কর্ণাটকে ১৩৬ আসনে জিততে যাচ্ছে কংগ্রেস, পর্যুদস্ত বিজেপি

তিনজনই কর্ণাটক রাজ্যের। (বাঁ থেকে) সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ও ডি কে শিবকুমার। বিজয়ের পর খাড়গেকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন অন্য দুই নেতা
ছবি: এএনআই

ভারতের কর্ণাটকে আক্ষরিক অর্থে লড়াইটা দাঁড়িয়েছিল নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কংগ্রেসের। সেই লড়াইয়ে জয়ী হয়ে দক্ষিণ ভারতকে বিজেপিমুক্ত করে দিল কংগ্রেস। বিজেপিকে পর্যুদস্ত করে একাই সরকার গড়তে যাচ্ছে তারা।

২২৪ আসনের বিধানসভায় ইতিমধ্যে কংগ্রেস জিতেছে ১৩২ আসনে, এগিয়ে ৪ আসনে। অন্যদিকে বিজেপি জিতেছে ৬৩ আসনে, এগিয়ে আছে ২টিতে। জেডিএস জয়ী হয়েছে ১৯টি আসন। স্বতন্ত্র ও স্থানীয় দলের ৪ জন প্রার্থী জিতেছেন।

নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, আগেরবারের তুলনায় কংগ্রেস এবার ৫ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের হার ৪৩ শতাংশ। তুলনায় বিজেপি ৩৬ ও জেডিএস সাড়ে ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েছে।

আগামীকাল রোববার কংগ্রেসের জয়ী বিধায়কদের বৈঠক ডাকা হয়েছে রাজধানী বেঙ্গালুরুতে। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গেসহ কেন্দ্রীয় নেতা, পর্যবেক্ষকেরা নবনির্বাচিত বিধায়কদের সঙ্গে কথা বলে পরিষদীয় নেতা কে হবেন, তা ঠিক করবেন।

কর্ণাটক জিততে গান্ধী পরিবার যে তৎপরতা দেখিয়েছে, সাম্প্রতিক কালে তা দেখা যায়নি। রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা দিনের পর দিন প্রচার ও রোড শো করেছেন। অসুস্থতা সত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধী জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কখনো রাজ্য নেতৃত্বকে পেছনে রাখেনি, বরং রাজ্য নেতৃত্বকে সামনে রেখেছে প্রচারের কান্ডারি হিসেবে। কর্ণাটকের প্রতি কংগ্রেস বাড়তি নজর দিয়েছিল ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র সময় থেকেই। রাহুল টানা ১৯ দিন ওই রাজ্যে হেঁটেছেন। আজ শনিবার জয় নিশ্চিত হওয়ার পর কর্ণাটকবাসী ও দলীয় কর্মী-সমর্থকদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘৃণার বাজার বন্ধ হয়ে গেল। ভালোবাসার দোকান খুলে গেছে।’

সারা দিন নির্বাক থাকার পর সন্ধ্যায় টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্ণাটক জয়ের জন্য কংগ্রেসকে অভিনন্দন জানান। একই সঙ্গে বিজেপির কর্মী-সমর্থকদেরও কঠোর পরিশ্রমের জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান।  

ফল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন, সেই জল্পনা। দৌড়ে রয়েছেন দুজন। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এবং অনগ্রসর কুড়ুবা সম্প্রদায়ের অবিসংবাদিত জননেতা সিদ্দারামাইয়া ও প্রদেশ সভাপতি ডি কে শিবকুমার। সিদ্দারামাইয়া ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর সরকারের বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প রাজ্যের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। দরিদ্রদের সস্তায় খাবার দিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ইন্দিরা ক্যানটিন’। ৫ টাকায় নাশতা ও ১০ টাকায় মধ্যাহ্ন ও নৈশভোজের বন্দোবস্ত করেছিলেন। রাজ্যে অনগ্রসর, তফসিল জাতি-উপজাতি, দলিত ও মুসলমানদের সামাজিক জোট (স্থানীয় ভাষায় ‘আহিন্দা’) গড়ে তুলেছিলেন তিনি। প্রধানত সেই জোটে ভর দিয়েই কংগ্রেস এবার বিজেপির চূড়ান্ত রকমের ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা বানচাল করেছে।

কর্ণাটক বিধানসভায় বিজয়ের পর মিষ্টিমুখ করছেন কংগ্রেস নেতারা। আজ নাগপুরে দলীয় কার্যালয়ের সামনে
ছবি: এএনআই

মুখ্যমন্ত্রিত্বের অন্য দাবিদার শিবকুমারের বয়স ৬০। সম্পদশালী এই নেতা দলের যাবতীয় সংকট একাই সামলেছেন। শিবকুমার গান্ধী পরিবারেরও খুবই কাছের। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। ইডি, সিবিআই তাঁকে জেরা ও গ্রেপ্তারও করেছিল। একসময় জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও। জয়ের পর সে কথা স্মরণ করতে গিয়ে আজ শনিবার তিনি কেঁদেও ফেলেন। বলেন, সোনিয়াকে তিনি কথা দিয়েছিলেন, কর্ণাটক–জয় উপহার দেবেন। সেই কথা তিনি রেখেছেন।

সিদ্দারামাইয়া ও শিবকুমারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সামাল দিতে খাড়গেকে মুখ্যমন্ত্রী করার জল্পনাও রয়েছে। তাতে আপত্তি নেই শিবকুমারের। সে কথা তিনি নিজেই জানিয়েছেন। তবে সদ্য নির্বাচিত দলীয় সভাপতিকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হবে কি না, সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

এবারের ভোটে স্পষ্ট, জাতপাত ও ধর্মের বেড়া ভেঙে কংগ্রেস সব মহলের সমর্থন পেয়েছে। লিঙ্গায়েত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিজেপির যে দখল ছিল, তা যেমন ভেঙে দিয়েছে, তেমনই জয় করেছে দক্ষিণ মহিশুরের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের সমর্থন। ওই অঞ্চলে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল জেডিএসের। দক্ষিণ মহিশুরের ৬৪ আসনের মধ্যে কংগ্রেস জিতেছে ৪৪টি।

লিঙ্গায়েত মন জয় করলেও ওই সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জগদীশ শেট্টার বিজেপি টিকিট না পেয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে প্রার্থী হলেও এবার জিততে পারেননি। অথচ সোনিয়া গান্ধী তাঁরই সমর্থনে একমাত্র জনসভাটি করেছিলেন।

সবচেয়ে বড় কথা, এবারের ভোটে একেবারেই কাজে আসেনি ‘মোদি ম্যাজিক’। বিজেপির প্রচারের মূল দায়িত্ব মোদিই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। গত তিন মাসে মোট ২১ বার রাজ্য সফর করেছেন। প্রচারের শেষ সপ্তাহে ২০টি জনসভা ও রোড শো করেছেন। জনসভায় প্রার্থীদের উপস্থিতিতে অমিত শাহ মোদিকে ভোট দিতে বলেছেন, যাতে কর্ণাটক তাঁর আশীর্বাদ পায়। এমন মোদিময় প্রচার কোনো রাজ্য বিধানসভার ভোটে আগে হয়নি। সেই কারণে এই ভোট মোদির পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের বিভিন্ন নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী এই পরাজয়কে মোদির হার বলে মন্তব্য করেছেন। যদিও বিজেপির কোনো শীর্ষ নেতা এই বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।

বিজেপির প্রচারে কোনো স্থিরতা ছিল না। রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে কথা বললেও শুরু থেকেই তারা চেষ্টা করেছে ধর্মীয় মেরুকরণের মধ্য দিয়ে হিন্দুমন জিততে। উত্তর ভারতের এই চেনা ছক কর্ণাটক বানচাল করে দিয়েছে। হিজাব-হালাল-আজান-আমিষ–বিতর্ক পাশে সরিয়ে স্থানীয় সমস্যার সুরাহায় কংগ্রেসকে বেছে নিয়েছে রাজ্যের মানুষ। শেষ বেলায় প্রধানমন্ত্রীও জেতার জন্য ভাষণ শেষ করেছেন ‘জয় বজরঙ্গবলি’ স্লোগান দিয়ে। তুলনায় কংগ্রেসের প্রচারে ছিল বেকারত্ব দূর করা, মূল্যবৃদ্ধি কমানো, দুর্নীতিরোধ, দরিদ্র মানুষের জন্য কল্যাণমুখী প্রকল্প গ্রহণের প্রতিশ্রুতি। স্পষ্টতই কংগ্রেসের এই ‘হাইপার লোকাল’ প্রচারের মুখে ম্লান হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন ও ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের দাবি।

কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মোকাবিলাও বিজেপি করতে পারেনি। পাঁচটি বিশেষ প্রতিশ্রুতির মোকাবিলা বিজেপি করে উঠতে পারেনি। যেমন দরিদ্র পরিবারের নারী গৃহকর্ত্রীদের মাসিক ২ হাজার রুপি অনুদান, মাসে ২০০ ইউনিট ফ্রি বিদ্যুৎ, বেকার স্নাতকদের মাসে ৩ হাজার রুপি ও ডিপ্লোমাধারীদের দেড় হাজার, দরিদ্রদের মাথাপিছু মাসে ১০ কেজি করে পছন্দের দানাশস্য ও নারীদের বিনা ভাড়ায় সরকারি বাসে ভ্রমণ। মল্লিকার্জুন খাড়গের ষষ্ঠ প্রতিশ্রুতি এই পাঁচ অঙ্গীকার মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই বাস্তবায়ন করা হবে। এ জন্য রাজ্য সরকারের বার্ষিক খরচ হবে ৩০ হাজার কোটি রুপি।

লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বি এস ইয়েদুরাপ্পাকে ক্ষমতাহীন করা, বাসবরাজ বোম্মাই সরকারের পাহাড়সম দুর্নীতি রোধ করতে না পারা, স্থানীয় নেতাদের বদলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে প্রাধান্য দেওয়া, বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির মতো জ্বলন্ত সমস্যার সমাধানের পথে না গিয়ে ‘জবলেস গ্রোথ’-এর বড়াই এবং অহেতুক ধর্মীয় জিগির তুলে জনজীবনে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা রাজ্যবাসী দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কর্ণাটক ভোটের শিক্ষা এটাই। এই ফল অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরাট পরাজয়। একই রকম প্রমাণিত, উত্তর ভারতের ফর্মুলা দক্ষিণ ভারতে অচল।

কংগ্রেসের কর্ণাটক জয় আগামী দিনে সর্বভারতীয় স্তরে বিজেপিবিরোধী জোট গঠনের ক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হয়, তা পরবর্তী দ্রষ্টব্য। একই রকম দেখার, এই জয়ের পর কংগ্রেস ওই জোটের নেতৃত্বের দাবিদার হয় কি না।