নারীর নিকাব টেনে খুললেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ, ভারত ছাড়িয়ে ক্ষোভ পাকিস্তানেও
ভারতের বিহার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতে একজন মুসলিম নারীর নিকাব টেনে নামানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা শুরু হয়েছে। ক্ষোভ দেখা দিয়েছে পাকিস্তানেও।
গত সোমবার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যটির রাজধানী পাটনায় সরকারি এক অনুষ্ঠানে চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগপত্র নিতে এসেছিলেন ওই নারী। হাতে নিয়োগপত্র তুলে দেওয়ার এক পর্যায়ে তাঁর নিকাব টেনে খুলে ফেলেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ভাইরাল হওয়া ওই ভিডিওতে দেখা যায়, হাতে একটি নথি নিয়ে কয়েকজন কর্মকর্তার পাশে দাঁড়িয়ে নীতীশ কুমার ওই চিকিৎসকের পোশাকের দিকে ইশারা করেন এবং তাঁকে সেটি খুলতে বলেন।
৭৪ বছর বয়সী নীতীশ দুই দশকের বেশির ভাগ সময় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির ঘনিষ্ঠ মিত্র। গত মাসে তাঁদের জোট বিহার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়। নির্বাচনে রাজ্যটিতে প্রথমবারের মতো বিজেপি এককভাবে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে উঠে আসে।
এ সময় ওই নারী প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই নীতীশ কুমার হাত বাড়িয়ে তাঁর নিকাব টেনে নামান। এতে তাঁর মুখ প্রকাশ হয়ে পড়ে। পাশে দাঁড়ানো এক মন্ত্রী তাঁকে (মুখ্যমন্ত্রীকে) থামানোর সামান্য চেষ্টা করলেও মঞ্চে উপস্থিত অন্যরা হাসতে থাকেন।
একজন নারীর মর্যাদা ও শালীনতা খেলার বিষয় নয়। ক্ষমতা মানে সীমা লঙ্ঘনের অনুমতি নয়।
৭৪ বছর বয়সী নীতীশ দুই দশকের বেশির ভাগ সময় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ঘনিষ্ঠ মিত্র। গত মাসে তাঁদের জোট বিহার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়। নির্বাচনে রাজ্যটিতে প্রথমবারের মতো বিজেপি এককভাবে সবচেয়ে বড় দল হিসেবে উঠে আসে।
ভিডিওটি প্রথম এক্সে পোস্ট করে রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি)। দলটি মোদি–নীতীশ জোটের বিরোধী।
পোস্টে আরজেডি লিখেছে, ‘নীতীশজির কী হয়েছে? (হিন্দিতে “জি” সম্মানসূচক শব্দ)। তাঁর মানসিক অবস্থার কি পুরোপুরি অবনতি হয়েছে, নাকি নীতীশ “বাবু” (আরেকটি হিন্দি সম্মানসূচক শব্দ) এখন শতভাগ “সংঘী” হয়ে গেছেন?’
‘নীতীশজির কী হয়েছে? (হিন্দিতে “জি” সম্মানসূচক শব্দ)। তাঁর মানসিক অবস্থার কি পুরোপুরি অবনতি হয়েছে, নাকি নীতীশ “বাবু” (আরেকটি হিন্দি সম্মানসূচক শব্দ) এখন শতভাগ “সংঘী” হয়ে গেছেন?’
সংঘী বলতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। প্রায় ১০০ বছর পুরোনো এ কট্টর দক্ষিণপন্থী সংগঠনের লক্ষ্য হলো সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। মোদি ও বিজেপির বেশির ভাগ নেতা আজীবন আরএসএসের সদস্য। আরএসএসকে ‘সংঘ পরিবার’-এর আদর্শিক উৎস হিসেবে দেখা হয়। এ সংঘ পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় শত শত হিন্দু সংগঠন কাজ করে।
বিজেপি ও তাদের মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম নারীদের হিজাব ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে। ২০২২ সালে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে তৎকালীন বিজেপি সরকার শ্রেণিকক্ষে হিজাব নিষিদ্ধ করে। এতে মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। পরে ওই বছর সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ এ বিষয়ে বিভক্ত রায় দেন। ফলে প্রায় ২০ কোটি মুসলিমের দেশে হিজাব নিয়ে বিতর্ক ও রাজনীতি চলতেই থাকে। কয়েকটি হিন্দু সংগঠন সারা দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করার দাবিও জানিয়েছে।
বিজেপি ও তাদের মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম নারীদের হিজাব ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে। ২০২২ সালে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যে তৎকালীন বিজেপি সরকার শ্রেণিকক্ষে হিজাব নিষিদ্ধ করে। এতে মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। পরে ওই বছর সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ এ বিষয়ে বিভক্ত রায় দেন। ফলে প্রায় ২০ কোটি মুসলিমের দেশে হিজাব নিয়ে বিতর্ক ও রাজনীতি চলতেই থাকে।
বিহারের ১২ কোটি ৭০ লাখ মানুষের প্রায় ১৮ শতাংশ মুসলিম। বিরোধী দল ও মুসলিম সংগঠনগুলো নীতীশ কুমারের এ আচরণের নিন্দা জানিয়ে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে।
প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস এক্সে লিখেছে, ‘এটি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। এক নারী চিকিৎসক তাঁর নিয়োগপত্র নিতে এসেছিলেন, আর নীতীশ কুমার তাঁর নিকাব টেনে খুলে দিলেন। বিহারের সর্বোচ্চ পদে থাকা একজন ব্যক্তি প্রকাশ্যে এমন নীচ আচরণ করছেন। ভাবুন তো, রাজ্যে নারীরা কতটা নিরাপদ থাকবেন? এ ঘৃণ্য আচরণের জন্য নীতীশ কুমারের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত।’
গত বুধবার মুম্বাইয়ে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম)’ সদস্যরা বিক্ষোভ করেন। তাঁরা নীতীশ কুমারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার দাবি জানান।
বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ যখন একজন বিক্ষোভকারী নারীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘এক মুসলিম নারীকে অপমান করা হয়েছে।’ সেখানে হিজাব পরা আরেকজন বলেন, ‘নীতীশ কুমারের পদত্যাগ করা উচিত।’
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের সাবেক অভিনেত্রী জায়রা ওয়াসিম নীতীশ কুমারের কাছে ‘নিঃশর্ত ক্ষমা’ দাবি করেন। তিনি এক্সে লেখেন, ‘একজন নারীর মর্যাদা ও শালীনতা খেলার বিষয় নয়। ক্ষমতা মানে সীমা লঙ্ঘনের অনুমতি নয়।’
প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি ঘটনাটিকে ‘লজ্জার’ ও ‘চরমভাবে উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেন।
বুধবার এক্সে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার লেখেন, ‘এ ধরনের ঘটনা সংখ্যালঘুদের অধিকার সুরক্ষার জরুরি প্রয়োজন ও ইসলামবিদ্বেষের উদ্বেগজনক উত্থানকে সামনে আনে। নারী ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রতিটি সমাজে মৌলিক ও আপসহীন নীতি হিসেবেই থাকতে হবে।’
এ বিষয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি নীতীশ কুমার। তবে বৃহস্পতিবার তাঁর দল জনতা দল–ইউনাইটেড (জেডিইউ) এক্সে লিখেছে, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর একাধিক মেয়াদে সব সময় ‘সংখ্যালঘুদের পক্ষে’ ছিলেন। পোস্টে আরও লেখা হয়, ‘নীতীশ সরকারের আমলে সংখ্যালঘুরা নিরাপদ ও সুরক্ষিত।’ তবে সোমবারের ঘটনার কোনো উল্লেখ সেখানে ছিল না।
আল–জাজিরাকে ই–মেইলে পাঠানো এক বিবৃতিতে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারত শাখার প্রধান আকর প্যাটেল বলেন, নীতীশ কুমারের কাজটি ছিল ওই নারীর মর্যাদা, স্বাধিকার ও পরিচয়ের ওপর আঘাত। তিনি বলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তা যখন জোর করে কোনো নারীর নিকাব টেনে নামান, তখন সেটি সাধারণ মানুষের কাছে এ বার্তা দেয় যে এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য। কোনো নারীর বিশ্বাস বা পোশাক নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার কারও নেই।