এবার তিনি মোদিকে হারাতে কাজ করছেন, কে এই সুনীল

ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে ১৯ এপ্রিল। নির্বাচনে কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রচার কৌশল নিয়ে কাজ করছেন সুনীল কানুগোলু। এর আগে ২০১৪ সালে তিনি নরেন্দ্র মোদির প্রচার দলে ছিলেন। তাঁকে নিয়ে গত ১৯ এপ্রিল আল জাজিরায় লিখেছেন দিল্লিভিত্তিক ভারতের সাংবাদিক সুপর্ণা শর্মা। ব্যবসা, সিনেমা, রাজনীতি, পপ সংস্কৃতিসহ নানা বিষয়ে লিখে থাকেন তিনি।

মোদির পক্ষে এক সময় কাজ করা সুনীল কানুগোলু এবার তাঁর বিপক্ষে কাজ করছেন
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় তেলেঙ্গানা রাজ্যে গত বছর যখন কংগ্রেসের হয়ে সুনীল কানুগোলু নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন, তখন তিনি রাজ্যের ক্ষসতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে জুতসই কিছু খুঁজছিলেন। খুঁজতে খুঁজতে বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ সেচ প্রকল্পের একটি পিলারে ফাটল পেয়ে গেলেন। সেই ফাটল দিয়েই তিনি বাজিমাত করলেন।রাজ্যে কংগ্রেসকে ক্ষমতায় নিয়ে এলেন। কংগ্রেসের হয়ে সেটিই ছিল তাঁর প্রথম কাজ।

এক দশক আগে তেলাঙ্গানা রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারত রাষ্ট্র সমিতির (বিআরএস) নেতা চন্দ্রশেখর রাও এই রাজ্য শাসন করেছেন। গত নির্বাচনে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এমনভাবে আনা হলো, যাতে এই সরকারের প্রতি রাজ্যের মানুষের মোহমুক্তি হয়ে যায়। সেই প্রচার নির্বাচনে কংগ্রেসের জন্য দারুন ফল বয়ে এনেছিল।

ভারতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী কৌশলে এবার পেছন থেকে কাজ করছেন সেই সুনীল। এবার তিনি আরও বেশি কিছু চাচ্ছেন, যা তাঁর দলকে সুবিধা এনে দেবে। একটি মন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে তিনি সেই কাজ করতে চান।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুনীলের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি বলছিলেন, ৪০ বছর বয়সী স্বল্পভাষী মানুষটি প্রায়ই একটি কথা বলেন। ‘যুক্তি দিয়ে কোনো নির্বাচন জেতা যায় না। নির্বাচন জিততে চাই আবেগ।’

তেলেঙ্গানায় সুনীলের দলের একজন কালেশ্বরম সেচ প্রকল্পের একটি পিলারে ছোট্ট একটি ফাটলের ছবি পেয়েছিলেন। বিআরএসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সেই ফাটলকে নির্বাচনী প্রচারের বড় এক অস্ত্রে রূপান্তর করলেন সুনীল।

তেলেঙ্গানা রাজ্যের বিভিন্ন অংশে নকল এটিএম বুথ বানানো হলো, এটিএম বুথের ছবি সাঁটানো হলো। আর এই এটিএম বুথে প্রতীকী একটি অর্থ দেওয়া হলো। আর সেখানে দেওয়া হলো মুখ্যমন্ত্রীর মুখ। সব অর্থ যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে—এটিএম বুথের এই ছবি ভাইরাল হয়ে গেল। এই ছবি আর গল্পের মাধ্যমে কংগ্রেস বলতে চেয়েছে, প্রায় ৯৮০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে নির্মিত তেলেঙ্গানার গর্বের প্রতীক এই প্রকল্প বিআরএসের ভয়াবহ দুর্নীতির সাক্ষী হয়ে আছে।

সুনীলের নির্বাচনী প্রচার কৌশলের সবচেয়ে ধ্রুপদি উদাহরণ ছিল তেলেঙ্গানার নির্বাচন।

সেই নির্বাচনী প্রচারের কথা স্মরণ করে সুনীল বলছিলেন, ‘আমি নির্বাচনে তিন-চার-পাঁচটি বা তার বেশি ইস্যু বা ঘটনা নিয়ে লড়াই করার পক্ষে নই। কেবল একটি বয়ান থাকতে পারে, যেটাকে সামনে এনে আপনি নানাভাবে প্রচার চালিয়ে যেতে পারেন। আর অন্যান্য বিষয় থাকলে আপনি সেগুলো কেবল প্রচারে যোগ করে দিতে পারেন।’

তেলেঙ্গানার নির্বাচনে সেই অতিরক্তি কিছু ‘যোগ করার’ বিষয়ের মধ্যে রাখা হয়েছিল ক্ষমতায় আসলে কংগ্রেস কী করতে চায়, সেসবের ফিরিস্তি। যেমন নারী, কৃষক, তরুণ, বৃদ্ধসহ জনগণের কল্যাণে কী কী কাজ করতে চায় কংগ্রেস—সে সব তুলে আনা হয়েছিল।

সুনীলের পরিচালিত বেঙ্গালুরুভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির এক গবেষক আল জাজিরাকে বলেন, তেলেঙ্গানায় ক্ষমতাসীনদের সেচের অনিয়ম আর কংগ্রেসের নানা প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রচার শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে দোদুল্যমান ভোটের ৩ থেকে ৯ শতাংশ তাদের পক্ষে চলে এসেছিল। তেলেঙ্গানার নির্বাচনে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

এক দশক আগে ম্যাকেনসির পরামর্শক দলের সদস্য ছিলেন সুনীল। তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচার কৌশল ঠিক করার কাজ করেছিল এই দল।  

এক দশক পর বিজেপির বা মোদির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের শীর্ষ রাজনৈতিক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন হয়ে এই সুনীল। এবার তাঁর কাজ, এক দশক আগে যাঁকে ক্ষমতায় বসাতে কাজ করেছিলেন, এবার তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরাতে কাজ করছেন। তবে তাঁর চ্যালেঞ্জ কেবল মোদি আর বিজেপি নয়, চ্যালেঞ্জ কংগ্রেসও।

কংগ্রেস প্রায় ১০ বছর ধরে কেন্দ্রে ক্ষমতার বাইরে। ভারতের নিম্নকক্ষ লোকসভায় ৫৪৩ সদস্যের মধ্যে তাদের রয়েছে মাত্র ৫২ জন। ২০২২ সালের মে মাসে সুনীল যখন আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগ দেন, তখন তাঁকে ‘টাস্কফোর্স-২০২৪’ নামে ৮ সদস্যের একটি দলের প্রধান করা হয়। ২০২৩ সালে এই দলের কাজ ছিল, ৯ রাজ্যে কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনী প্রচারের কৌশল ঠিক করা এবং তারপর ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন সামলানো।

কিন্তু কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে সেই দল পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারেনি। ফলে সুনীলকে তাঁর কাজের পরিধি সংকুচিত করে আনতে হয়েছে। তিনি এখন ‘প্ল্যান বি’ নিয়ে কাজ করছেন। ১০০ থেকে ১২০ আসনকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন তিনি। এসব আসনে কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে অথবা ভালো লড়াইয়ের মতো অবস্থায় রয়েছে তারা।

নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লোকনীতির সহপরিচালক সঞ্জয় কুমার বলেন, রাজনৈতিক পরামর্শক কোনো জাদুকর নন। তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ঠিকই। যদি কোনো দল ভালো অবস্থায় থাকে, তাহলে তাঁদের ভূমিকা অনেকটা সীমিত হয়ে যায়।

সঞ্জয় প্রশ্ন তুলে বলেন, এমন কোনো জাদুকর আছেন, যিনি ২০২৪ সালে কংগ্রেসকে বিজয় এনে দিতে পারবেন? এমন ৫০ জন জাদুকরও কংগ্রেসকে বিজয়ী করতে পারবে না।

দলে ভাঙন

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোরকে ভাড়া করেন। ২০০৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামা যেমনটা করেছিলেন, ঠিক সেভাবে একটি প্রযুক্তিবিশেষজ্ঞ দল গড়ে তোলার দায়িত্ব দেন তাঁর কাঁধে। জাতীয় পর্যায়ে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে মোদির ওই উদ্যোগ ছিল।

কিশোর অন্যান্য পেশাদারদের সঙ্গে সুনীলকে দলে নেন। তাঁরা সিটিজেন ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্ন্যান্স (সিএজি) গঠন করেন। তারা ভোটারের উদ্দেশ্য, ভোটাররা কী চান, অতীতের ভোটের নমুনা ইত্যাদি বিষয় বুঝে মোদির জন্য কৌশল ঠিক করার উদ্যোগ নেন।

সিএজির সাবেক রাজনৈতিক পরামর্শক অভিমানু ভারতি বলেন, তখন নির্বাচনে জয়ের মাত্র দুটি পথ ছিল। হয় আপনি আপনার লাইনকে বড় করুন, নইলে অন্যের লাইনে কাটছাঁট করুন।

জনসমক্ষে এভাবে কমই দেখা যায় সুনীলকে
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

সিএজি দুই কৌশলই ফলপ্রসূভাবে কাজে লাগিয়েছিল। তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের অদক্ষতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরালো প্রচার চালিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জাগিয়ে তোলার কাজ করেছিল তারা। আবার কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে ব্র্যান্ড মোদি এবং দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সফল হয়েছিল তারা।

আর এই প্রচার কৌশল ভারতের ৩০ বছরের ইতিহাসে ২০১৪ সালে বিজেপিকে সহজ জয় এনে দিয়েছে আর মোদি হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

কিশোর বিজেপি ছেড়ে গেলেও সুনীল থেকে যান। অন্যদের নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন অ্যাসোসিয়েশন অব বিলিয়ন মাইন্ডস (এবিএম)। বিজেপির নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবিএম কাজ করতে থাকে।

২০১৭ সালে বিজেপি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে জয়ী হয়। সুনীলের নেতৃত্বে এবিএম এই জয়ে বিরাট ভূমিকা রেখেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেন, উপাত্ত বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি, এজেন্ডা নির্ধারণ এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কৌশল নির্ধারণে সুনীল বেশ দক্ষ।

বিজেপির হয়ে বেশ কিছু নির্বাচনে জয়ের পর সুনীল বিজেপি থেকে বেরিয়ে যান এবং নিজেই বেঙ্গালুরুতে ‘মাইন্ডশেয়ার অ্যানালিটিকস’ নামে রাজনৈতিক পরামর্শবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। প্রাথমিকভাবে তারা ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কাজ করেছে।

সুনীলের বন্ধু ও সহকর্মীদের মতে, বেশ কয়েক বছর বিজেপির সঙ্গে কাজ করলেও তিনি সব সময় দলটির ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধী। তবে ব্যক্তিগত আলাপে তাঁরা বলছেন, সুনীল তাঁদের কাছে স্বীকার করেছেন, আরও কিছু মৌলিক কারণে তিনি মোদির পক্ষ ত্যাগ করেছেন।

নিজেকে সব সময় পেছনের মানুষ হিসেবে রাখতে চান সুনীল। এ জন্য নিজের প্রাইভেসির প্রতি তিনি খুব যত্নশীল। সব সময় তিনি গণমাধ্যম এড়িয়ে চলেন। আল জাজিরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চাইলেও তিনি রাজি হননি।

গত বছর কর্ণাটক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সুনীল কংগ্রেসে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ নেতার সঙ্গে বেঙ্গালুরুর তাজ হোটেলে দেখা করেন। বিষয়টি কীভাবে যেন জানাজানি হয়ে যায়। ওই নেতা বলেন, তখন মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক প্রার্থী কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানীর ওই হোটেলে ভিড় করেছিলেন।

সুনীল দেখতে কেমন তা কেউ জানেন না। কিন্তু মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা চারদিকে উঁকিঝুঁকি মারছিলেন। ওই সময় সুনীল তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে হোটেল লনে বসে গল্প করছিলেন, খাচ্ছিলেন। পরে তিনি কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে নিরবে চলে যান।  

সুনীলের প্রতিষ্ঠানের এক পরামর্শক বলছিলেন, যতদূর জানা যায়, তিনি মূলত কর্ণাটকের মানুষ। তিনি পিছিয়ে থাকা বালিজা জনগোষ্ঠীর মানুষ। তেলেগু অভিনেতা চিরঞ্জীব এই জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা। তিনি বড় বয়েছেন তামিল নাডু রাজ্যের চেন্নাইয়ে। তিনি কম্পিউটার প্রকৌশলে পড়াশোনা করেছেন এবং পরে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে ম্যাককিনসে যোগ দেন। তিনি তামিল, তেলেগু, কান্নাডা, হিন্দি ও ইংরেজি—এই পাঁচ ভাষায় দক্ষ। তবে তিনি কথা বলার চেয়ে শোনেন বেশি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রশান্ত কিশোর যেমন গণমাধ্যমের আলোয় থাকতে পছন্দ করেন, সুনীল ঠিক তার উল্টো। তিনি আড়ালে থাকতে চান এবং নির্বাচনে জয়ের সব কৃতিত্ব জনগণ, প্রার্থী ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের দিতে চান।  

দক্ষ কৌশলবিদ

তেলেঙ্গানায় সেচ প্রকল্পের পিলারের ফাটল দিয়ে যদি নির্বাচনী প্রচারের দারুন একটি মুহূর্ত তৈরি থাকেন, তাহলে সুনীল ২০২৩ সালে কর্ণাটক রাজ্যে এমন এক আগ্রাসী কৌশল নিয়েছেন, যা কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে একেবারেই অনুপস্থিত ছিল বলে বিশ্লেষকেরা বলছেন।  

রাজ্যে এমন একটি অভিযোগ ছিল, ঠিকাদারদের যেকোনো প্রকল্পের কাজ পেতে রাজ্যের বিজেপি সরকারকে ৪০ শতাংশ কমিশন দিতো হতো। সুনীলের দল সেই অভিযোগ লুফে নিল এবং ‘পে সিএম’ নামে প্রচার শুরু করল। তারা এমন একটি পোস্টার বানাল, যেখানে একটি কিউআর কোড দেওয়া হয়েছে যা দেখতে অনেকটা বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীর চেহারার মতো।

কেউ সেই কিউআর কোড স্ক্যান করলে এমন একটি ওয়েবসাইটে নিয়ে যেত, সেখানে রাজ্য বিজেপি সরকারের দুর্নীতির অভিযোগের বিপুল খতিয়ান দেওয়া আছে। কংগ্রেস নির্বাচনে জয়ী হল, সুনীলকে মন্ত্রীর মর্যাদায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা বানানো হলো।

গত বছরের শেষ দিকে কংগ্রেস যখন সুনীলকে জাতীয় নির্বাচনের দায়িত্ব নিতে বলল, তিনি তখন পুরো দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বলে দিলেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। গতবার নির্বাচনে হারের পর থেকে এবারের জন্য নির্বাচনী লড়াই শুরু করা উচিত ছিল। মোদির মতো একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হলে দীর্ঘ সময় নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি দরকার।

কর্ণাটক রাজ্যের মহিশুরে বৃষ্টির মধ্যে বক্তৃতা করছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। সুনীলের দল রাহুলের ভাবমূর্তি বাড়াতে এমন নানা ছবি–ভিডিও সামাজিক মাধমে ছেড়েছেন
ফাইল ছবি: এএনআই

পুরো দায়িত্ব না নিলেও কংগ্রেসের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন সুনীল। তিনি প্রায়ই নয়া দিল্লি উড়ে যাচ্ছেন, রাহুল গান্ধীর কাছে নানা প্রচারপত্র তুলে দিচ্ছেন এবং দেশব্যাপী জাতপাত গণনার মতো বিষয়ে কথা বলছেন, যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমর্থন কংগ্রেসের দিকে যায়। রাম মন্দিরের মতো বিষয় নিয়ে যতটা সম্ভব কথা না বলারও পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।

বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের তুমুল লড়াই হতে পারে—সুনীল এমন সব রাজ্য সফর করছেন। মানুষের মন এবং কংগ্রেসের প্রচারের প্রভাব বুঝতে জরিপ চালাচ্ছেন।
ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে কংগ্রেস বর্তমানে মাত্র তিনটি রাজ্যে এখন ক্ষমতায় আছে। এর মধ্যে তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটকে সুনীলের নেতৃত্বে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিল কংগ্রেস।

লোকসভা নির্বাচনের পাশাপাশি তিনটি রাজ্য ওড়িসা, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন সুনীল। ওডিসায় লোকসভার সঙ্গে বিধানসভার ভোট চলছে। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় চলতি বছরের শেষের দিকে ভোট হবে।

গান্ধীর ভাবমূর্তি পরিবর্তনের কাজ

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে রাহুল গান্ধী ১৫০ দিনের ভারত জোড়ো যাত্রা কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। তিনি ভারতের সর্বদক্ষিণের ভারত মহাসাগর উপকূল থেকে সর্বউত্তরের কাশ্মীর পর্যন্ত এই হাঁটা কর্মসূচি চালান। বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও নীতির বিরুদ্ধে ছিল তাঁর এই যাত্রা।

সুনীল তেলেঙ্গানা ও কর্ণাটক রাজ্যের নির্বাচনী প্রচার কৌশলের দায়িত্ব নেন। তিনি ভারত জোড়ো যাত্রার কিছু স্মরণীয় মুহূর্তও তৈরি করেন। একদিন রাহুল মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে বক্তৃতা করেন এমন ছবি তোলেন। আবার পরদিন তিনি ২০১৭ সালে নিহত সাংবাদিক গৌরি লঙ্কেশ ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে হাঁটেন। লঙ্কেশ কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের ঘোর সমালোচক ছিলেন।

সুনীলের দল আরও অনেক মুহূর্তকে কাজে লাগিয়েছে। যেমন: রাহুল শীতের মধ্যে সাদা রঙের টি-শার্ট গায়ে হাঁটছেন; শিশু, মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন। এসব নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে ছবি ও মর্মস্পর্শী ভিডিও বানিয়েছে তাঁর দল। এসব ছবি-ভিডিও তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে।

এসব ছবি ও ভিডিও ভারত জোড়ো যাত্রাকে গণ–আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। এসব কিছু রাজনৈতিক বিরোধীদের কাছে গান্ধীর ভাবমূর্তি অনেকটা পরিবর্তন করতে সহায়তা করছে। বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে রাহুল ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী ভাবমূর্তি হয়ে উঠছেন।

সময়োপযোগী পদক্ষেপ

অন্ধ্র প্রদেশ থেকে দুবার নির্বাচনে জয়ী রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইউটিউবার অধ্যাপক কে নাগেশ্বর বলেন, ‘আপনার শক্ত বয়ান থাকতে পারে, একটি বিশ্বাসযোগ্য গল্প থাকতে পারে—যা দিয়ে আপনি মানুষকে বলতে পারেন, কেন মানুষ আপনাকে ভোট দেবে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীকে কেন দেবে না।’  

২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেশে ডানপন্থীদের ব্যাপক উত্থান হয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচন হচ্ছে সেই উত্থানের চরম মুহূর্ত। এবারের নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে যাবে, সেই ডানপন্থার উত্থানের পথে ভারত হাঁটবে কি না।

নতুন ভারত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা কংগ্রেসের ভবিষ্যৎও এবারের নির্বাচনে অনেকটা বোঝা যাবে।

সুনীলের জন্যও এই নির্বাচনের গুরুত্ব কম নয়। নির্বাচনী প্রচার কৌশলে যে খ্যাতি তিনি অর্জন করেছেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে সেটি তিনি কতটা ধরে রাখতে পারেন, সেটিও দেখার বিষয়। প্রায় নিশ্চিত হারের পূর্বাভাস থাকা কংগ্রেসকে তিনি কতটা টেনে তুলতে পারেন, ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি যে নিজেদের দক্ষ দাবি করছে, সেখানে তিনি কতটা আঘাত করতে পারেন—এসব বিষয়ে নজর থাকবে অনেকের।

সুনীল বিভিন্ন নির্বাচনী বিজ্ঞাপনে বিজেপির দাবি করা উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সে সব কতটা কাজ করছে, সেটি দেখার বিষয়। একই সঙ্গে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে সুনীলকে কংগ্রেসের নির্বাচনী কৌশল নতুন করে সাজাতে হচ্ছে।

চলতি মাসের শুরুর দিকে কংগ্রেস ও তার মিত্র তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির কথিত দুর্নীতি নিয়ে গল্প বলার চেষ্টা করেছিল। দিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে কংগ্রেস বিজেপি সরকারের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের একটি বক্তব্য এবং বিভিন্ন দলের দুর্নীতির অভিযোগ উঠা নেতাদের দলটিতে যোগ দেওয়া নিয়ে কথা বলে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। তারা বিজেপিকে ‘ওয়াশিং মেশিন’ বলে আখ্যায়িত করেছে। ওয়াশিং মেশিনে যেমন নোংরা কাপড় দিলে তা পরিষ্কার হয়ে যায়, তেমনি দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো নেতা বিজেপিতে যোগ দিলে তিনি সাফসুতরো হয়ে যান। বিজেপির বিরুদ্ধে এমন একটা অভিযোগ আনতে চেয়েছিলেন তাঁরা।

তবে সামাজিক মাধ্যমে সুনীলের দল একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে, ‘ওয়াশিং মেশিং’ প্রচার মানুষকে তেমন হাসাতে পারেনি। একইভাবে ‘মোদি ওয়াশিং পাউডার’ কংগ্রেসের পক্ষে জোরালো কোনো জনসমর্থন তৈরি করতে পারেনি।

এরপর থেকে ‘ওয়াশিং মেশিন’ কথাটা কংগ্রেসের নেতাদের মুখ থেকে হারিয়ে যায়। কংগ্রেস জাতপাত গণনার ওপর জোর দিতে থাকে। ১৯৩১ সাল থেকে ভারতে জাতপাত গণনার মাধ্যমে আদমশুমারির কোনো কিছু প্রকাশ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতপাতের তথ্য প্রকাশ না করার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যে সরকারের নীতিতে খুব একটা গুরুত্ব পায় না, সেটাই বোঝা যাচ্ছে।

কর্ণাটক রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমারের সঙ্গে সুনীল (ডানে)
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

রাহুল গান্ধী দেশব্যাপী জাতপাত গণনার ওপর জোর দিচ্ছেন। রাহুল দাবি করছেন, এই গণনার মাধ্যমে একটি বিষয় বেরিয়ে আসবে। সেটা হচ্ছে—রাষ্ট্রের সম্পদ, সরকারের বড় বড় পদ এবং চাকরি উচ্চ বর্ণের মানুষই ভোগ করছে বেশি। দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হচ্ছে উচ্চবর্ণের মানুষ।

কংগ্রেসের ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তারা ক্ষমতায় এলে জরিপ চালাবে এবং এই বৈষম্য নিরসনে নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে।

সম্প্রতি সুনীল তাঁর দলকে বলেছেন, ‘এই জাতপাত গণনার গুরুত্ব কতটা, সেটা মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব আপনাদের। মানুষকে বোঝাতে হবে, তাঁরা প্রতারিত হচ্ছেন। বোঝাতে হবে, তাঁদের সঙ্গে এতগুলো বছর বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। তাদের আরও বোঝাতে হবে, জাতপাত গণনার মাধ্যমে বৈষম্য দূর হলে তাদের জীবনে কতটা পরিবর্তন আসবে, তাদের জীবন কতটা ভালো হবে।

সুনীলের এক বিশ্বস্ত সহযোগী বলেছেন, সুনীল ভালো করেই জানেন, কংগ্রেসের জাতপাতের বয়ান কতটা দুর্বল। এখনো কংগ্রেস আশা করছে, দোদুল্যমান ভোটাররা তাদের পক্ষে যাবে এবং ভারতের সবচেয়ে পুরোনো দল এবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে।
ওই বিশ্বস্ত সহযোগী আরও বলেন, সুনীল নির্বাচন শুরুর কয়েক দিন আগে প্রচার কৌশলের পরিকল্পনা তুলে ধরে তাঁর দলের সদস্যদের বলেছেন, আপনাদের হাতে যা নেই, তা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই।

সুনীল দলের সদস্যদের বলেছেন, ভবিষ্যৎ চিন্তা করুন এবং সামনে এগিয়ে যান। খুঁত খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে যান।

অনুবাদ: শাহজাহান সিরাজী