আরএসএসের প্রধান তবে কি ৭৫ বছরে মোদিকেও অবসরে যাওয়ার কথা বললেন

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও আরএসএসের প্রধান মোহন ভাগবতফাইল ছবি: রয়টার্স

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর মন্তব্যের মধ্য দিয়ে যার শুরু, সেই জল্পনা বহুগুণ বাড়িয়ে দিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত। গত বুধবার রাতে নাগপুরে তিনি বললেন, ৭৫ বছর বয়সে কাউকে শাল জড়িয়ে সংবর্ধনা দিলে তার একটাই অর্থ দাঁড়ায়, অনেক বয়স হয়েছে, এবার সরে যান। অন্যদের কাজ করতে দিন।

অমিত শাহর বয়স কিন্তু ৭৫ নয়, মাত্র ৬০। অর্থাৎ এখনো ১৫ বছরের সক্রিয় রাজনৈতিক ও কর্মজীবন তাঁর সামনে অপেক্ষায় রয়েছে। তবুও গত বুধবার গুজরাটের আমেদাবাদে এক অনুষ্ঠানে হঠাৎ তিনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শুনিয়ে বলেছিলেন, অবসর জীবন বেদ ও উপনিষদ পাঠের পাশাপাশি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে কাটাবেন।

হুট করে এ বয়সে অমিত শাহর মুখে অবসরের কথা শুনে রাজনীতিতে যে জল্পনার সূত্রপাত, গত বুধবার রাতেই তা দ্বিগুণ হয়ে ওঠে সংঘপ্রধান মোহন ভাগবতের কথায়। শুরু হয়েছে চর্চা, তবে কি বিজেপির রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদির উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘে সত্যি সত্যিই চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে? ৭৫ বছর পূর্তির পর তবে কি মোদিকে সরে যেতেই হবে, যে বয়সসীমা ১১ বছর আগে তিনি নিজেই নির্ধারণ করেছিলেন?

মোহন ভাগবত অবসর–সম্পর্কিত মন্তব্য করেন নাগপুরে, সংঘের সাবেক প্রচারক মোরোপন্ত পিঙ্গলের জীবন নিয়ে লেখা একটি বইয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে।

মোরোপন্তের আদর্শ ও জীবনের নানা দিক পর্যালোচনার সময় তিনি বলেন, ‘কর্মজীবন সম্পর্কে মোরোপন্তই বলেছিলেন, ৭৫ বছর বয়স হলে কেউ যদি আপনার গলায় শাল জড়িয়ে আপনাকে সংবর্ধনা জানান, তা হলে বোঝা উচিত কোন বার্তা দেওয়া হচ্ছে। বার্তা এটাই, আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এবার সরে দাঁড়ান। কনিষ্ঠদের কাজ করতে দিন।’

মোরোপন্তের এ কথা স্মরণ করিয়ে ভাগবত ওই অনুষ্ঠানে বলেন, মোরোপন্ত বিশ্বাস করতেন, বয়স হলে সবার উচিত সম্মানের সঙ্গে সরে যাওয়া।

সাবেক প্রচারক মোরোপন্তের ওই মন্তব্য মনে করিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক চর্চা, তবে কি সংঘপ্রধানও অবসর নিয়ে বিশেষ বার্তা দিতে চাইলেন? নিজের ও মোদির ক্ষেত্রে? চর্চার কারণও আছে। মোদির মতো ভাগবতও এ বছরের সেপ্টেম্বরে ৭৫ বছরে পড়ছেন।

১৯৫০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মোহন ভাগবতের জন্ম। তার ছয় দিন পর জন্ম নরেন্দ্র মোদির। তবে কি দুজনেই সরে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে ব্যাটন দিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেছেন? সেই পরিস্থিতির কথা জেনেবুঝেই কি তাহলে অমিত শাহও অবসর নেওয়ার কথা শুনিয়ে রাখলেন? তাহলে কি তিনিও বুঝতে পেরেছেন, মোদিহীন বিজেপিতে তাঁর গুরুত্ব কমে যাবে?

অবসর–সম্পর্কিত জোড়া মন্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা সরব হয়েছেন। শিবসেনা (উদ্ধব) নেতা সঞ্জয় রাউত বলেন, ‘৭৫ বছরের গণ্ডি তো নরেন্দ্র মোদিই কেটে দিয়েছেন। লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর যোশি, যশোবন্ত সিং ও যশবন্ত সিনহাদের অবসর গ্রহণে তো তিনিই বাধ্য করেছেন। নিজের ক্ষেত্রেও তাঁর উচিত সেই নিয়ম জারি করা। মোহন ভাগবত তাঁকে সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন।’

একই সুরে কথা বলেছেন কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিংভি। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, কথায় আছে, ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও।’ অর্থাৎ অন্যকে যা পালন করতে বলবে, তা নিজেরও করা দরকার। না হলে সেটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ৭৫ বছর বয়সে যিনি যাঁদের অবসরে পাঠালেন, দেখেশুনে মনে হচ্ছে তাঁর ক্ষেত্রেও ওই নিয়ম খাটবে না।

মোদির ক্ষেত্রে তাঁর তৈরি নীতি না খাটার বিষয়ে সন্দেহ জাগার কারণ বিজেপিতে তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ। এমনকি কখনো কখনো মনে হয়, সংঘ পরিচালনার ক্ষেত্রেও মোদির সিদ্ধান্ত প্রাধান্য পাচ্ছে। এ ধারণার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, বিজেপির সভাপতি নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা। জেপি নাড্ডার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন তা নিয়ে মোদি–শাহর সঙ্গে সংঘ নেতৃত্ব এখনো সহমত হতে পারেননি।

সংঘ পরিবার চাইছে বিজেপিতে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে, মোদি–শাহ চাইছেন নাড্ডার মতো তাঁদের অনুগত কাউকে সভাপতি করে দল নিয়ন্ত্রণে রাখতে। এই টানাপড়েনের মীমাংসা না হওয়ার কারণেই নাড্ডাকে এখনো কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে।

পাঁচ বছর আগে মোহন ভাগবতই বলেছিলেন, মোদির ক্ষেত্রে ৭৫ বছরের নিয়ম না–ও খাটতে পারে। কারণ, তিনি ব্যতিক্রমী। আর ব্যতিক্রমই নিয়মের গুরুত্ব বোঝায়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর অমিত শাহসহ বিজেপি নেতারাও বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদি ২০২৯ সালের ভোটেও বিজেপির নেতৃত্ব দেবেন।

মোহন ভাগবত অবশ্য নিজের অবসর গ্রহণ নিয়ে আগেও ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদিও আরএসএসে পদে থাকার বিষয়ে বয়সের কোনো সীমা নেই। বয়সের ভারে নু৵ব্জ না হওয়া পর্যন্ত কোনো সংঘচালক এ যাবৎ অবসর নেননি। বালাসাহেব দেওরস, রাজ্জু ভাইয়া, কে সুদর্শন—প্রত্যেকেই স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার পরই পদ থেকে সরে গেছেন। রাজ্জু ভাইয়া ও সুদর্শন ৭৮ বছর বয়স পর্যন্ত পদাসীন ছিলেন। বালাসাহেব দেওরস ৭৯ বছর বয়স পর্যন্ত। প্রত্যেকেই শারীরিক কারণে অবসর নিয়েছিলেন। পঁচাত্তরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সংঘচালক মোহন ভাগবত ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুজনেই এখনো প্রবলভাবে কর্মক্ষম।