১৪ বছর আগের মন্তব্যের জন্য কি অরুন্ধতীর বিচার হবে

ভারতের বুকারজয়ী লেখক অরুন্ধতী রায়ফাইল ছবি: রয়টার্স

ভারতের অন্যতম বিখ্যাত লেখক তিনি। এক দশকের বেশি সময় আগে তাঁর করা মন্তব্যের জন্য তিনি কি সত্যিই বিচারের মুখোমুখি হবেন?

মূল অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল ২০১০ সালে। এর ১৪ বছর পর গত সপ্তাহে ভারতের বুকারজয়ী লেখক অরুন্ধতী রায়ের বিরুদ্ধে দেশটির কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচারের অনুমতি দিয়েছেন দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইনটির (ইউএপিএ) কুখ্যাতি আছে। এই আইনের মামলায় জামিন পাওয়া কঠিন। ফলে মামলায় প্রায়ই বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রাখা হয়।

ভারতের অধিকারকর্মী, সাংবাদিক, সুশীল সমাজের সদস্যসহ সমালোচকদের চুপ করিয়ে দিতে দেশটির কেন্দ্রীয় নরেন্দ্র মোদি সরকার এই আইন ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ আছে।

৬২ বছর বয়সী অরুন্ধতী একজন স্পষ্টভাষী লেখক ও অধিকারকর্মী। ভারতে সব সময় বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা কাশ্মীর নিয়ে মন্তব্যের জন্য তিনি এখন বিচারের মুখোমুখি।

২০১০ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে দিনব্যাপী এক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ‘কমিটি ফর দ্য রিলিজ অব পলিটিক্যাল প্রিজনার্স’। সম্মেলনে অরুন্ধতী বলেছিলেন, ‘কাশ্মীর কখনোই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল না। এটা একটা ঐতিহাসিক সত্য। এমনকি ভারত সরকারও তা মেনে নিয়েছে।’

সে সময় ভারতশাসিত কাশ্মীর অশান্ত ছিল। স্থানীয় লোকজন সেই পরিস্থিতিকে ভারতের বিরুদ্ধে একটি ‘প্রচণ্ড বিদ্রোহ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।

২০১০ সালের শুরুর দিকে কাশ্মীরে স্বাধীনতার পক্ষে নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। বিক্ষোভকালে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিহত হন। এ ঘটনার ধারাবাহিকতায় সে বছরের অক্টোবরে দিল্লির সম্মেলনে কাশ্মীর নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন অরুন্ধতী।

পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশই বিতর্কিত অঞ্চলটি (কাশ্মীর) পুরোপুরি নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। এমনকি কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দুটি যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছে।

কাশ্মীর নিয়ে অরুন্ধতীর মন্তব্য অনুমিতভাবে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। অনেক সমালোচক ভারতের প্রতি তাঁর আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়েছিল।

তৎকালীন ভারত সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেছিলেন, ভারতে বাক্‌স্বাধীনতা রয়েছে। তবে এই স্বাধীনতা দেশটির জনগণের দেশপ্রেমের অনুভূতিকে লঙ্ঘন করতে পারে না।

দিল্লির উপকণ্ঠের অভিজাত এলাকায় অরুন্ধতীর বাড়ির বাইরে তখন বিক্ষোভ হয়েছিল। অরুন্ধতী, কাশ্মীরের আইনের শিক্ষক শেখ শওকত হুসেন ছাড়া আরও দুজনের বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি অভিযোগ তখন দায়ের করা হয়। এতে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়।

বিতর্কের জেরে অরুন্ধতী তাঁর বাক্‌স্বাধীনতার অধিকারের পক্ষে একটি প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি প্রতিক্রিয়ায় লেখেন, ‘পত্রপত্রিকায় কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য দেওয়া, ভারত ভাঙতে চাই বলে অভিযোগ করেছে। পক্ষান্তরে আমি যা বলি, তা ভালোবাসা ও গর্ব থেকে আসে।’

অরুন্ধতী আরও লিখেছিলেন, আফসোস সেই জাতির জন্য, যারা মনের কথা বলার জন্য তাদের লেখকদের চুপ করিয়ে দেয়।

বক্তব্যের এক দশকের বেশি সময় পর অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে মামলা ও বিচারের মুখোমুখি করার সিদ্ধান্তে আইনজীবীরা বিভ্রান্ত।

অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে মূলত রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০২২ সালের মে মাসে ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন স্থগিত করেন। কিন্তু এখন ইউএপিএ আইনের অধীন মামলার অনুমতি দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ এড়িয়ে বিচারকাজ এগিয়ে নিতে পারবে সরকার।

মোদি সরকারের একজন কঠোর সমালোচক অরুন্ধতী। অধিকার গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, মোদি সরকার অধিকারকর্মীদের নিশানা করছে। বাক্‌স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করছে।

সম্প্রতি মোদি তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এরপরই অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে মামলার অনুমতি দেওয়া হলো।

অনেকেই মোদি সরকারের এই পদক্ষেপকে একটি রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে দেখছেন। বার্তাটি হলো, এবার বিজেপি জোট সরকার গড়লেও ভিন্নমত দমনে তারা কঠোর পন্থা অবলম্বনের কৌশল অব্যাহত রাখবে।

২০১০ সালে সুশীল পণ্ডিত নামের এক ব্যক্তি অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে অভিযোগটি দায়ের করেছিলেন। অভিযোগ দায়েরের এত বছর পর মামলার অনুমতির কারণ সম্পর্কে কিছু বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

টাইমস নাউ টেলিভিশনকে সুশীল বলেন, যাঁরা এই নথি (ফাইল) নিয়ে বসেছিলেন, আর এখন তা সচল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদেরই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা উচিত। কেন দেরি হলো, সে বিষয়ে একটি তদন্ত হওয়া উচিত। জবাবদিহি আদায় করা উচিত।

অনেকে এই পদক্ষেপকে মোদির সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার আরেকটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। লেখক অমিতাভ ঘোষ এক্সে (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, অরুন্ধতীকে হেনস্তা করা পুরোপুরি বিবেকবর্জিত কাজ। তিনি একজন বড় মাপের লেখক। তাঁর মতামত দেওয়ার অধিকার রয়েছে। এক দশক আগে তিনি যা বলেছিলেন, সে জন্য তাঁর বিচার করার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবাদ হওয়া উচিত।

গত বছরের অক্টোবরে দিল্লির কর্তৃপক্ষ মামলাটি আদালতে নিয়ে যাওয়ার অনুমোদন দেয়। তখন কানাডার লেখক ও অধিকারকর্মী নাওমি ক্লেইন এক্স পোস্টে মোদিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনার সবচেয়ে সোচ্চার সমালোচককে চুপ করানোর জন্য এই রাজনৈতিক বিচারের পরিণতি কী হবে, সে সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণা নেই।’

গত দুই দশকে অরুন্ধতী কাশ্মীর, পারমাণবিক অস্ত্র, বড় বাঁধ, বিশ্বায়ন, দলিত আইকন বি আর আম্বেদকর, মাওবাদী বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠক, এডওয়ার্ড স্নোডেন ও জন কুসাকের সঙ্গে কথোপকথনের মতো বিষয়ের ওপর বেশ কিছু নন-ফিকশন বইসহ অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন।

‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ অরুন্ধতীর শৈশব অনুপ্রাণিত একটি পারিবারিক উপন্যাস। এটি ১৯৯৭ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পায়। তিনি অল্প বয়সেই তারকা লেখক বনে যান।

৬২ বছর বয়সী এই লেখককে নিয়ে ভারতের মানুষের মধ্যে মেরুকরণ রয়েছে।

অরুন্ধতীর প্রতি অনুরক্তরা তাঁকে উদারনৈতিক মূল্যবোধের জন্য একটি নেতৃস্থানীয় কণ্ঠস্বর এবং প্রান্তিক মানুষের জন্য নিরলসভাবে কাজ করা একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখেন।

অন্যদিকে সমালোচকেরা অরুন্ধতীর কুশপুত্তলিকা পর্যন্ত পুড়িয়েছেন। তাঁরা তাঁর নানা অনুষ্ঠান ভন্ডুল করেছেন। তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ ও অবমাননার অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি বড় বড় বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তিনি এক দিন কারাগারে পর্যন্ত কাটিয়েছেন।

অরুন্ধতীর ২০১০ সালের মন্তব্যের পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে।

২০১৯ সালে মোদি সরকার কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বা আধা স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা প্রত্যাহার করে। অঞ্চলটিকে বিভক্ত করে। বিভক্ত এলাকা সরাসরি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সেখানকার রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন অনেকটা স্তব্ধ করে দেয় সরকার।

অনেকে বিশ্বাস করেন, ভারতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও কমেছে। ২০১৪ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ছিল ১৪০। ২০২৩ সালে দেশটির অবস্থান ১৬১তম স্থানে নেমে এসেছে।

মামলাসংক্রান্ত সর্বশেষ ঘটনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি অরুন্ধতী।

পুলিশ অভিযোগের তদন্ত করেছে কি না বা অরুন্ধতীসহ অন্য ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

মূল অভিযোগে নাম থাকা দুই ব্যক্তি ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত। যদি ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত লেখকদের একজনকে একটি কঠোর সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়, তাহলে তা বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও ক্ষোভের জন্ম দেবে।