হরিয়ানার ভোট : অ্যাডভান্টেজ কংগ্রেস নাকি বিজেপির হ্যাটট্রিক
বিজেপির হ্যাটট্রিক নাকি কংগ্রেসের কাছে আরও এক রাজ্য হারানো, এই দুই সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হলো হরিয়ানা বিধানসভার ভোট। রাজ্যের ৯০ আসনবিশিষ্ট বিধানসভার দখল কারা নেবে, তা ঠিক করতে সকাল থেকে বুথে বুথে হাজির রাজ্যের মানুষ। মোট ভোটার দুই কোটি। ভোট শতাংশের হার বুঝিয়ে দেবে রাজ্যের মানুষ পরিবর্তন চাইছেন নাকি স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে আগ্রহী।
নির্বাচন কমিশনের হিসাবে আজ শনিবার বেলা তিনটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৪৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। ১০ বছর ধরে হরিয়ানায় বিজেপি ক্ষমতায়। ২০১৪ সালের ভোটে বিজেপি একাই সরকার গড়েছিল, পেয়েছিল ৪৭ আসন। দ্বিতীয় স্থানে ছিল ওমপ্রকাশ চৌটালার দল আইএনএলডি। তারা ১৯টি আসন পেয়েছিল। কংগ্রেস নেমে এসেছিল তৃতীয় স্থানে, ১৫ আসন জিতে। ২০১৯ সালের ভোটে বিজেপি পায় ৪০ আসন, কংগ্রেস ৩১। আইএনএলডি ভেঙে গড়ে ওঠা দুষ্মন্ত চৌটালার জেজেপি জিতেছিল ১০ আসন। তাদের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়ে বিজেপি। সেই জোট এবার ভেঙে গেছে। বিজেপি এবার বন্ধুহীন। কংগ্রেসও লড়ছে একা। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক আম আদমি পার্টির (আপ) সঙ্গে তারা জোট বাঁধেনি। জেজেপি জোটবদ্ধ হয়েছে দলিত নেতা চন্দ্রশেখর আজাদের দল আজাদ সমাজ পার্টির সঙ্গে। আইএনএলডির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে মায়াবতীর বিএসপি। যদিও এবারের লড়াই কার্যত দ্বিমুখী। বিজেপির একমাত্র চ্যালেঞ্জার কংগ্রেস।
সেই লড়াইয়ে হাওয়ার অভিমুখ অবশ্যই কংগ্রেসের দিকে। যাবতীয় জরিপ ও সমীক্ষা দেখাচ্ছে, কংগ্রেসের পালেই হাওয়া বেশি। এই আগাম দেয়াললিখন বিজেপিও হয়তো বুঝে গেছে। নইলে এই রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মাত্র চারটি জনসভা করতেন না। নির্বাচনী প্রচারের শেষ দুই দিনে মোদি বা অমিত শাহ কেউই হরিয়ানায় পা ফেলেননি। তবু আজ সকালে ভোট দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নায়িব সিং সাইনি বলেছেন, ক্ষমতায় আসছে বিজেপিই। জয়ের হ্যাটট্রিক হতে চলেছে। হরিয়ানার সঙ্গেই জম্মু-কাশ্মীরের ভোট গণনা হবে ৮ অক্টোবর। ফল ঘোষণা ওই দিনেই।
হরিয়ানার এবারের লড়াইয়ের সুর মোটামুটিভাবে বেঁধে দিয়েছে কিসান, জওয়ান ও পালোয়ানরা। কৃষক আন্দোলন নিয়ে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মতো উত্তাল ভারতের আর কোনো রাজ্য হয়নি। এই আন্দোলনের জন্যই হরিয়ানার বহু গ্রামে বিজেপি নেতারা এবার প্রচারের জন্য যেতে পারেননি। জাট–প্রধান এই রাজ্যে জাটদের সমর্থন বিজেপি সেভাবে কখনো পায়নি। ২০১৪ সালে তাই তারা জাটবিরোধী শক্তিদের একজোট করেছিল। অ-জাট ব্যবসায়ীদের ঐতিহ্যগত সমর্থনের সঙ্গে জুড়েছিল দলিত ও অনগ্রসরদের। জিতে মুখ্যমন্ত্রী করেছিল তাঁদেরই প্রতিনিধি মনোহরলাল খাট্টারকে। যে হরিয়ানায় মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকায় জাটের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি, সেখানে অ-জাট মনোহরলালের (পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে চলে আসা ক্ষেত্রী সম্প্রদায়) প্রায় সাড়ে ৯ বছরের রাজত্ব জাট সম্প্রদায়কে এবার জোটবদ্ধ করেছে কংগ্রেসের দিকে। নেতৃত্ব দিচ্ছেন কংগ্রেসের জাট নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভূপিন্দর সিং হুডা। এর মোকাবিলায় বিজেপি মনোহরলালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী করেছে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের নায়েব সিং সাইনিকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাটদের মতো অ-জাট কৃষক সম্প্রদায়কেও বিজেপি কাছে টানতে পারেনি। কৃষক সমাজের সমর্থনের সিংহভাগ এবার কংগ্রেস পাবে বলে সব জরিপের ধারণা।
কিসানদের পাশাপাশি কংগ্রেসের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন জওয়ানদের পরিবারেরাও। সারা ভারতের মতো হরিয়ানায়ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিজেপি চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। বেকারত্বের জ্বালা সর্বত্র। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এই রাজ্যের যুব সম্প্রদায়ের চিরকালীন ঐতিহ্য। সেই চাকরিও বিজেপি সরকার চুক্তিভিত্তিক করে তুলেছে। চালু করেছে ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্প, যার বিরোধিতায় কোমর কষে নেমেছে কংগ্রেস। বিজেপি এই অসন্তোষের সামাল দিতে ব্যর্থ। নানাভাবে মূল প্রকল্পে সংস্কারের কথা তারা বলছে। কিন্তু কংগ্রেস বলেছে, কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে এই প্রকল্প বাতিল করে তারা পুরোনো পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করবে। বেকার ও গ্রামীণ ভোটারদের ক্ষোভ বিজেপির বিরুদ্ধে গেলে জেতা কঠিন।
এই দুই মহলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পালোয়ান বা কুস্তিগিরদের ক্ষোভ, বিশেষ করে মহিলা মহলের। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুস্তিগির বিনেশ ফোগত, সাক্ষী মালিক বা বজরঙ্গ পুনিয়ারা ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের কর্তা বিজেপির সংসদ সদস্য ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ এনেছিলেন গত বছর। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে বিজেপি এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যা কুস্তিগিরদের সন্তুষ্ট করতে পারে; বরং তাঁদের আন্দোলন ভাঙতে দিল্লির পুলিশ বলপ্রয়োগ পর্যন্ত করেছিল। পরবর্তী সময়ে অলিম্পিকসে ৫-০ কেজি বিভাগে সোনার খেতাবের লড়াইয়ের আগে সামান্য ওজন বৃদ্ধির জন্য (এক শ গ্রাম) বিনেশ ছিটকে গেলে সেটাও বিজেপি ষড়যন্ত্র বলে প্রচার পায়। কুস্তি থেকে অবসর নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বিনেশ ও বজরঙ্গ পুনিয়া কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। বিনেশ প্রার্থী হয়েছেন জুলানা কেন্দ্র থেকে, যেখানে কংগ্রেস বহু বছর জেতেনি, যা কিনা বিজেপির গড় বলে পরিচিত। কুস্তি হরিয়ানার গ্রামে গ্রামে, অন্যান্য খেলাও। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে হরিয়ানার ছেলেমেয়ে দলে দলে কুস্তি ও অন্যান্য খেলায় এগিয়ে আসছেন অনেক দিন ধরে। পালোয়ানদের প্রতি বিজেপির আচরণ, বিশেষ করে বিনেশের অসম্মান, রাজ্যের মহিলাদের এক বড় অংশকে বিজেপি বিমুখ করে তুলেছে।
এই তিন ভোট ব্যাংকের সিংহভাগ সমর্থন কংগ্রেসের আশার ফানুস ফুলিয়েছে। পাশাপাশি তফসিল জাতি, দলিত ও অনগ্রসরদের সমর্থন পেতে রাহুল গান্ধী বারবার জাত গণনার ওপর জোর দিয়ে চলেছেন। আপাতদৃষ্টে এবার হরিয়ানার লড়াই তাই নিতান্তই একপেশে বলে মনে হচ্ছে।
তবুও সংশয়ের কারণ যদি কিছু থাকে, সে জন্যও দায়ী কংগ্রেস এবং তার চিরায়ত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ১০ বছর ধরে হরিয়ানা কংগ্রেসের রাশ প্রধানত দুই শিবিরে বিভক্ত। জাট নেতা ভূপিন্দর সিং হুডা ও তাঁর সংসদ সদস্যের পুত্র দেপীন্দর সিংয়ের বিপরীতে রয়েছেন দলিত নেত্রী কুমারী শৈলজা। শৈলজার সঙ্গী কংগ্রেসের অন্যতম মুখপাত্র রণদীপ সিং সুরযেওয়ালা। এবার প্রার্থীদের সিংহভাগ হুডা আদায় করেছেন। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও জাট হুডার ওপর বেশি ভরসা রেখেছে। অভিমান করে ঘরে বসেছিলেন শৈলজা। শেষ বেলায় রাহুল তাঁকে আসরে নামালেও দলিত সমর্থন কংগ্রেস কতটা পাবে সন্দেহ। হুডার বিরোধিতা করে দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন জাট নেত্রী কিরণ চৌধুরীও। তাঁর কন্যা এবার বিজেপির প্রার্থী। রাজ্য রাজনীতিতে হুডা বিরোধী বলে পরিচিত সাবেক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অশোক তানওয়ার নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিনে নাটকীয়ভাবে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। ভোটে এসবের প্রভাব কতখানি পড়বে, বলা কঠিন। যদিও এ বিষয়ে সংশয় নেই, এবার হরিয়ানার ভোটে ফেভারিট কেউ থাকলে তা কংগ্রেস। টেনিসের পরিভাষায় ‘অ্যাডভান্টেজ কংগ্রেস’।
কংগ্রেস জিতলে উত্তর ভারতে হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাবের পর হরিয়ানা চলে যাবে বিরোধীদের দখলে। সামনে ভোট মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড ও দিল্লি বিধানসভার। আগামী দিনগুলো নরেন্দ্র মোদির পক্ষে খুব একটা স্বস্তিদায়ক হবে কি?