরসিংহ ও বিচারপতি জে বি পর্দিওয়ালার এজলাস জানিয়ে দেন, হিনডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টের ফলে ভারতীয় শেয়ারবাজারের অবস্থার যে হাল হয়েছে, তাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ কমিটি তাঁরাই গড়ে দেবেন। মুখবদ্ধ খামে সরকারের সুপারিশ গ্রহণ করবেন না।

হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে জালিয়াতি ও কারচুপি করে সম্পদ বৃদ্ধির অভিযোগ আনা হয়। তার জেরে ক্রমাগত ওই গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারের দাম কমতে শুরু করে। দুই সপ্তাহে ১০ লাখ কোটি রুপি বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। গৌতম আদানি বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী থেকে নেমে যান কুড়ির নিচে। শুরু হয় রাজনৈতিক বিতর্ক। শেয়ারবাজার ও অর্থনীতি দাঁড়ায় মারাত্মক প্রশ্নের মুখে। এ পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা দায়ের হয়। একটি মামলায় বলা হয়, সুপ্রিম কোর্ট যেন বাজার ও লগ্নিকারীদের স্বার্থ রক্ষায় তদন্ত কমিটি গড়ে দেন। সে বিষয়ে গত শুক্রবার প্রধান বিচারপতি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত জানতে চেয়েছিলেন। তাতে সলিসিটর জেনারেল জানিয়েছিলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের প্রস্তাবে আপত্তি নেই। তবে কারা সেই বিশেষজ্ঞ হতে পারেন, সেই নামগুলো সরকার মুখবদ্ধ খামে সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা দেবে। তাঁদের মধ্য থেকে আদালত কাউকে বেছে নিন। এ ছাড়া বলা হয়েছিল, কী কী বিষয় বিচার্য হওয়া উচিত, সরকার তা–ও মুখবদ্ধ খামে পেশ করবে। তা ছাড়া ওই তদন্তের মধ্য দিয়ে এমন কোনো বার্তা পাঠানো যাবে না, যাতে মনে হয় ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া ‘সেবি’ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।

শুক্রবার মামলার শুনানি শুরু হলে সলিসিটর জেনারেল মুখবদ্ধ খামে বিচার্য বিষয় ও বিশেষজ্ঞদের নাম পেশ করতে গেলে প্রধান বিচারপতি তা নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বচ্ছতার পক্ষে। মুখবদ্ধ খামে আপনাদের প্রস্তাব গ্রহণ করার অর্থ মামলাকারীরা তা জানতে পারবেন না। লোকে ভাববে ওই কমিটি সরকারেরই তৈরি করে দেওয়া। লগ্নিকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য আমরা পূর্ণ স্বচ্ছতার পক্ষে। কমিটি আমরাই গড়ে দেব। তাতে আদালতের প্রতি মানুষের আস্থাও থাকবে।’

সর্বোচ্চ আদালত এরপর বিভিন্ন আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন। আইনজীবী বিশাল তিওয়ারির জনস্বার্থ মামলায় বলা হয়, হিনডেনবার্গের প্রতিবেদনের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক কোনো বিচারপতিকে দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হোক। আইনজীবী এম এল শর্মার দায়ের করা মামলায় ‘শর্ট সেলিং’কে অপরাধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে বলা হয়, হিনডেনবার্গের প্রতিষ্ঠাতা নাথান অ্যান্ডারসনের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হোক। অপর এক মামলার আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানান। কংগ্রেস নেত্রী জয়া ঠাকুরের করা মামলায়ও বলা হয়, প্রতিবেদনে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও কারচুপির যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার তদন্ত করা হোক। খতিয়ে দেখা হোক ভারতীয় জীবনবিমা করপোরেশন ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার লগ্নিও।

হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন আদানি সাম্রাজ্য নিয়ে যেসব প্রশ্ন তুলেছে, তাতে যোগ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ধনকুবের জর্জ সোরোস। তিনি বলেছেন, এ ঘটনাবলির অভিঘাতে ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত হবে। জার্মানির মিউনিখ শহরে এক সম্মেলনে গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, এ ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনো নীরব। কিন্তু জবাব তাঁকে দিতেই হবে। তিনি বলেন, এর ফলে মোদির রাশ আলগা হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দরজাও খুলবে। তিনি বলেন, ‘আমি যে খুব একটা ভালো বুঝি তা নয়, তবে আশা করি ভারতীয় গণতন্ত্রের নবজাগরণ হবে।’

হিনডেনবার্গ রিপোর্ট, আদানির প্রতি আক্রমণ কিংবা বিবিসির তথ্যচিত্র যা কিছু মোদি সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে, শাসক দল ও সরকার প্রতিটি বিষয়কে ভারতীয় গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব ও মোদির জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দুনিয়ার আক্রমণ বলে চিহ্নিত করে চলেছে। সোরোসের মন্তব্যকেও বিজেপি সেভাবে আখ্যায়িত করেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি সংবাদ সম্মেলনে সোরোসকে আক্রমণ করে শুক্রবার বলেন, ভারত আগেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরাস্ত করেছে, এবারও করবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে তা করবে। সোরোসের মতো বিদেশি শক্তিকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য তিনি দেশবাসীকে তৈরি থাকতে অনুরোধ জানান। তবে মন্ত্রীকে কটাক্ষ করে তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য মহুয়া মৈত্র প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টুইট করে বলেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়া সোরোসের মুখের ওপর জবাব দিতে বলেছেন। সবাই অনুগ্রহ করে ঠিক সন্ধে ছটার সময় থালা বাজাবেন!’

সোরোসের বক্তব্যে কংগ্রেস যে উৎফুল্ল নয়, সে কথা জানিয়ে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ টুইট করে শুক্রবার বলেন, ভারতে গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলের সংস্কৃতি ও পরম্পরা জওহরলাল নেহরু তৈরি করে গেছেন। কংগ্রেস ও বিরোধী দলই তা পুনরুদ্ধার করবে। সোরোসের কোনো ভূমিকা নেই।