উত্তর প্রদেশের চারবারের মুখ্যমন্ত্রী কেন নেই ভোটের মাঠে

উত্তর প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীফাইল ছবি: এএনআই

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে ভোট হচ্ছে, অথচ আকাশ ছাড়া আর কোথাও নেই নীলের সমারোহ। শহর ছাড়িয়ে গ্রামগঞ্জে নীল রঙের যে পতাকা পতপত উড়ত, তাতে দৃশ্যমান নিশ্চল হাতি—কোনো এক জাদুর ছোঁয়ায় তা এবার উধাও। নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপনে সহজেই ছাপা হতে পারে মায়াবতীর মুখ। কে বলবে এই দলিত রানি উত্তর প্রদেশে চারবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন?

এবারের নির্বাচনে আশ্চর্যজনকভাবে অদৃশ্য বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) নেত্রী মায়াবতী। একবারের জন্যও দলের কোনো নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিতে দেখা যায়নি তাঁকে। দেখা গেল না বিতর্কিত কোনো রাজনৈতিক বিবৃতি দিতে। কারও সমর্থন বা বিরোধিতায় দিলেন না একটি বিবৃতিও। সেই আশির দশক থেকে যে রাজ্যের প্রতিটি নির্বাচনের চরিত্র ছিল চতুর্মুখী, আজ তা দ্বিমুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনী চালচিত্র থেকে বিলকুল হারিয়ে গেছে বিএসপি ও তার ডাকাবুকো নেত্রী মায়াবতী।

ক্ষমতার সঙ্গে বিতর্কও হয়ে ওঠে মায়াবতীর সঙ্গী। তৃতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় তাজমহলসংলগ্ন অঞ্চলের উন্নতিতে বিপুল অর্থ অপচয়ের অভিযোগ ওঠে। সিবিআই তাঁর বাড়িতেও তল্লাশি চালিয়েছিল। ‘তাজ করিডর’ বলে পরিচিত সেই মামলা এখনো চলছে।

১৫ জানুয়ারি নিজের জন্মদিনে মায়াবতী প্রথম জানিয়েছিলেন, এবারের লোকসভা নির্বাচনে উত্তর প্রদেশে তাঁর দল একাই লড়বে। কোনো জোটে শামিল হবে না। গত মার্চের গোড়ায় সেই একই কথা তিনি জানিয়ে দেন ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে। বলেন, গণমাধ্যম গুজব ছড়াচ্ছে  বিএসপি নাকি ‘ইন্ডিয়া’ জোটে যোগ দেবে। অথবা তৃতীয় কোনো মোর্চা গঠন করবে। এসব পরিকল্পিত গুজব। বিএসপি একাই লড়বে।

একা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বলার কিছু নেই। বলার এটাই, বিএসপি লড়ার কোনো চিহ্নই উত্তর প্রদেশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে উসকে উঠেছে রাজনৈতিক জল্পনা। সমাজবাদী পার্টি (এসপি) সরাসরিই মায়াবতীর দলের কপালে সেঁটে দিয়েছে বিজেপির ‘বি টিম’–এর তকমা। কয়েক মাস আগেও যা ছিল গুঞ্জন, এখন তা প্রকাশ্যে উচ্চারিত, জেলযাত্রার হাত থেকে রেহাই পেতেই মায়াবতী নিরুত্তেজ।

নিজেকে গুটিয়ে নিলেও এই অবসরে মায়াবতী দলের উত্তরাধিকার ঠিক করে ফেলেছেন। ঘোষণা করেছেন, দলের সর্বময় কর্তা হবেন তাঁর ভাইপো আকাশ আনন্দ। তবে সেই সঙ্গে একথাও জানাতে ভোলেননি, রাজনীতি থেকে অবসর নিচ্ছেন না। যেমন সক্রিয় তিনি ছিলেন, দলিত সমাজের উন্নয়ন ও ন্যায়ের জন্য তেমনই থাকবেন।

সেই সক্রিয়তার রূপ এমন রঙহীন, ম্যাড়মেড়ে, মলিন ও নিষ্প্রভ কেন? কয়েক মাস আগেও এই প্রশ্ন রাজনৈতিক স্তরে ঘোরাফেরা করত। এখন করে না। কারণ, এটাই স্থির বিশ্বাস, ভারতীয় রাজনীতির ‘বহেনজি’ ভারতের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক দল বিজেপির চক্ষুশূল হতে রাজি নন। আর্থিক দুর্নীতির অর্ধশতাধিক অভিযোগ, তদন্ত ও মামলা তাঁর ঘাড়ের ওপর অগুন্তি খাঁড়া হয়ে ঝুলে রয়েছে। জেলযাত্রা থেকে বাঁচতে হলে তাঁকে এমনই নিষ্প্রভ থাকতে হবে। নির্বাচনের প্রাক্কালে অথবা নির্বাচন চলাকালে এমন মিয়োনো মুড়ির হাল তাঁর চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে হয়নি।

দলিত ও শোষিত সমাজকে জোটবদ্ধ করে আশির দশকে বহুজন সমাজ পার্টির জন্ম দিয়েছিলেন কাঁসিরাম। মায়াবতীর মধ্যে তিনি আগুনের ঝলক দেখেছিলেন। শুরু থেকেই তাঁকে গড়ে তুলেছিলেন নেত্রী হিসেবে। এক দশকের মধ্যেই এসেছিল সাফল্য। ১৯৯৫ সালে মায়াবতী হন উত্তর প্রদেশের প্রথম দলিত মুখ্যমন্ত্রী। দলিতদের মধ্যে জাটভ সম্প্রদায়ই প্রধান। তার পাশাপাশি কাঁসিরাম ও তিনি সংঘবদ্ধ করে তোলেন অন্যান্য দলিত সমাজকে। সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে কাছে টানেন দরিদ্র মুসলমানদের। ফলে শিগগিরই রাজ্য রাজনীতিতে বিএসপি হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য এক শক্তি।

১৯৯৫ ও ১৯৯৭ সালে দুবার মুখ্যমন্ত্রী হলেও বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে মায়াবতী পারেননি। ক্রমেই উপলব্ধি করেন, শুধু দলিত সমর্থন নিরঙ্কুশ প্রাধান্য এনে দিতে পারবে না। বিজেপির রাম মন্দির আন্দোলন এই সময় হিন্দুত্ববাদী আলোড়ন শুরু করেছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে কংগ্রেসও হারাতে থাকে তার প্রাসঙ্গিকতা।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদির অভিযান এখনো পর্যন্ত বিরোধীদের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ। আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়া, সত্যেন্দ্র জৈন কারগারে। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনও। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় জামিনে মুক্ত রয়েছেন সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী।

মায়াবতীও নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে বদল করেন রাজনীতিক কৌশল। ক্রমেই ‘বহুজন’ থেকে দলের উত্তরণ ঘটিয়ে করা হয় ‘সর্বজন’। সতীশ চন্দ্র মিশ্রের মতো ব্রাহ্মণ রাজনীতিককে নীতিনির্ধারক হিসেবে যোগ্য মর্যাদা দেন দলের দলিত চরিত্রের বদল ঘটাতে। ১৯৯৭ সালে ছয় মাসের জন্য দ্বিতীয় দফার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এই প্রতিবেদককে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয়দের বাদ দিয়ে বহুজন নয়। সবাইকে নিয়ে বহুজনই সর্বজন। আমি শুধু এটা প্রমাণ করতে চাই, দলিতেরাও নেতৃত্ব দিতে পারে। সেই অধিকার তাদেরও সমান।’

সর্বজনের রাজনীতি মায়াবতীকে নতুন সাফল্য এনে দেয়। তৃতীয় দফায় বছর দেড়েকের জন্য মুখ্যমন্ত্রী হন ২০০২ সালে। পরের ভোটেই একার ক্ষমতায় দখল করেন লক্ষ্ণৌয়ের কুর্সি। চতুর্থ দফায় ২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর তিনি পালন করেন মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব।

ক্ষমতার সঙ্গে বিতর্কও হয়ে ওঠে মায়াবতীর সঙ্গী। তৃতীয় দফায় মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় তাজমহলসংলগ্ন অঞ্চলের উন্নতিতে বিপুল অর্থ অপচয়ের অভিযোগ ওঠে। সিবিআই তাঁর বাড়িতেও তল্লাশি চালিয়েছিল। ‘তাজ করিডর’ বলে পরিচিত সেই মামলা এখনো চলছে। চতুর্থবার মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে আয়ে অসংগতি ও বেআইনি সম্পদ বৃদ্ধির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়। রাজ্যজুড়ে বহুজন স্মৃতিসৌধ ও পার্ক তৈরি নিয়েও দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

এসব অভিযোগ এত দিন নিজের মতো করে সামাল দিলেও ২০১২ সালে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর মায়াবতী অসহায় বোধ করতে থাকেন। ২০১৪ সালে প্রথমে কেন্দ্রে, তার পর ২০১৭ সালে রাজ্যে বিজেপির দ্রুত উত্থান এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্ঘোষ ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে মায়াবতীকে নির্বিষ করে তোলে। আজ যে অবস্থায় তিনি এসেছেন, তা তাঁর অতীতের ছায়ামাত্র।

২০১২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে ২২৪ আসন জিতে এসপি ক্ষমতায় এলেও বিএসপি ভোট পেয়েছিল ২৬ শতাংশ। দুই বছর পর ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে উত্তর প্রদেশে বিএসপি একটিও আসন পায়নি। অথচ প্রায় ২০ শতাংশ ভোট টেনেছিল। তিন বছর পর ২০১৭ সালে এসপিকে সরিয়ে বিজেপির ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় বিএসপি পেয়েছিল মাত্র ১৯টি আসন। কিন্তু ভোট টেনেছিল প্রায় সাড়ে ২২ শতাংশ। এসপির চেয়েও যা দেড় শতাংশ বেশি।

ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকে থাকার তাগিদে ২০১৯ সালে মায়াবতী জোটবদ্ধ হন অখিলেশের এসপি ও জয়ন্ত চৌধুরীর আরএলডির সঙ্গে। তাতে তাঁর লাভ হয়েছিল। ১০টি আসনে জিতেছিল বিএসপি। ভোট পেয়েছিল সাড়ে ১৯ শতাংশ। কিন্তু ২০২২ সালের বিধানসভা ভোটে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তিনি একা লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।

সেই লড়াই বুঝিয়ে দেয় মায়াবতী তাঁর অতীতের ছায়া মাত্র। অস্তাচলগামী সূর্য। তাঁর দল একটি মাত্র আসন জিতেছিল। ১৯৮৯ সালের পর যত নির্বাচন হয়েছে, কোনোবার এত কম ভোট তিনি পাননি। ২০২২ সালে বিএসপির ভাগ্যে জোটে ১৩ শতাংশেরও কম ভোট। অথচ ১৯৮৯ সালে দলের হাঁটি হাঁটি পা পা এগোনোর দিনেও পেয়েছিলেন পৌনে ১০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন।

ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজাফফরনগরের কুতবা কুতবি গ্রামের একটি কেন্দ্রে ভোট দিতে সারিতে ভোটারেরা। ১৯ এপ্রিল
ছবি: রয়টার্স

বিজেপির সর্বগ্রাসী রাজনীতির মোকাবিলায় ক্রমে ব্যর্থ মায়াবতী নিজেই তাঁর এই অধঃপতনের প্রধান কারণ। মুখে সর্বজনের কথা বললেও দলকে তিনি সর্বজনীন করে তুলতে পারেননি। পারেননি দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে। টাকা নিয়ে অযোগ্য প্রার্থী পছন্দের অভিযোগ থেকেও নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। সবচেয়ে বড় কথা, দলিত সমাজের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সর্বোপরি তিনি ব্যর্থ হয়েছেন দুর্নীতির অভিযোগগুলো অসাড় প্রতিপন্ন করতে। ফলে নিজেকে গুটিয়ে ফেলা ছাড়া তাঁর কাছে দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। ২০২২ সালের বিধানসভা ভোট থেকেই তার সূত্রপাত।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদির অভিযান এখনো পর্যন্ত বিরোধীদের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ। আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মণীশ সিসোদিয়া, সত্যেন্দ্র জৈন কারগারে। ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনও। ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় জামিনে মুক্ত রয়েছেন সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেকের ঘাড়ের ওপর সিবিআই ও ইডির খাঁড়া ঝুলে রয়েছে। লালু প্রসাদের পুরো পরিবার তটস্থ।

জেলযাত্রা ঠেকাতে এনসিপির অজিত পাওয়ার, প্রফুল্ল প্যাটেল ও কংগ্রেসের অশোক চহ্বানসহ মহারাষ্ট্রের একাধিক নেতা বিজেপির সঙ্গে সন্ধি করেছেন। বিজেপির সঙ্গে জোট করতে বাধ্য হয়েছেন তেলুগু দেশম পার্টির সর্বেসর্বা চন্দ্রবাবু নাইডু। বিরোধীরা খোলাখুলিই অভিযোগ করছেন, ইডি, সিবিআইয়ের ভয় দেখিয়ে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি ক্ষমতা ধরে রেখেছে।

সেই ভয়েই কুঁকড়ে গেছেন দলিত নেত্রী মায়াবতী, ভোট আবহে এটাই জনপ্রিয় ধারণা। বিরোধী জোটে না গিয়ে একাকী নিরুচ্চার থাকা ও জেলযাত্রার মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার শর্তে ৬৮ বছরের নেত্রী স্বস্তিকেই আঁকড়ে ধরেছেন। সেই সুযোগে দলিত সমাজে প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসী বিজেপি। উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে বিএসপির নীল চার দশকের রাজনীতিতে তাই এত নিষ্প্রভ ও দুর্লভ।