মোদি কি চীনের প্রেসিডেন্টকে লাদাখে দখল করা অঞ্চল ছাড়তে রাজি করাতে পারবেন

দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের এক ফাঁকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২৪ আগস্ট
ছবি: এএনআই

দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের আসরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মধ্যে কবে, কোথায়, কতক্ষণ কথা হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা ভারতের কর্তারা দেননি। গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সাংবাদিকদের শুধু এটুকু জানিয়েছেন, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলএসি) বরাবর উত্তেজনা প্রশমনের পাশাপাশি সমস্যা দূর করতে দুই নেতা দুই দেশের কর্তাদের নির্দেশ দিতে রাজি হয়েছেন।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আশা, দুই দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই হস্তক্ষেপ পূর্ব লাদাখের দুর্গম গিরি প্রান্তরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফেরাতে সহায়ক হবে। তবে তিন বছর আগের স্থিতাবস্থা ফিরে সম্পর্কের বরফ কতটা গলবে এবং তা–ও আগামী মাসে দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে, সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

ভারত একান্তভাবে চায়, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগেই সীমান্তের উত্তেজনা দূর হোক। দুই দেশ চূড়ান্ত বোঝাপড়ায় পৌঁছাক। ওই সম্মেলনে যোগ দিতে সি চিন পিংয়ের দিল্লি আসার কথা।

পূর্ব লাদাখজুড়ে এলএসি পরিস্থিতি তিন বছর ধরেই ভারতের গলার কাঁটা হয়ে খচখচ করছে। দুর্গম ওই এলাকার বিস্তীর্ণ ভারতীয় ভূখণ্ডে (কংগ্রেসের দাবি মোট দুই হাজার বর্গকিলোমিটার) ২০২০ সালের জুনের সংঘর্ষের পর থেকে চীনা ফৌজ দখল করে রেখেছে। তবে বিজেপি সরকারের বক্তব্য, ছয় দশক ধরে চীন লাদাখের ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বেআইনিভাবে দখল করে আছে।

গালওয়ান সংঘর্ষের পর দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৯টি বৈঠক হয়েছে। তাতে কোনো কোনো এলাকা নিয়ে দুই পক্ষের মীমাংসা হলেও সার্বিক সমাধান হয়নি। সংঘর্ষের আগে এলএসির মোট ৬৫টি এলাকায় ভারতীয় বাহিনী টহলদারি চালাতে পারত। সেই জায়গাগুলোর মধ্যে এখনো ২৬টি এলাকায় চীনের বাধার কারণে ভারতীয়রা পা ফেলতে পারেন না।

সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, চীনা প্রেসিডেন্টকে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক তখনই স্বাভাবিক হবে, যখন প্রাক্‌ ২০২০ স্থিতাবস্থা ফিরে আসবে, সীমান্ত উত্তেজনা থাকবে না এবং এলএসি বরাবর শান্তি ও সুস্থিতি থাকবে।

ভারতের চিন্তার দিক দুটি। একটি চিন্তা সামরিক দিক থেকে, অন্যটি রাজনৈতিক। ২০২০ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর চীন সীমান্তের দিকে ভারত বেশি মনোযোগী হয়। এলএসি বরাবর যে ঢিলেমি ছিল, তা কাটাতে ভারত নানা রকম প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির দিকে নজর দেয়। সড়ক নির্মাণ, উপযুক্ত ঘাঁটি তৈরি, বছরভর সেনা উপস্থিতির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি, ভারী সমরাস্ত্র নিয়ে যাওয়া, ক্ষেপণাস্ত্র মজুতের বন্দোবস্ত করা হয়।

এলএসিজুড়ে চীনের উপস্থিতি ভারতের চেয়ে বেশি। দুই দেশই অন্তত ৫০ হাজার করে সেনানী মোতায়েন করে রেখেছে। শান্তি, সুস্থিতি, স্থিতাবস্থা ফেরানো গেলেও পারস্পরিক বিশ্বাস স্থাপনের জায়গা তৈরি হলে এই সামরিক তৎপরতা কমানো যায়। এই কারণে ভারত বারবার স্থিতাবস্থা ফেরানোর ওপর জোর দিচ্ছে।

দ্বিতীয় চিন্তা রাজনৈতিক। ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি, ২০২০ সালের সংঘর্ষের পর ভারতের কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার জমি চীন অন্যায়ভাবে দখল করে রেখেছে। বরং ওই সংঘর্ষের পর সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বড় মুখ করে দাবি করেছিলেন, ‘এলএসি পেরিয়ে কেউ ঢোকেনি, কেউ ভারতের কোনো ঘাঁটিও দখল করেনি।’

প্রধানমন্ত্রীর ওই দাবি বিরোধীরা কিন্তু মানেনি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দাবি তোলা হয়, লাদাখের অগ্রবর্তী এলাকায় সংসদীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে যেতে, যাতে সদস্যরা সরেজমিন সব খতিয়ে দেখতে পারেন। সেই দাবিও সরকার গ্রাহ্য করেনি। এমনকি সীমান্তে চীনা আগ্রাসন নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনার অনুমতিও দেওয়া হয়নি।

বিরোধীরা বারবার প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন, জমি যদি দখল হয়ে না থাকলে ভারত কেন বারবার স্থিতাবস্থা ফেরানোর দাবিতে চীনকে চাপ দিচ্ছে? সরকারের দিক থেকে এর কোনো উত্তর নেই।

সম্প্রতি কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী লাদাখ সফরে গিয়ে নতুনভাবে ওই পুরোনো প্রশ্ন তুলেছেন। সেখানকার জনগণ তাঁকে বলেছেন, অগ্রবর্তী এলাকায় যেখানে স্থানীয় ভারতীয়রা এত বছর নির্বিঘ্নে পশুচারণ করে এসেছেন, চীনা ফৌজের বাধায় গত তিন বছরে সেখানে তাঁরা যেতে পারছেন না। রাহুলের কথায়, চীন ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে রয়েছে এটা কোনো অভিযোগ নয়, নির্জলা সত্য। মোদি সরকার এই সত্য অস্বীকার করে চলেছে।

পূর্ব লাদাখের প্যাংগং লেক, কৈলাস রেঞ্জ, গালওয়ান উপত্যকা, গোগরা হট স্প্রিং অঞ্চলে যে ‘বাফার জোন’ তৈরি হয়েছে, তা সাময়িক বন্দোবস্ত। যত দিন না চীনা ফৌজ প্রাক্‌ ২০২০ অবস্থানে পাকাপাকিভাবে ফিরে যাচ্ছে, তত দিন উত্তেজনা প্রশমন ও সংঘর্ষ এড়াতে এই ব্যবস্থায় ভারত রাজি হয়েছে। তবে ওই ধরনের ব্যবস্থা এখনো ডেমচক ও ডেপসাং ঘিরে করা যায়নি।

ভারতের সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেমচকের চারডিং নিংলুং নালার (সিএনএন) ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনা ফৌজ যেসব তাঁবু খাটিয়ে অবস্থান করছে, তা থেকে তাদের সরে যাওয়া সম্ভবত সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু জটিল সমস্যা ডেপসাংয়ের মালভূমি ঘিরে। সেখানে চীনা ফৌজ ভারতের ১৮ কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকে ভারতীয় জওয়ানদের টহলদারিতে বাধা দিচ্ছে। দৌলতবাগ ওলডি এলাকায় সামরিক দিক থেকে উল্লেখযোগ্য অবস্থান দখল করে রয়েছে। এই এলাকা থেকে চীন পেছিয়ে যেতে রাজি হবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।

উত্তেজনা কমানো এক বিষয়, চীনা বাহিনীর পুরোনো অবস্থানে ফিরে যাওয়া কিংবা সীমান্তে দুই দেশের সেনাসংখ্যা কমানো আরেক বিষয়। পূর্ব লাদাখে গত তিন বছরে নতুনভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি না করার বিষয়ে সতর্ক থাকলেও প্রাক্‌–সংঘর্ষ স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে চীন আগ্রহ দেখায়নি।

আগামী নির্বাচনের আগে চীনের এই অবস্থান শাসক বিজেপির পক্ষে মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। প্রধানমন্ত্রী তাই চান, সেপ্টেম্বরে জি-২০ সম্মেলনে চূড়ান্ত বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে। এই কারণে দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই নেতার বাক্যালাপের ওপর ভারত জোর দিচ্ছে। যদিও এটা ঠিক, গত বছর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে মোদি-সির মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও এলএসি পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি।