ওয়াক্‌ফ সংশোধনী বিল নিয়ে কেন বিরোধিতা করছে বিজেপির শরিকেরাও

ভারতে ওয়াক্‌ফ সংশোধনী বিল নিয়ে যুগ্ম সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) প্রথম বৈঠকে বিজেপি সরকারের শরিকেরাই নানা রকম প্রশ্ন তুলল। গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিজেপি সরকারের শরিক তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি), লোক জনশক্তি পার্টি (এলজেপি) এবং জনতা দল–ইউনাইটেড (জেডিইউ) সদস্যরা বলেন, তাড়াহুড়া না করে সবার সঙ্গে কথা বলে বিলের আপত্তিকর বিষয়গুলোর সুরাহা করা হোক।

বৈঠকে শরিক দলের সদস্যরা ছাড়াও বিরোধীরা সমবেতভাবে বিলের বিরোধিতা করেন। বিরোধীদের আপত্তির মধ্যে রয়েছে প্রস্তাবিত ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিম সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা, বিতর্কিত সম্পত্তির মীমাংসার ভার জেলা প্রশাসকদের দেওয়া এবং প্রস্তাবিত নতুন আইনে উর্দু শব্দগুলো তুলে দেওয়া। বিরোধী নেতাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে টিডিপি, এলজেপি ও জেডিইউ সদস্যরাও বলেন, এই সংশোধনী বিল মুসলমান সম্প্রদায়কে নানা কারণে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তাঁদের উদ্বেগের নিরসন করা দরকার। সে জন্য মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে।

তেলেঙ্গানার সাবেক শাসক দল ওয়াইএসআর কংগ্রেস বিরোধীদের ‘ইন্ডিয়া’ জোটে নেই, আবার তারা সরকারের শরিকও নয়। এই দলের সদস্য বিজয়সাই রেড্ডি ‘এক্স’ মারফত জানিয়েছেন, জেপিসির বৈঠকে তিনিও এই বিলের বিরোধিতা করেছেন। জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, তাঁরা যেন এই বিলের বিষয়ে তাঁদের আপত্তিগুলো তাঁকে জানান, যাতে তিনি পরবর্তী বৈঠকে সেগুলো উপস্থাপন করতে পারেন।

কংগ্রেসের গৌরব গগৈ ‘এক্স’ হ্যান্ডলে বলেন, ‘আশা করি জেপিসি সবার মতামতকে গুরুত্ব দেবে, যাতে সাংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষা পায় ও ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব না হয়।’

জেপিসির চেয়ারম্যান বিজেপির লোকসভা সদস্য জগদম্বিকা পাল। তিনি জানিয়েছেন, কমিটির পরবর্তী বৈঠক বসবে ৩০ আগস্ট। তাঁর আশা, সবার সম্মতিক্রমে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে নতুন সংশোধনী বিলটি পেশ করা যাবে।

ওয়াক্‌ফ বোর্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কিছু সংশোধন এনে এই বিল পেশ করেছে। বিরোধীরা এই বিলের বিরোধিতা করছে। তাদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সরকার এই বিলের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চাইছে।

অন্যদিকে সরকার বলছে, ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘পাহাড়সম’ দুর্নীতি রোখা এই বিলের উদ্দেশ্য। তা ছাড়া এই বিল মুসলমান সম্প্রদায়ের নারীদের কল্যাণ করবে। খসড়া বিলে ওয়াক্‌ফ বোর্ডে মুসলিম নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আল্লাহর নামে সমর্পিত স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তির দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করে ওয়াক্‌ফ বোর্ড। তাদের কাছে সারা ভারতে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ একর জমি ও সাড়ে ৮ লাখের বেশি সম্পত্তি, যার বাজারমূল্য প্রায় সোয়া দুই লাখ কোটি রুপি। এই সম্পত্তি সেবার কাজে ব্যবহার করা যায়, কিন্তু হস্তান্তর করা যায় না। সম্পত্তিসংক্রান্ত সব ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের। এই বোর্ডের বিরুদ্ধে নানা সময়ে জমি দখল ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। সৃষ্টি হয়েছে বহু বিতর্কও।

কেন্দ্রীয় সরকার সংস্কারের নামে যে নতুন সংশোধনী বিল এনেছে, মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকের মতে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ওয়াক্‌ফ বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করা। ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে রয়েছে ওয়াক্‌ফ বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ওয়াক্‌ফ কাউন্সিল।

রাজ্যস্তরেও আছে ওয়াক্‌ফ বোর্ড। এসব বোর্ডের বিরুদ্ধে নানা সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। আদালতে দায়ের হয়েছে শতাধিক মামলা। এই পরিস্থিতিতে সরকার প্রচলিত বিলে সংশোধনী এনেছে, যাতে অপব্যবহার বন্ধ হয়।

সংশোধনীগুলোর মধ্যে একটি বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে ওয়াক্‌ফ জমি জরিপের দায়িত্ব জেলা প্রশাসককে দেওয়া। বর্তমানে এই দায়িত্ব রয়েছে বোর্ডের হাতে। বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি অন্তত পাঁচ বছর ইসলাম অনুশীলন করছেন, তিনি তাঁর জমি আল্লাহর নামে ওয়াক্‌ফকে দান করতে পারবেন। কোন সম্পত্তি ওয়াক্‌ফের আওতায় পড়বে, তা নির্ধারণের অধিকারী ছিল ওয়াক্‌ফ বোর্ড। সেই অধিকার সংশোধনীর মাধ্যমে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।

কেন্দ্রীয় ওয়াক্‌ফ কাউন্সিল ও রাজ্যস্তরে ওয়াক্‌ফ বোর্ডে দুজন অমুসলিম প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ওয়াক্‌ফ ট্রাইব্যুনাল তিন সদস্যের জায়গায় দুই সদস্যের করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যাবে।

এই বিলের বিরোধীরা মনে করছেন, মুসলমান সমাজের উন্নতি ও ওয়াক্‌ফ বোর্ডের স্বচ্ছতার কথা বলে যে সংশোধনী কেন্দ্রীয় সরকার আনতে চায়, তার আসল উদ্দেশ্য সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ। তাঁরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে সরকার মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘন করছে। কাজেই এই বিল সংবিধানবিরোধী।

সমাজবাদী পার্টি স্পষ্ট জানতে চেয়েছে, অন্য ধর্মের নিয়ন্ত্রক বোর্ডে যখন ভিন্নধর্মাবলম্বীদের স্থান হয় না, তখন কেন মুসলমানদের ওয়াক্‌ফ বোর্ডে অমুসলিমরা থাকবেন? এআইএমআইএম নেতা ও সাংসদ আসাউদ্দিন ওয়েইসি মনে করেন, এই বিল এনে বিজেপি চাইছে মুসলমানদের জমি করায়ত্ত করতে। বিভিন্ন মসজিদ ও দরগাহ দখল করতে।

সংসদে এই সংশোধনী বিল পেশ করেছিলেন সংসদীয় ও সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। ওয়াক্‌ফ বোর্ডের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জমি দখলের একাধিক অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছিলেন, তামিলনাড়ুর এক ব্যক্তি গ্রামে তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, গোটা গ্রামই নাকি ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি! তিনি বলেন, গুজরাটে সুরাট পৌরসভার সদর দপ্তরও ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছে!