মোদির চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছেন চন্দ্রবাবু, শিন্ডে ও অজিত পাওয়ার

নরেন্দ্র মোদি ও চন্দ্রবাবু নাইডুছবি: এএনআই

ভারতের নতুন সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনে নিজের কর্তৃত্ব দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তিনি পুরোপুরি চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না। মহারাষ্ট্রের দুই মিত্র এনসিপির অজিত পাওয়ার ও শিবসেনার একনাথ শিন্ডে মোদির গলার কাঁটা হয়ে খচখচ করছেন। সেই সঙ্গে তাঁর চিন্তা বাড়িয়েছেন অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী টিডিপি নেতা চন্দ্রবাবু নাইডুও। লোকসভার স্পিকার পদের দাবি ছাড়তে তিনি এখনো নারাজ। কী করবেন প্রধানমন্ত্রী মোদি?

এ প্রশ্নের উত্তর এখনো কারও কাছেই নেই। স্পিকার প্রশ্নের জট খুলতে হবে সাত দিনের মধ্যে। নতুন লোকসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণ ১৮ থেকে ২০ জুনের মধ্যে হবে বলে ঠিক হয়েছে। এ সময়ের ভেতর ঐকমত্য না হলে সেটা হবে এনডিএ জোটের নতুন সমস্যা।

অজিত পাওয়ারের এনসিপির হাল এবার সবচেয়ে খারাপ। মাত্র একটি আসনে জিতে তাঁর দলকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সে তুলনায় শিন্ডের অনুগামী সেনাদের হাল মন্দের ভালো। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডের দলের কাছে রয়েছেন সাত সংসদ সদস্য। দুই দলকে এক করে স্বাধীন ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর বেশি বরাদ্দ করেননি মোদি।

শিন্ডে প্রতিমন্ত্রীর বরাদ্দ গ্রহণ করেছেন নিমরাজি হয়ে, অজিতের সঙ্গী প্রফুল্ল প্যাটেল প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন, কেন্দ্রে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর কম পদমর্যাদার কিছু গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। শিন্ডে ও পাওয়ার, দুই নেতাই জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকবেন।

শিন্ডে তো সরাসরিই প্রশ্ন তুলেছেন, বিহারের ‘হাম’ নেতা জিতেন রাম মাঞ্ঝি একটি আসন পেয়ে যদি পূর্ণ মন্ত্রী হতে পারেন, তাহলে সাতটি আসন জিতে তাঁর দল কেন সেই সম্মান পাবে না?

মোদির চিন্তা হওয়ারই কথা। কারণ, মহারাষ্ট্রের রাজনীতির অলিন্দের খবর, শিন্ডের অনুগামীদের কেউ কেউ উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। অজিত পাওয়ার আবার সরাসরি কাকা শারদ পাওয়ারের গুণগান করে বলেছেন, এনসিপিকে একা হাতে তিনিই গড়ে তুলেছেন।

এসব নেতার পাশাপাশি বেসুরো গাইছেন চন্দ্রবাবু নাইডু। তাঁর প্রাথমিক চাহিদা ছিল তিন পূর্ণ ও এক প্রতিমন্ত্রী। সে জায়গায় এক পূর্ণ ও এক প্রতিমন্ত্রী নিয়ে তাঁকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে বেসামরিক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তাঁরই অনুগত কে রামমোহন নাইডু। কিন্তু এত অল্পে চন্দ্রবাবু সন্তুষ্ট হবেন কি? বিশেষ করে তাঁরই দলের প্রয়াত নেতা জি এম বালাযোগী যখন কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকারের আমলে লোকসভার স্পিকার হয়েছিলেন!

চন্দ্রবাবুর হাতে আছেন ১৬ সদস্য। নীতীশ কুমারের কাছে ১২ সদস্য। চাপের রাজনীতিতে দুজনেই দড়। দুজনের কেউই চান না স্পিকারের পদ বিজেপির পছন্দের কারও হাতে তুলে দিতে। কারণটা স্পষ্ট; স্পিকার হাতে থাকলে দলত্যাগবিরোধ আইনের ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষে সুবিধাজনক হয়। চন্দ্রবাবু ও নীতীশ কুমার দুজনেরই শঙ্কা, সরকার স্থিতিশীল করতে শরিকদের দল ভাঙাতে বিজেপি দুবার ভাববে না। রাজ্যে রাজ্যে বারবার সেই কাজ মোদি-শাহ জুটি দক্ষতার সঙ্গে করে গেছেন।

মহারাষ্ট্রের একাংশের নেতা অজিত পাওয়ার আর শিবেসেনা একনাথ শিন্ডে চিন্তা বাড়িয়ে দিয়েছেন মোদির। লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে দুজন এক মঞ্চে
ছবি: এএনআই

মোদি অবশ্য পাল্টা চাল চেলে রেখেছেন। চন্দ্রবাবুকে জানিয়েছেন যে প্রয়োজনে অন্ধ্র প্রদেশের বিজেপির সভানেত্রী ডি পুরুন্ডেশ্বরীকে তিনি স্পিকার করতে প্রস্তুত। পুরুন্ডেশ্বরী তেলেগু দেশম পার্টির (টিডিপি) প্রতিষ্ঠাতা এন টি রাম রাওয়ের মেয়ে। অর্থাৎ সম্পর্কে চন্দ্রবাবুর শ্যালিকা। অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশে কংগ্রেসের নেত্রী ছিলেন পুরুন্ডেশ্বরী। কেন্দ্রে মনমোহন সরকারের আমলে দুবার মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ২০১৪ সালের মার্চে রাজ্য ভাগের প্রতিবাদে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন।

নরেন্দ্র মোদি ভাবছেন, পারিবারিক যোগাযোগের দরুন চন্দ্রবাবুর মন গললেও গলতে পারে। টিডিপি নেতা অবশ্য এখনো মত দেননি। তাঁর হাতে নতুন অস্ত্র কংগ্রেসের প্রস্তাব। তারা জানিয়েছে, স্পিকার পদে নির্বাচনে টিডিপি প্রার্থী দিলে কংগ্রেস নিঃশর্ত সমর্থন জানাবে।

মুকুটের এতগুলো কাঁটার খচখচানি কী করে দূর করবেন প্রধানমন্ত্রী মোদি? রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত গতকাল সোমবার যা বলেছেন, তাতে স্পষ্ট যে এত দিন মোদি যেভাবে সরকার চালিয়ে এসেছেন, তাতে সংঘের সায় নেই। সংঘের সঙ্গে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির টানাপোড়েন আগামী দিনে কোন দিকে মোড় নেবে, তা এখনো অজানা।

এ মাসের মধ্যেই দলের সভাপতি নিয়োগ করতে হবে। জেপি নাড্ডার মেয়াদ আগেই উত্তীর্ণ হয়েছে। নির্বাচনের জন্য তিনি বাড়তি সময় কাজ চালিয়েছেন। সংঘ নাকি মোদির নিজের অনুগামী, কাকে দায়িত্বে আনা যায়, সেই আলোচনা চলছে। নাড্ডার মতো একান্ত অনুগামী কেউ দায়িত্ব না পেলে দল ও সরকার নিজের ঢঙে চালানো মুশকিল। তার ওপর বাড়তি চাপ শরিকদের।

চলতি বছরটা মোদির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে চারটি রাজ্যে বিধানসভার ভোট। মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় বিজেপি ক্ষমতায়। কিন্তু দুই রাজ্যেই হাল বেশ খারাপ। কতটা খারাপ, সেটা বোঝা গেছে লোকসভার ভোটে। ঝাড়খন্ডেও বিজেপি আগের রমরমা অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। তার ওপর সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন ইস্তফা দিয়ে কারাগারে গেছেন। আদিবাসীদের সহানুভূতি তাঁর দিকে।

চতুর্থ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর। সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেখানে ভোট করাতে বলেছেন সুপ্রিম কোর্ট। লোকসভা ভোটে কারাবন্দী প্রকৌশলী রশিদের জয় বুঝিয়ে দিয়েছে যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার নিয়ে উপত্যকার মানুষের মন এখনো ক্ষুব্ধই। চারটি রাজ্যেই বিজেপি হারলে মোদির বলিরেখা গাঢ় হবে। রাজনীতিও থাকবে নতুন বাঁক নেওয়ার অপেক্ষায়।

মোদি সরকার গড়েছেন ঠিকই। গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরেও নিজের অনুগামী রেখেছেন, যাতে সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদির চিন্তামুক্ত থাকা কঠিন।