শঙ্কা ও সন্দেহ বাড়িয়েই চলেছে ভারতের নির্বাচন কমিশন

ভোটফাইল ছবি: রয়টার্স

পাঁচ দফা ভোট হয়ে গেলেও ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসি) তার নিরপেক্ষতা ও দৃঢ়তার নিদর্শন এখনো দিতে পারল না। ফলে দেশবাসীও নিশ্চিত নয়, এবারের নির্বাচন কতটা পক্ষপাতহীন ও সমানে সমানে হচ্ছে।

এবার ভোট পর্বের একেবারে শুরু থেকেই ইসি নানা রকম সমালোচনায় বিদ্ধ। তিন সদস্যের কমিশনে একটি পদ শূন্য ছিল। তফসিল ঘোষণার ঠিক আগে গত ১১ মার্চ অন্যতম কমিশনার অরুণ গোয়েল পদত্যাগ করেন। কোনো কারণ না জানিয়ে তাঁর পদত্যাগ নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। তিনি নিজে অথবা সরকার—কারও দিক থেকেই সেসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি। সেই চমক ছাপিয়ে যায় সরকারের সিদ্ধান্ত। চার দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার দুই কমিশনারের নাম ঘোষণা করে। মনোনীত হন সুখবীর সিং সান্ধু ও জ্ঞানেশ কুমার। ১৬ মার্চ নতুন ইসি জানিয়ে দেয় সাত দফা ভোটের তফসিল। ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন বাদ দিলে এত দিন ধরে এতগুলো পর্যায়ে ভারতের লোকসভা ভোট আর কখনো হয়নি।

নির্বাচন কমিশন যে নিরপেক্ষ আচরণ করতে পারবে না, সেই ইঙ্গিত ও ধারণার জন্মও সেই থেকে। এত দিন ধরে তিন সদস্যের কমিশনের নিযুক্তির দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী নেতা ও দেশের প্রধান বিচারপতি। সেই প্রথা থেকে সরে আসতে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করে, যেখানে নিযুক্তির দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। সে জায়গায় আনা হয় প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের কোনো এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। ফলে নতুন দুই কমিশনারকে দ্রুত নিযুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও বিরোধী নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী। সেই নিযুক্তির প্রক্রিয়া কতখানি হাস্যকর ও আগে থাকতে স্থির করা ছিল, সে কথা অধীর চৌধুরী নিজেই বর্ণনা করেছেন।

সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগ ও বদলির দায়িত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত ‘কলেজিয়াম’ পদ্ধতিতে তা হয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী মোদি চান সেই নিযুক্তিতে নির্বাচিত সরকারের ভূমিকা থাকুক। কিন্তু বিচার বিভাগ রাজি নয়। এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই কেন্দ্রীয় সরকার ও সুপ্রিম কোর্টের ঠান্ডা লড়াই চলছে। বিচারপতি নিযুক্তিতে ক্ষমতা না পেয়ে ইসি নির্বাচনের প্রথা থেকে সরকার তাই প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে দেয়। ফলে ইসির নিরপেক্ষতা রক্ষার প্রশ্নটি শুরু থেকেই আরও বড় হয়ে ওঠে।

নতুন ইসি সাত দফার ভোট ঘোষণা কেন করল, সে বিস্ময় আজও কাটেনি। মে-জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে এত দিন ধরে প্রচার পর্ব চালানো অসম্ভব কষ্টকর। দুই দফার ভোটের মধ্যে কেন সাত থেকে আট দিনের বিরতি, সে ব্যাখ্যাও গ্রহণযোগ্য নয়। আরও নয় এই কারণে যে ২০০৪ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র ২১ দিনে। জনপ্রিয় ধারণা, ইসি এ কাজ করেছে যাতে প্রতি পর্বে সর্বত্র প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রচার করতে পারেন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের একমাত্র মুখ তিনিই। প্রচারে তাঁকে পেতে সবাই উন্মুখও। তা ছাড়া এত দিন ধরে প্রচার চালানো অন্য দলের পক্ষে সম্ভবও নয়। ভারতের মতো বিশাল দেশে নির্বাচন অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য। ফলে বেশি দিন ধরে ভোট করার অর্থ বিজেপিকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দেওয়া।

ইসির নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে অন্য ক্ষেত্রেও। ভোটের তফসিল শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ইসি জানিয়ে দিয়েছিল, আদর্শ আচরণবিধি পালনের ক্ষেত্রে তারা কঠোর মনোভাব নেবে। কিছুতেই নেতাদের তা ভাঙতে দেবে না। রাজনৈতিক দলগুলো ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ বা সমান সুযোগ যাতে পেতে পারে, সে জন্য তারা সক্রিয় থাকবে বলেও জানায়। তফসিল ঘোষণার পর কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রশাসন ও পুলিশ পুরোপুরি ইসির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ইসি যেকোনো সময়ে আমলা ও পুলিশ কর্তাদের বদলি করতে পারে। নতুন কাউকে দায়িত্বে আনতে পারে। ইসির সম্মতি ছাড়া প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। অথচ দেখা গেল, এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি), সিবিআই তাদের ইচ্ছেমতো কাজ করে যাচ্ছে। বিরোধীদের তটস্থ করে রাখছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করে হেফাজতে রাখছে। ওই সিদ্ধান্ত তারা ইসিকে জানিয়ে করেছে কি না কিংবা তাদের সম্মতিতে, সে ব্যাখ্যা কোনো মহল থেকে পাওয়া যায়নি। ইসিও আপত্তি করেনি। সমালোচিত হয়েও তারা এ নিয়ে মুখ খোলেনি। বিরোধীদের অভিযোগ, ইসি সরকারের হাতের পুতুল হয়ে রয়েছে। এই সাংবিধানিক সংস্থা যে তেমন নয়, তা প্রমাণে ইসি বিন্দুমাত্র উদ্যোগী হয়নি। তিন সদস্যের এই কমিশন কতটা সরকারের অনুগত ও অন্ধভক্ত, তা বারবার প্রমাণিত।

অতীতেও সে প্রমাণ ইসি রেখেছে। এবার আরও বড়ভাবে রাখছে। ২০১৯ সালে তিন সদস্যের কমিশনের কাছে খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণের অভিযোগ জমা পড়েছিল। অভিযোগ ছিল ধর্মের নামে ভোট চাওয়ার। সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর। মোট ছয়টি অভিযোগের একটিও তৎকালীন ইসি গ্রহণ করেনি। অন্যতম সদস্য অশোক লাভাসা আপত্তি জানিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, মোদি ও শাহ অপরাধী। কিন্তু তাঁর মতামত সংখ্যাধিক্যের (২-১) রায়ে খারিজ হয়ে যায়। মোদি ও শাহ নির্দোষ প্রতিপন্ন হয়েছিলেন। অশোক লাভাসাকে ইসি থেকে সরে যেতে হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও বোনকে হেনস্তা হতে হয়েছিল আয়কর বিভাগের হাতে। ভারতের গণতন্ত্রও তখন থেকে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ হিসেবে পরিচিত।

এবারেও সেই এক চিত্রনাট্য। ১৯ এপ্রিল প্রথম দফার ভোটের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি হঠাৎই ‘হিন্দু-মুসলমান’ রাজনীতি নিয়ে সরব হয়ে ওঠেন। বলেন, সাধারণ মানুষের সম্পদ কেড়ে কংগ্রেস বিলিয়ে দেবে তাদের, যারা ‘কাঁড়ি কাঁড়ি বাচ্চার জন্ম দেয়’, যারা ‘অনুপ্রবেশকারী’। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের এক ভাষণের উল্লেখ করে বলেন, এ দেশের সম্পদের প্রথম দাবিদার মুসলমানরা। জনতার কাছে তিনি জানতে চান, ‘বলুন, মঞ্জুর কি না।’

কংগ্রেস ও বামপন্থীরা মোদির ওই ভাষণের প্রতিবাদ জানিয়ে ইসিতে নালিশ করে পরের দিন। চারদিকে সমালোচনার বান বয়ে যায়। অথচ এক মাস কেটে গেল, প্রধানমন্ত্রী মোদি দোষী না নির্দোষ, ইসি আজও তা জানাতে পারল না। প্রথম দফার ভোটের পরদিন যে বিতর্কের সূত্রপাত, এক মাস পর পঞ্চম দফার ভোটের সময়েও তা জানা গেল না। কবে ইসি তার রায় জানাবে, কেউ জানেও না। নিরপেক্ষতা ও পক্ষপাতের অভিযোগের জন্য ইসিই যে দায়ী, তাদের আচরণই তা বুঝিয়ে দিচ্ছে।

ভোট পর্ব শুরুর সময়েই ইভিএম নিয়ে বিরোধীদের মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিশেষ গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু বিতর্কের অবসান সেখানেই ঘটেনি। কমিশন ও তার কাজের ওপর ‘আস্থা’ রাখলেও নতুন এক মামলা সর্বোচ্চ আদালত গ্রহণ করেছেন। এই প্রথম দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত পড়া ভোটের হার পরে প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছ। প্রথম দফার ভোট গ্রহণের ১১ দিন পর ইসি সেই দফার চূড়ান্ত ভোটের হার ঘোষণা করে। দেখা যায়, কোথাও কোথাও সেই হার ৮ থেকে ১০ শতাংশ বেড়েছে। মোট কতজন ভোট দিলেন, সেই হিসাব ইসি আজও দেয়নি। ফলে ইভিএমে কারচুপি নিয়ে বিরোধী মহলের সন্দেহ ও শঙ্কা বেড়ে চলেছে। অতীতে প্রতি পর্বের ভোটের পর ইসি সংবাদ সম্মেলন করত। সব প্রশ্নের উত্তর দিত। এবার এক দিনও সংবাদ সম্মেলন করেনি। সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়েছে। ২৪ মে ইসিকে জবাবদিহি করতে হবে।

তা করলেও তাতে কতটা কাজ হবে, কেউ জানে না। কারণ, সাত দফা ভোটের ষষ্ঠ দফা ২৫ মে। শেষ দফা ১ জুন। ফল ঘোষণা ৪ জুন। ইসি তার কাজকর্মে লাগাম টানবে—এমন কোনো ইঙ্গিত আজ পর্যন্ত দেয়নি। সুপ্রিম কোর্টের রায় যা–ই হোক, তত দিনে ভোট পর্ব হয়তো শেষও হয়ে যাবে।

পাঁচ দফা ভোট কেটে গেলেও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা ও দৃঢ়তার পরিচয় দিতে পারেনি। তাদের কাছে ন্যায্য কিছু আশা করা অহেতুক কি না, সে প্রশ্ন ভারতের গণতন্ত্রপ্রিয় মহলে আজ বিশেষভাবে আলোচিত।